কবীর সুমন: গানে গানে, প্রাণের টানে

কবীর সুমনের গানের সঙ্গে প্রথম পরিচয় কলকাতায়। তখন তিনি সুমন চট্টোপাধ্যায়। তাঁর গানও আমাকে প্রথম শুনিয়েছিল বন্ধু শিলু চট্টোপাধ্যায়। শুনে আমি তো এক কথায় মুগ্ধ। তিনি তো অন্য সবার মতো নন। গানের কথা, গাইবার ঢং সবকিছুই একেবারে আলাদা। সেটা ১৯৯২ সাল। বুঝেছিলাম, আধুনিক বাংলা গানের ধারায় সুমন ভিন্ন স্রোতের যাত্রী। নিজে লেখেন, সুর দেন, নিজেই বাজান ও গান। সুমন যে আলাদা, সেটি বুঝতে সংগীত-বোদ্ধা হতে হয় না।

১৯৯৪ সালের কথা। ততদিনে সুমনের জনপ্রিয়তার ঢেউ দেশের সীমানা পেরিয়েছে। এ রকম একটি সময়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের তহবিল সংগ্রহের জন্য সুমনের গানের অনুষ্ঠান করার কথা ভাবা হলো। তাঁকে বাংলাদেশে আনার ভার পড়ল আমার ওপর। যোগাযোগ হলো বন্ধু শিলুর মাধ্যমেই। সুমনের সঙ্গে প্রথম আলাপেই মুগ্ধ হলাম। সবচেয়ে বেশি মু্গ্ধ করল বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁর জানাশোনার পরিধি। তাঁর এই জানাশোনার একটা সূত্র ছিল জার্মানির ডয়চে ভেলে রেডিওর বাংলাদেশি সহকর্মীরা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সুমনের ধারণা ছিল পরিষ্কার। কবি শহীদ কাদরীর সঙ্গেও তাঁর সখ্য বহুদিনের।

তবু সুমন কি ঢাকায় এসে গাইতে রাজি হবেন? মনে মনে একটু অনিশ্চয়তা। কিন্তু সুমন এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন। জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে একটি গানের অনুষ্ঠান হলো। শেরাটনেও হলো আরেকটা। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের তহবিল সংগ্রহের সে অনুষ্ঠানে গাইবার জন্য সুমন কোনো অর্থ নিতেই রাজি হলেন না। এরপরও বহুবার সুমন ঢাকায় এসে গান করেছেন।

ঢাকাতে এসেই সেবার সুমন চলে গিয়েছিলেন সুফিয়া কামাল ও শামসুর রাহমানের সঙ্গে দেখা করতে। সুফিয়া কামাল তাঁকে ভীষণ মুগ্ধ করেছিলেন। তাঁকে নিয়ে সুমন পরে একটি গান লেখেন। সুমনের গানে এভাবে ছায়া ফেলেছেন বাংলাদেশের বহু মানুষ।

পরিবেশ পছন্দ না হলে সুমন একদমই গাইতে পারেন না। প্রথমবার গাইতে এসে সুমন উঠেছিলেন একটি অতিথিশালায়। আমাদের এক ধনী বন্ধু তাঁর গানের খুব অনুরাগী। শুরু থেকেই তিনি নাছোড়বান্দা, যে করে হোক সুমনকে তার বাসায় নিতেই হবে। সুমন যতই ‘না’ বলেন, বন্ধুটিও ততই চেপে ধরেন। এক পর্যায়ে সুমন রাজি হলেন। সেই ধনী বন্ধুর গুলশানের বাড়িতে দাওয়াত। বাড়ি মোটামুটি সরগরম। খাওয়া-দাওয়া চলছে। হঠাৎ দেখি সুমন নেই। নেই তো নেই। আমার কেমন যেন একটু সন্দেহ হলো। দ্রুত অতিথিশালায় গিয়ে দেখি, সুমন সেখানে আরাম করে ভাত খাচ্ছেন। বড়লোকি পরিবেশে তাঁর নাকি দম বন্ধ হয়ে আসছিল।

বাংলাদেশের প্রতি সুমনের প্রাণের টান ফিকে হয়ে যায়নি কখনো। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ থেকে ফেলানী-হত্যার বিচার—বাংলাদেশের বহু প্রসঙ্গ নিয়েই সুমন গান করেছেন। যেখানে অন্যায়, সেখানেই সুমনের প্রতিবাদ। রাজনীতিতে নাকি দলই সবার ওপরে। কিন্তু নিজের দলকেও সুমন রেহাই দেননি। মানুষ হিসেবে তিনি আগাগোড়া অসাম্প্রদায়িক। কিছুটা অস্থির, তবে ভীষণ সরল। তাঁর লেখালেখির হাত দারুণ। সিনেমায়ও অভিনয় করেছেন টুকটাক।

কলকাতায় গেলে নানা ব্যস্ততায় সুমনের সঙ্গে দেখা করার ফুরসত মেলে না। তবে ঢাকায় থাকলে ফোনে যোগাযোগ হয়। একবার ফোন ধরলে সে আলাপ আর ফুরাতে চায় না।

অনুলিখিত

আসাদুজ্জামান নূর: সাংসদ; অভিনেতা