কদমা-বাতাসার দিন ফিরছে
গ্রামবাংলার মেলার চিরায়ত খাবার বাতাসা, কদমা, মুরলি, নিমকি শহরাঞ্চলে কালেভদ্রে চোখে পড়ে। তবে পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে দেশজুড়ে উৎসবের আমেজ দিন দিন ছড়িয়ে পড়ার কারণে এখন রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরের অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়ছে ঐতিহ্যবাহী এই খাবার।
কয়েক বছর ধরেই নববর্ষ উদ্যাপনে অনুষঙ্গ হিসেবে এসেছে এসব লোকজ খাবার। বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান তাদের গ্রাহকদের বৈশাখী উপহারের বিশেষ মোড়কে এসব দিচ্ছে। ফলে রাজধানীসহ সব জেলাতেই প্রতিবছর ঐতিহ্যবাহী এসব খাবারের চাহিদা বাড়ছে। প্রসারিত হচ্ছে এগুলোর ব্যবসার পরিধি।
কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, কদমা, বাতাসা, মুরলি কোথাও ‘সাজ খাবার’ আবার কোথাও ‘মিঠাই’ নামে পরিচিত। সারা বছরই এসবের চাহিদা থাকে। তবে ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল-পাঁচ মাস গ্রামগঞ্জে বিভিন্ন মেলার সময় চাহিদা বাড়ে। বৈশাখে চাহিদা থাকে সবচেয়ে বেশি।
দেশীয় ঐতিহ্যবাহী এসব খাবার মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া, ঢাকার ধামরাই, সাভার এবং বগুড়ার সদর উপজেলার হরিপুর গ্রামে সবচেয়ে বেশি তৈরি হয়। এ ছাড়া দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আরও কিছু ছোটখাটো কারখানায় কদমা, বাতাসা তৈরি হচ্ছে। এসব খাবার আশপাশের এলাকার পাইকারদের মাধ্যমে সারা দেশে বিক্রি হয়। সারা বছর এই খাবারগুলো কী পরিমাণ উৎপাদিত হয় এবং বাজারের আকার কত বড়, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই।
এসব খাবার কবে থেকে, কীভাবে বাংলা অঞ্চলে চালু হলো তার ইতিহাসও খুব একটা জানা যায় না। রবীন্দ্রনাথের ‘শুভদৃষ্টি’ গল্পে পিতলের রেকাবিতে করে বাতাসা নিয়ে বিয়ের সম্বন্ধ আনার বিষয়টি উল্লেখ আছে।
মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার ভাটারা গ্রামের সাত পরিবার জানায়, তারা ৮০ বছর ধরে এসব খাবার তৈরি করছে। গত শতকের শুরুর দিকে কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরায় বাতাসা, কদমা ইত্যাদি বিক্রির ছোট্ট পাইকারি বাজার গড়ে উঠেছিল বলে জানা যায়।
কেরানীগঞ্জে তিন পুরুষের ব্যবসা
কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরা বাজারে ৯-১০টি দোকানে বাতাসা, কদমা, মুরলি, চিনির সাজ, তিলা, নিমকি বিক্রি হয়। ঢাকাসহ আশপাশের এলাকার মৌসুমি ব্যবসায়ীরা এখান থেকে এসব খাবার কিনে নিয়ে যান। গত সোমবার (৯ এপ্রিল) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে দেখা যায়, বাজার তখনো জমেনি, ক্রেতা কম। ফলে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলার ফুরসত মিলল।
