করোনাকালের সুযোগ নিয়ে তিন গুণ ভাড়া আদায়

অ্যাম্বুলেন্স
ফাইল ছবি

মানবাধিকারকর্মী হিসেবে নুঝাত পারভীন চুয়াডাঙ্গার পরিচিত মুখ। অসুস্থ স্বামীকে ঢাকায় নিতে গিয়ে সেই মানুষও হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন, করোনাকালে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করতে গিয়ে মানুষ কতটা নিরুপায়।

নুঝাত সেদিন টানা ১৮ ঘণ্টার চেষ্টায় একটি অ্যাম্বুলেন্সের খোঁজ পান। কিন্তু চালক ভাড়া চেয়ে বসেন ২৫ হাজার টাকা। করোনা রোগী নন, জানানোর পরও ওই অ্যাম্বুলেন্সচালক ভাড়া এক টাকাও কমাতে রাজি হননি। শেষে বিকল্প উপায়ে জেলার বাইরের একটি অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করেন নুঝাত। ১৬ হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে স্বামীকে নিয়ে ঢাকায় যান তিনি।

একই ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে জেলা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি (পিপি) বেলাল হোসেনের। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, চুয়াডাঙ্গায় বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সগুলো সিন্ডিকেট করে ভাড়া বাড়িয়েছে। রোগীদের জিম্মি করে তারা বেশি ভাড়া আদায় করছে। নীতিমালা করে অ্যাম্বুলেন্সসেবা আইনের আওতায় আনতে না পারলে এই হয়রানি বন্ধ হবে না।

চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে দুটি ও তিনটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তিনটি সরকারি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। এই পাঁচটি সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের বাইরে ফায়ার সার্ভিস, বিজিবি এবং মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের একটি করে অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, সরকারি অ্যাম্বুলেন্সে চলাচলে প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া ১০ টাকা। ভাড়ার সঙ্গে সেতু ও ফেরিঘাটের টোল যোগ করা হয়। সে হিসাবে চুয়াডাঙ্গা থেকে রাজশাহীর (আসা-যাওয়া ৪৫০ কিলোমিটার ধরে) ভাড়া ৪ হাজার ৫০০ টাকা এবং লালন শাহ সেতুর টোল ২০০ টাকা। চুয়াডাঙ্গা থেকে ঢাকার (আসা-যাওয়া ৫৪০ কিলোমিটার ধরে) ভাড়া ৫ হাজার ৪০০ টাকা এবং পাটুরিয়া ফেরিঘাট ও কয়েকটি সেতুর টোল ২ হাজার ৪০০ টাকা। খুলনার ভাড়া ৩ হাজার ৭০০ এবং যশোর ও কুষ্টিয়ার ভাড়া ১ হাজার ৯৮০ টাকা আসে। আর জেলার মধ্যে দূরত্ব যত কিলোমিটার, সে অনুযায়ী ভাড়া আদায়ের নিয়ম রয়েছে।

তবে সরকারি হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সের সুবিধা সাধারণ মানুষ পায় না। আবার, ২০১৬ সাল থেকে সরকারি অ্যাম্বুলেন্স চুয়াডাঙ্গা থেকে ঢাকায় পাঠানো হয় না। এ অবস্থায় জেলায় মানুষকে জিম্মি করে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসা আগে থেকেই জমজমাট। করোনাকালে মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে সেই ব্যবসা এখন রমরমা।

সরকারি অ্যাম্বুলেন্স ভর্তুকি পায়; চালকের বেতন সরকার দেয়। এ কারণে ভাড়া কম নিতে পারে। এসব সুবিধা না থাকায় বেসরকারি খাতের অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া তুলনামূলক বেশি।
সাইদুর রহমান, বেসরকারি খাতের একটি অ্যাম্বুলেন্সের মালিক

