করোনাকালে আতঙ্কের সঙ্গে ছিল দুর্নীতি

  • করোনা মোকাবিলায় ৪০টির বেশি কমিটি করা হয়। এসব কমিটির কাজে সমন্বয় ও সহযোগিতার ঘাটতি ছিল।

  • হাসপাতালে সাধারণ ও আইসিউই শয্যা, জনবলের সংকট ছিল তীব্র।

নাগরিক সংগঠন বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ তাদের ২০২০–২১ সালের প্রতিবেদনে বলেছে, মহামারির শুরুতে ভুল তথ্য, গুজব, অতিরঞ্জিত ও মিথ্যা সংবাদ মানুষের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছিল। চিকিৎসাসামগ্রী সংগ্রহ ও রোগনির্ণয়ে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলো ছিল বিতর্কিত। রোগীর জন্য জিনিসপত্র সংগ্রহ, নমুনা পরীক্ষার কিট কেনা, কোভিড–১৯ হাসপাতাল স্থাপন থেকে শুরু করে সাধারণ ওষুধ কেনা পর্যন্ত নানা ক্ষেত্রে ছিল দুর্নীতি।

‘বাংলাদেশে কোভিড–১৯: প্রথম দুই বছর ও সামনের দিনগুলো’ শিরোনামের প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে প্রতিবেদনটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়।

ভুল তথ্য ও গুজব আতঙ্কের সৃষ্টি করেছিল। হাসপাতাল স্থাপন থেকে শুরু করে সাধারণ ওষুধ কেনা পর্যন্ত—নানা ক্ষেত্রে ছিল দুর্নীতি।

অনুষ্ঠানে বলা হয়, মহামারি মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকার ও অন্যান্য অংশীজনের গ্রহণকেরা ব্যবস্থা প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। গৃহীত ব্যবস্থার ভুলগুলো তুলে ধরা হয়েছে এবং ভুল থেকে কী শিক্ষা পাওয়া গেল, সে কথাও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। ভবিষ্যৎ মহামারি মোকাবিলায় স্বাস্থ্য খাত সংস্কারে করণীয় বিষয়ে প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে। মহামারির সময় দেশে–বিদেশে প্রকাশিত বিভিন্ন গবেষণার তথ্য সমন্বিত করে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।

প্রকাশনা অনুষ্ঠানের সভাপতি ও বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের উপদেষ্টা পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যাপক রওনক জাহান বলেন, বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের প্রতিবেদনগুলোতে যেসব সুপারিশ থাকে, বাস্তবে তার প্রতিফল দেখা যায় না। এ ক্ষেত্রে নজরদারি দরকার।

অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমাদের দেশে করোনাকালীন ব্যবস্থাপনা অনেক ভালো ছিল। করোনা আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে।’

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোভিড–১৯ বিষয়ে মানুষের ধারণা কম থাকায় ভুল তথ্য ও ধারণা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। বয়স্ক, নারী, শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা মানুষ এবং নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে কোভিড–১৯–এর ধারণা তুলনামূলকভাবে কম ছিল। সঠিক তথ্য বা জ্ঞান না থাকার কারণে অনেকের মধ্যে সচেতনতা কম ছিল। বস্তিবাসী ও যৌনকর্মীদের মধ্যে এমন দেখা গেছে। নিয়মনীতি মানার ক্ষেত্রে শহরের দরিদ্ররা কম গুরুত্ব দিয়েছেন। তবে তথ্য দিলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গুজব ছড়ানোর প্রধান উৎস ছিল।

স্বাস্থ্য বিভাগের হাতে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোভিড–১৯ মোকাবিলায় ৪০টির বেশি কমিটি করা হয় বিভিন্ন পর্যায়ে। কিন্তু এসব কমিটির কাজে সমন্বয় ও সহযোগিতার ঘাটতি ছিল। শুরুতে শুধু আইইডিসিআরে করোনা পরীক্ষা ও তিনটি সরকারি হাসপাতালে করোনার রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। হাসপাতালে সাধারণ ও আইসিউই শয্যা, জনবল, আইসোলেশন ইউনিট, পিপিই—এসবের সংকট ছিল তীব্র। মাত্র ৫০ শতাংশ হাসপাতালে কিছু আইসিইউ সুবিধা এবং ৬২ শতাংশ হাসপাতালে আইসোলেশন ইউনিট ছিল। অপার্যপ্ত প্রশিক্ষণ, কাজের চাপ, বিশ্রামের ঘাটতি, পরিবার থেকে দূরে থাকা—এসব বিষয় সম্মুখসারির স্বাস্থ্যকর্মীদের আশঙ্কাজনক পরিস্থিতির মুখে দাঁড় করায়।

৬৬ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে দুর্নীতি ও সুশাসনের বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি ছিল দৃশ্যমান। মহামারি স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতাগুলোর মুখোশ খুলে দেয়, পাশাপাশি নতুন দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি করে। পিপিই ও অন্যান্য সামগ্রী কেনাতে দুর্নীতি হয়েছে। কোভিড–১৯ পরীক্ষায় অনিয়ম হয়েছে ও পরীক্ষার জাল সনদ দেওয়া হয়েছে। দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য দেওয়া ত্রাণের ক্ষেত্রেএ
দুর্নীতি হয়েছে।

দেশে জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব তুলে ধরে আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, দেশে করোনা মোকাবিলার প্রস্তুতি ভালো ছিল এবং সে কারণে অন্যান্য উন্নত দেশের তুলনায় দেশে মৃত্যুহার কম ছিল।

স্বাগত বক্তব্যে বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের আহ্বায়ক ড. আহমেদ মোশতাক রাজা চৌধুরী বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতে মনোযোগ অনেক কম। তাই প্রতিবছর বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ কম দেখা যায়।’

আলোচনায় অংশ নিয়ে সরকারের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে–নজির আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের এই প্রতিবেদন ভালো তথ্যের উৎস হিসেবে কাজ করবে। জনস্বাস্থ্য নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের উপকারে আসবে।