বস্তাভর্তি চিনি ও গুড়ের তৈরি বাতাসা ও মুরলি, কদমা, তিলায় সাজিয়ে ছোট্ট গদিতে বসে আছেন ৩৬ বছর বয়সী রাজন পাল। তিনি বললেন, তাঁদের তিন পুরুষের ব্যবসা। ঠাকুরদা ব্যবসা শুরু করেন। তারপর বাবা করেছেন। এখন তিনি হাল ধরেছেন।
রাজন পাল বলেন, তাঁর দোকানে সাধারণত মাসে দেড় থেকে দুই লাখ টাকার কদমা-বাতাসা-মুরলি বিক্রি হয়। বৈশাখে সেটি কয়েক গুণ বেড়ে যায়। এবার সাত লাখ টাকার পণ্য বিক্রির আশা করছেন।
রাজেন্দ্রপুরে একটি কারখানা থেকে কদমা, বাতাসা, মুরলি, নকুলদানা তৈরি করিয়ে আনেন রাজন। তা ছাড়া যাত্রাবাড়ী ও মাতুয়াইলের দুই ব্যবসায়ীও সরবরাহ করেন। চাহিদা আছে। কিন্তু সরবরাহ কম। কারণ, কারিগর পাওয়া যায় না।
পাশের ব্যবসায়ী রঞ্জিত কুণ্ডুর দোকানে মাসে ২০-৩০ মণ কদমা, বাতাসা বিক্রি হয়। বৈশাখে সেটি বেড়ে ১০০-১৫০ মণ হয়। প্রতি কেজি বাতাসা ও কদমা ৮০, নকুলদানা ৭০-৮০ টাকা, মুরলি ৭০-৮০ টাকা, নিমকি ৯০-১০০ টাকায় পাইকারি বিক্রি হয়।
বগুড়ার ‘মিঠাইপল্লি’
ঘরভর্তি বাঁশের ঝুড়িতে থরে থরে সাজানো সাদা ধবধবে কদমা। কয়েকটি ঝুড়িতে হাতি-ঘোড়া, মাছ ও রকমারি ফুলের আকৃতি দেওয়া কদমা। সবই চিনির। ২০-২৫টি বড় গামলায় ঠাসা খাগড়াই-বাতাসা। বাঁশের ডালায় আরও সাজানো নিমকি, মুড়ি-মুড়কি, মুরলি, তিলা, নকুলদানা ও চিড়ার মোয়া। ঘরের বাইরেও বিশাল কর্মযজ্ঞ। চারটি চুলায় বসানো কড়াইয়ে চিনির গরম শিরা ফুটছে। শিরা ঘন করে কদমার খামির বানানোয় ব্যস্ত কারিগরেরা। অন্য চুলায় কড়াইয়ের গরম তেলে নিমকি-চিড়া ভাজা হচ্ছে।
বগুড়া শহর থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দূরে চাঁদমুহা-হরিপুর কারিগরপাড়ায় গিয়ে গত বুধবার (১১ এপ্রিল) এমন চিত্র দেখা গেল। বৈশাখী এসব খাবার খ্যাতির কারণে বগুড়া সদর উপজেলার এই হরিপুর গ্রাম ‘মিঠাইপল্লি’ নামে পরিচিত। এই এলাকায় বাতাসা, কদমা, মুরলি মিঠাই নামে পরিচিত। গ্রামের অনেকেই মিঠাই তৈরি করে সংসার চালাচ্ছেন। সারা বছর মিঠাই তৈরি হয়। তবে বর্ষার মাস চারেক বেচাবিক্রি কম থাকে বলে কারখানায় উৎপাদনও কমে যায়। আর বৈশাখ উপলক্ষে তাই মিঠাই তৈরি হয় সবচেয়ে বেশি।
মিঠাইপল্লিতে ১৪ জন কারিগরের যৌথ কারখানা আছে। তাঁরা সব ধরনের মিঠাই তৈরি করেন। তাঁরা একে অন্যের আত্মীয়। বৈশাখী উৎসব শেষে হিসাব-নিকাশ করে মুনাফা ভাগাভাগি করেন। পরে নিজেরা আলাদাভাবে ব্যবসা করেন। ১৪ কারিগরের দলনেতা সুজন চন্দ্র দাস।
কারিগর রণজিৎ চন্দ্র দাস বলেন, বৈশাখী উৎসব উপলক্ষে প্রতিদিন গড়ে ৫০০ কেজি মিঠাই তৈরি করছেন তাঁরা। বগুড়ার রাজাবাজার, ফতেহ আলী বাজার, কালীতলা বাজারসহ আশপাশের পাইকারেরা এসব কিনতে আসেন। তাঁরা নিজেরাও বগুড়াসহ আশপাশের জেলার পাইকারদের কাছে মিঠাই পৌঁছে দেন।
