সংগ্রহশালা
কবিগুরু এখানে আসেননি
২০১৫ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক কবি গুরুর পূর্বপুরুষের বাস্তুভিটাকে প্রত্নতাত্ত্বিক আইনের আওতায় সংরক্ষিত পুরাকীর্তি ঘোষণা করা হয়।
গ্রামটি ঘেঁষে বয়ে গেছে ভৈরব নদ। একসময়ের খরস্রোতা ভৈরব এখন শীর্ণ ধারায় বহমান। গাছগাছালির ছায়াময় মনোরম পরিবেশ আর পাখির কলতানে মুখর সুন্দর ছবির মতো গ্রামটি। নাম তার পিঠাভোগ। এ গ্রামের সঙ্গে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি যোগসূত্র আছে। কবিগুরুর পূর্ববঙ্গ ভ্রমণের অনেক স্মৃতি ও স্মৃতিচিহ্ন থাকলেও পিঠাভোগ গ্রামে কখনো পা রাখেননি তিনি। তবে এখানকার কুশারীবাড়ির বাসিন্দারা কবিগুরুর পূর্বপুরুষ ছিলেন।
পিঠাভোগ গ্রামটি রূপসা উপজেলার ঘাটভোগ ইউনিয়নে পড়েছে। সেখানে ভৈরব নদের ওপরে ছোট কাজদিয়া সেতু। সেতুর উত্তর পারে ঘাটভোগ ইউনিয়ন পরিষদের সরু পিচের রাস্তা ধরে কিলোমিটারখানেক যেতেই দেখা মিলবে সুদৃশ্য প্রবেশপথের। পুরোপুরি কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির প্রবেশপথের আদলেই তৈরি প্রবেশপথের ওপর লেখা ‘কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষের বসতভিটা ও রবীন্দ্রস্মৃতি সংগ্রহশালা’। এটাই কুশারীবাড়ি।
এখানকার কুশারী পরিবারের প্রবীণ সদস্য ছায়ারানী কুশারী (৮৫) বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ আমাদের জ্ঞাতিজন, এটা ভাবতেই গর্ব হয়। আমরাও জমিদার বাড়ির লোক ছিলাম। দ্বিতল বড় দালান ছিল। ১৯৯৪ সালের দিকে সেটা ভেঙে ফেলা হয়েছে। ওই বছরেই এখানে রবীন্দ্র সংগ্রহশালা গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়। কবির জন্ম ও প্রয়াণ দিবসে এখানে বড় অনুষ্ঠান হয়। দেশ-বিদেশ থেকে নানা মানুষ আসে।’
কবিগুরুর পদবি ঠাকুর। পিঠাভোগে তাঁর পূর্বপুরুষদের পদবি ঠাকুর না হয়ে কুশারী কেন, এই প্রশ্ন অনেকের মনে জাগতেই পারে। ইতিহাস বলছে, কুশারীরাই অনেক পরে এসে ঠাকুর পদবি পেয়েছেন।
যশোর-খুলনা অঞ্চলের ইতিহাসবিষয়ক নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ সতীশ চন্দ্র মিত্রের ‘যশোহর-খুলনার ইতিহাস’–এর পয়োগ্রাম কসবা অধ্যায় এবং খুলনা অঞ্চলের স্থানীয়ভাবে প্রকাশিত বিভিন্ন গ্রন্থ আর প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরে সংরক্ষিত তথ্য ঘেঁটে যেসব তথ্য পাওয়া যায়, তাতে বলা হয়েছে, পিঠাভোগের কুশারী বংশের ধারাবাহিকতার একটি অংশই হলো জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার। একসময়ের প্রমত্তা ভৈরব নদের তীরবর্তী পিঠাভোগ গ্রামে রামগোপালের পুত্র জগন্নাথ কুশারী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতৃকুলের আদি পুরুষ। জগন্নাথ কুশারীর অধস্তন পঞ্চম পুরুষ পঞ্চানন কুশারী। পারিবারিক মতপার্থক্যের কারণে পিঠাভোগের যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ভাইয়ের অনুকূলে হস্তান্তর করে ভাগীরথী (গঙ্গা) নদীর তীরবর্তী কলকাতার সুতানুটির দক্ষিণ দিকের গ্রাম গোবিন্দপুরে গিয়ে বসবাস শুরু করেন পঞ্চানন কুশারী। তাঁর ভাই প্রিয়নাথ কুশারী পিঠাভোগ গ্রামে থেকে যান।
ওই সময় গোবিন্দপুরে বসবাস করত জেলে, কৈবর্ত প্রভৃতি জাতি। ওই অঞ্চলে কোনো ব্রাহ্মণের বাস ছিল না। পঞ্চানন কুশারী একমাত্র ব্রাহ্মণ ছিলেন। ফলে এ অঞ্চলে লোকজন পঞ্চানন কুশারীকে ভক্তি করে ঠাকুর বলে ডাকতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। কেবল তা–ই নয়, এ সময় ভাগীরথী নদীতে ইংরেজদের বাণিজ্যতরি ভিড়ত। সেই বাণিজ্যতরি মালামাল ওঠানো–নামানোর ঠিকাদারি ও খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ ব্যবসা শুরু করেন পঞ্চানন কুশারী। এ কাজে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করা স্থানীয় লোকজনও তাঁকে ঠাকুর বলে ডাকায় জাহাজের কর্মচারীদের কাছেও তিনি ঠাকুর বলে পরিচিত হন। এভাবে একদিন