ভুক্তভোগী ব্যক্তি, অ্যাম্বুলেন্সমালিক ও চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনাকাল শুরুর আগে চুয়াডাঙ্গা থেকে ঢাকায় বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া ছিল ১০ হাজার টাকার মতো। সেই ভাড়া এখন সাধারণ রোগীর ক্ষেত্রেও ২০-১৫ হাজার টাকায় উঠেছে। আর করোনা রোগী হলে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে সর্বোচ্চ ৩৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। অর্থাৎ স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে তিন গুণ বা তার বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। ঢাকার মতো অন্যান্য গন্তব্যেও অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া নিয়ে এই নৈরাজ্য চলছে। খুলনা ও রাজশাহীতে যেতে ১৩-১৫ হাজার এবং যশোর ও কুষ্টিয়ায় ৮-১০ হাজার টাকা আদায় করা হচ্ছে। জেলার ভেতরে দূরত্বভেদে নেওয়া হচ্ছে ২-৪ হাজার টাকা। রোগীর স্বজনেরা নিরুপায় হয়ে এই বাড়তি ভাড়া দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

অথচ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সগুলো মানহীন। সাইরেন, স্ট্রেচার ও অক্সিজেন সিলিন্ডার লাগিয়ে মাইক্রোবাসকে বানিয়ে ফেলা হচ্ছে অ্যাম্বুলেন্স। কথিত এসব অ্যাম্বুলেন্সে নেই জরুরি সেবাসামগ্রী। তা ছাড়া জরুরি সেবা দেওয়ার মতো প্রশিক্ষিত কেউ না থাকায় পথেই অনেক রোগীর মৃত্যু হচ্ছে।

এ বিষয়ে বেসরকারি খাতের একটি অ্যাম্বুলেন্সের মালিক সাইদুর রহমান বলেন, মানসম্মত একটি অ্যাম্বুলেন্সে ভেন্টিলেটর, অক্সিজেন, কার্ডিয়াক মনিটর, জরুরি ওষুধ ও অন্যান্য উপকরণসহ আইসিইউ সুবিধা থাকা জরুরি। সেগুলো পরিচালনায় অ্যাম্বুলেন্সে রাখতে হয় অভিজ্ঞ চিকিৎসক ও নার্স। এসব সুবিধা নিশ্চিত করতে হলে রোগী পরিবহনের ভাড়া আরও বেড়ে যাবে। তিনি বলেন, সরকারি অ্যাম্বুলেন্স ভর্তুকি পায়; চালকের বেতন সরকার দেয়। এ কারণে ভাড়া কম নিতে পারে। এসব সুবিধা না থাকায় বেসরকারি খাতের অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া তুলনামূলক বেশি।

রোগী ও স্বজনদের এই জিম্মিদশা থেকে মুক্তি দিতে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে। এ জন্য বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া নির্দিষ্ট করে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ এবং তা কঠোরভাবে তদারক করা প্রয়োজন।
মো. কামরুজ্জামান, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চুয়াডাঙ্গা শাখার সভাপতি

এদিকে চুয়াডাঙ্গায় বেসরকারি মালিকানায় বর্তমানে অন্তত ২০টি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। কিন্তু সড়ক পরিবহন আইনে ব্যক্তিমালিকানায় অ্যাম্বুলেন্সের নিবন্ধন নেওয়ার সুযোগ নেই। শুধু চিকিৎসাসেবা বা এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের নামে অ্যাম্বুলেন্সের নিবন্ধন দেয় বিআরটিএ। এ অবস্থায় জেলার বাইরের বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের নামে নিবন্ধন নিয়ে অনেকেই অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবসা করছেন। ফলে তাঁদের ধরার সুযোগটাও কম। সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়ার তালিকা থাকলেও বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সের বেলায় নেই। তাই খেয়ালখুশিমতো ভাড়া আদায় করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চুয়াডাঙ্গা শাখার সভাপতি মো. কামরুজ্জামান বলেন, সংকটকালে সিন্ডিকেট করে অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া বাড়ানো অমানবিক কাজ। রোগী ও স্বজনদের এই জিম্মিদশা থেকে মুক্তি দিতে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে। এ জন্য বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া নির্দিষ্ট করে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ এবং তা কঠোরভাবে তদারক করা প্রয়োজন।

চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) এ এস এম ফাতেহ আকরাম বলেন, শিগগিরই বিষয়টি নিয়ে জেলার জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করবেন তাঁরা। তাঁদের উপস্থিতিতে অ্যাম্বুলেন্সমালিক ও চালকদের ডেকে ন্যায্য ভাড়া নির্ধারণ করা হবে এবং তা বাস্তবায়নে তদারক করা হবে।