সাটুরিয়ার সাত পরিবার
মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার ভাটারা গ্রামে ছয় বণিক ও এক বসাক পরিবার বংশপরম্পরায় ঐতিহ্যবাহী বাতাসা, কদমা, সাজের হাতি-ঘোড়া ইত্যাদি তৈরি করছে। এসব খাবার স্থানীয়ভাবে সাজ খাবার নামে পরিচিত।
বাসুদেব বণিক বলেন, প্রায় ৮০ বছর ধরে এই গ্রামে বাণিজ্যিকভাবে এসব খাবার তৈরি হচ্ছে। গ্রামের হরিচন্দ্র বসাক প্রথম শুরু করেন। সে সময় ২৪-২৫টি পরিবার এসব খাবার তৈরির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় বণিক সম্প্রদায়ের বেশ কয়েকটি পরিবার ভারতে চলে যায়। এ ছাড়া নানা সমস্যার কারণে কয়েকটি পরিবার অন্য পেশায় ঝুঁকছে।
৬ এপ্রিল শুক্রবার ভাটারা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের একটি পাড়ার মধ্যেই বসবাস সাত পরিবারের। প্রত্যেকের বাড়িতে টিনের চালার ঘর। উঠোনের পাশে ছাপরার মতো ঘর তুলে কারখানা করা হয়েছে। তাতে দু-তিনটি চুলা। সেখানেই তৈরি হয় কদমা-বাতাসা।
কয়েকটি পরিবারে পুরুষের পাশাপাশি নারীরা কাজ করছেন। ননী গোপাল বণিকের স্ত্রী আলো রানী বণিক বলেন, বৈশাখে সাজ খাবারের চাহিদা বেড়ে গেছে। সে জন্য সংসারের কাজের পাশাপাশি স্বামীকে সাহায্য করছেন।
কদমা-বাতাসা তৈরির প্রধান উপাদান চিনি। তবে গুড়ের বাতাসাও আছে। শ্যামল বণিক বলেন, ৫০ কেজি চিনি থেকে ৪৮ কেজি সাজ খাবার হয়। প্রতি কেজি সাজের পাইকারি দর ৭০ টাকা। সেই হিসাবে মণপ্রতি মুনাফা হয় ৪৬০ টাকা। প্রতিদিন গড়ে ১০০ কেজি চিনির সাজ খাবার তৈরি করতে পারে একেকটি পরিবার।
ব্যবসায়ীরা জানালেন, বাতাসা-কদমা মানিকগঞ্জ ও টাঙ্গাইলের বিভিন্ন উপজেলায় হাট-বাজার ও মেলায় বিক্রি হয়। সেখানকার ব্যবসায়ীরা ভাটারা গ্রামে এসে এসব খাবার কিনে নিয়ে যান। স্থানীয় হাট-বাজার ও মেলায় বণিক পরিবারের সদস্যরা নিজেরাও বিক্রি করেন।
জানতে চাইলে কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, বৈশাখী উৎসবকে কেন্দ্র করে কদমা, বাতাস, মুরলির মতো তৃণমূল পর্যায়ের খাবার বড় পরিসরে চলে আসাটা বাঙালিয়ানার বড় পরিচয়। এটি বাঙালির সাংস্কৃতিক বোধেরও পরিচয় প্রকাশ করে। তা ছাড়া গ্রাম ও শহরের মানুষ যখন একসঙ্গে একটি খাবার খায়, তখন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও মানুষের সম্প্রীতির বন্ধন দৃঢ় হয়।
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন বগুড়ার নিজস্ব প্রতিবেদক আনোয়ার পারভেজ, মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি আব্দুল মোমিন ও কেরানীগঞ্জ প্রতিনিধি ইকবাল হোসেন]