পঞ্চানন কুশারীর উপাধি ঠাকুর ডাকের অন্তরালে হারিয়ে যায় এবং কাগজে-কলমে ঠাকুর উপাধি জারি হয়ে যায়। পঞ্চানন কুশারী বা পঞ্চানন ঠাকুরের পৌত্র নীলমণি ঠাকুর কলকাতার জোড়াসাঁকোতে গিয়ে বসতি স্থাপন করেন। নীলমণি ঠাকুরের অধস্তন চতুর্থ প্রজন্ম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পিঠাভোগে থেকে যাওয়া প্রিয়নাথ কুশারীর দশম ও একাদশ বংশধর এখনো পিঠাভোগ গ্রামে বসবাস করছেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আদি পুরুষের ভিটা কুশারীবাড়িরও একসময় জৌলুশ ছিল। এ ভিটায় সেই সময়ের দ্বিতল ভবনের ভিত্তি আবিষ্কার করে তা খননের উদ্যোগ নেন খুলনা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। ২০১১-১২ অর্থবছরে পরীক্ষামূলক প্রত্নতাত্ত্বিক খনন হয়। পরীক্ষামূলক প্রত্নতাত্ত্বিক খননে একটি বিলুপ্ত ইমারতের ভিত নকশা উন্মোচনসহ সেই সময়কালের সাক্ষ্যবাহী বেশ কিছু প্রত্নবস্তু ও স্মারক নিদর্শন সংগ্রহ করা হয়। প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো ভবনটি সমতল ভূমি থেকে চার ফুট উঁচুতে অবস্থিত ছিল এবং তা নির্মিত ছিল ইন্দো–ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক স্থাপত্যশৈলীর আদলে। ২০১৫ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক কবি গুরুর পূর্বপুরুষের বাস্তুভিটাকে প্রত্নতাত্ত্বিক আইনের আওতায় সংরক্ষিত পুরাকীর্তি ঘোষণা করা হয়।
দৃষ্টিনন্দন প্রধান ফটক থেকে ভেতরে একটি রাস্তা চলে গেছে। রাস্তার মাথায় সংগ্রহশালা ও উন্মুক্ত মঞ্চ। ২০০৭-২০০৮ সালে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কুশারীবাড়ি–সংলগ্ন উঠানে একতলা তিন কক্ষবিশিষ্ট স্মৃতি সংগ্রহশালাটি নির্মাণ করে।
সংগ্রহশালায় রবীন্দ্রনাথের নানা সময়ের ছবি, বংশলতিকা, পূর্বপুরুষের বিবিধ পর্যায়ের সদস্যদের ছবি, পুরোনো বাড়িটির ছবি ইত্যাদি সাজিয়ে রাখা হয়েছে। আছে পাঠকক্ষও। স্মৃতি সংগ্রহশালার পাশে আছে একটি ছাদ দেওয়া উন্মুক্ত মঞ্চ। মঞ্চের সম্মুখভাগে স্থাপন করা হয়েছে কবিগুরুর আবক্ষ ভাস্কর্য। সংগ্রহশালার বাইরে রবীন্দ্রনাথ, পিঠাভোগ, কুশারীবাড়ি থেকে ঠাকুরবাড়ির ইতিহাস এবং কবিগুরুর পূর্বপুরুষের বংশতালিকা দেওয়া আছে।
পিঠাভোগ গ্রামে কবির পূর্বপুরুষের বসতবাড়িকে ঘিরে রবীন্দ্রনাথের ভক্ত-অনুরাগীদের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। সম্প্রতি খুলনার দাকোপের কানাই মণ্ডল ও তাঁর বন্ধু ওই সংগ্রহশালা দেখতে গিয়েছিলেন। কানাই মণ্ডল বলেন, ‘এই সংগ্রহশালা থেকে কবিগুরুর পরিবার সম্পর্কে অনেক তথ্য পেয়েছি, যেন কবিগুরুর শিকড়ের কাছাকাছি আসতে পেরেছি। পুরোনো ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পেরেছি। এখানে না এলে অনেক কিছু অজানা রয়ে যেত।’
চলতি বছরের জানুয়ারিতে এই সংগ্রহশালায় এসেছিলেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) খুলনার পরিচালক প্রণব কুমার রায়। পর্যবেক্ষণ বইয়ে তিনি লিখেছেন, ‘কবিগুরুর পৈতৃক আদি ভিটাবাড়িতে অনেক উন্নয়নকাজ করার সুযোগ রয়েছে। বিশ্বকবির পূর্বপুরুষের স্মৃতিধন্য এই পুণ্যভূমিতে পর্যটন আকর্ষণ পয়েন্ট করা জরুরি।’
রাজাপুর, বেলফুলিয়া গ্রামের আবদুল হালিম নামের একজন লিখেছেন, ‘এখানে কবিগুরুর পদার্পণ হয়তো কোনো দিন হয়নি। তবু এখানে যতবার আসি মনে হয়, তাঁর পরশ লেগে আছে সবকিছুতে। দাবি জানাচ্ছি এই কমপ্লেক্সের পূর্ণ রূপ দান করার।’
সংগ্রহশালাটি সপ্তাহে এক দিন শুধু বৃহস্পতিবার খোলা থাকে। অন্য সময় এখানে বসবাসকারী কুশারীরাই এসব দেখভাল করেন।
সংগ্রহশালার এক কর্মী বরুণ চন্দ্র কুশারী বলেন, ‘১৯৯৫ সাল থেকে বিনা পারিশ্রমিকে এখানে কাজ করছি। ২০১৭ সাল থেকে অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজ হয়েছে। সপ্তাহের প্রথম পাঁচ দিন খুলনা বিভাগীয় জাদুঘরে কাজ করি। আর বৃহস্পতিবার পিঠাভোগের সংগ্রহশালায় থাকি।’