করোনাকালে সহিংসতার শিকার ২৬% কিশোর-কিশোরী

রাজধানীর ব্র্যাক ইন সেন্টারে ‘কোভিড-১৯ প্রেক্ষাপটে কিশোরীদের ঝুঁকি ও পরিবর্তিত পরিস্থিতি’ শিরোনামে এক গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়
ছবি: প্রথম আলো

করোনাকালে ২৬ শতাংশ কিশোর-কিশোরী নানা ধরনের সহিংসতার শিকার হয়েছে। তাদের মধ্যে ছেলেরা শারীরিক সহিংসতা এবং মেয়েরা যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছে বেশি। কোভিডের সময়ে কিশোর-কিশোরীদের ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, তা থেকে এখনো তারা বের হতে পারেনি।

আজ বুধবার রাজধানীর ব্র্যাক ইন সেন্টারে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ‘কোভিড-১৯ প্রেক্ষাপটে কিশোরীদের ঝুঁকি ও পরিবর্তিত পরিস্থিতি’ শিরোনামে গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। ২০২১ সালের ৪ অক্টোবর থেকে ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত গাইবান্ধা, নড়াইল ও কুমিল্লার ২৬টি উপজেলার ২ হাজার ৭৫৮ পরিবারের ওপর এ গবেষণা চালানো হয়।

ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গর্ভন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং জিআইজেড বাংলাদেশ যৌথভাবে গবেষণাটি করে। এতে সহায়তা করেছে জার্মান সরকারের অর্থনৈতিক সহায়তা ও উন্নয়ন মন্ত্রণালয় এবং যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র, কমনওয়েলথ ও উন্নয়ন কার্যালয় (এফসিডিও)। কিশোর-কিশোরীদের ঝুঁকিগুলোকে শনাক্ত করে ভবিষ্যতে কোভিডের মতো পরিস্থিতি মোকাবিলায় করণীয় ঠিক করতে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোকে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার ওপর জোর দেন বক্তারা।

অনুষ্ঠানে বলা হয়, কোভিড-১৯ কিশোর-কিশোরীদের জীবনে কীভাবে পরিবর্তন এনেছে, তা বিশ্লেষণ করা ও ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে এ দেশের নারী ও কিশোরীদের অবস্থা কেমন, বিশ্লেষণের মাধ্যমে তা বোঝার জন্য এ গবেষণা করা হয়। জরিপে অংশ নেয় ৩ হাজার ১৩৯ কিশোর-কিশোরী। এর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ মেয়ে। কোভিড-১৯–এর বড় প্রভাব পড়েছে পরিবারগুলোর আয়, জীবনযাত্রা ও সঞ্চয়ের ওপর। খাদ্যাভাবও ছিল। এর মধ্যে গাইবান্ধার নারীদের ওপর প্রভাব বেশি পড়েছে। বিধিনিষেধে প্রায় ২৯ শতাংশ নারী অন্তত এক বেলা খাওয়া বাদ দিয়েছিলেন।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, কম বয়সী কিশোর-কিশোরীরা তুলনামূলক বেশি সহিংসতার শিকার হয়েছে। ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সীদের ২৭ শতাংশ এবং ১৫ বছরের বেশি বয়সীদের ২৩ শতাংশ সহিংসতার শিকার হয়েছে।

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ইমরান মতিন। গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন বিআইজিডির জ্যেষ্ঠ ফেলো অব প্র্যাকটিস মাহীন সুলতান, সংস্থার গবেষণা ফেলো লপিতা হক এবং জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী মো. রাইদ আরমান।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে আইন ও বিচার বিভাগের সচিব মো. গোলাম সারওয়ার বলেন, সংকট উত্তরণে সরকার, উন্নয়ন অংশীদার এবং সুশীল সমাজকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। লিঙ্গ ও আর্থসামাজিক অবস্থানির্বিশেষে ন্যায়বিচার প্রাপ্তিকে মানবিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে আইন ও বিচার বিভাগের যুগ্ম সচিব উম্মে কুলসুম বলেন, কোভিড থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে লৈঙ্গিক সমতা এবং নারী ক্ষমতায়নের কাঠামোকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। এ গবেষণায় নারী ও কিশোরীদের যেসব সমস্যা উঠে এসেছে, তা মোকাবিলায় এই কাঠামো বড় ভূমিকা রাখবে।

গবেষণায় বলা হয়, কিশোর-কিশোরীদের লেখাপড়ায় কোভিড-১৯–এর প্রভাব পড়েছে। কোভিডের আগে ৩৫ শতাংশ কিশোর-কিশোরী ৩ থেকে ৫ ঘণ্টা করে পড়ত। কোভিডে পড়ালেখার হার ১৪ শতাংশ কমে যায়। ৩১ শতাংশ স্কুল থেকে ঝরে পড়ে। তাদের ৩৫ শতাংশ জানিয়েছে, কোভিডের কারণে তাদের আর পড়ার আগ্রহ নেই। আর ১৬ শতাংশ বলেছে, তাদের পড়ালেখা চালানোর সামর্থ্য নেই। স্কুল বন্ধের সময় টেলিভিশন ও মুঠোফোনে পাঠদান চলেছে। তবে মেয়েরা প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে পারে, সেই আশঙ্কায় তাদের হাতে মুঠোফোন দেওয়া থেকে বিরত থেকেছিল পরিবারগুলো।

অল্পসংখ্যক নমুনা নিয়ে বাল্যবিবাহের বিষয়টি দেখা হয়েছিল। এতে দেখা গেছে, মহামারির আগে ও পরে ছেলেমেয়েদের বাল্যবিবাহের হারে ব্যবধান খুব সামান্য। ৫০ শতাংশ অভিভাবক জানিয়েছেন, কোভিডে কমবেশি প্রভাবিত হয়ে তাঁরা মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন।

অনেক কিশোর-কিশোরী আইনি সহায়তা পাওয়ার বিষয়টি জানে। তারা জানে, সমস্যায় পড়লে কোথায় এবং কার কাছে যেতে হবে। কিন্তু সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা ছিল। ৮০ শতাংশ কিশোর-কিশোরী জানিয়েছে, ন্যায়বিচার পাওয়ার সম্ভাবনার ক্ষেত্রে কোভিডের আগের যে অবস্থা ছিল, তা–ই বহাল আছে। প্রতিকার পাওয়ার বিষয়ে তারা প্রথমেই এলাকার বড়দের কাছে যেতে আগ্রহী। অন্তত ১৬ শতাংশ বড়দের কাছে সহায়তা চেয়েছে।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন সমাজসেবা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি) এম এম মাহমুদুল্লাহ, ঢাকায় অবস্থিত ব্রিটিশ হাইকমিশনের ডেপুটি হাইকমিশনার জাভেদ প্যাটেল, জার্মান দূতাবাসের উন্নয়ন সহযোগিতা বিভাগের উপপ্রধান ক্যারেন ব্লুম, জিআইজেডের এদেশীয় পরিচালক অ্যাঙ্গেলিকা ফ্লেডারমান, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম, ব্র্যাকের সাবেক পরিচালক (শিক্ষা) শফিকুল ইসলাম এবং টেরে দেস হোমসের (টিডিএইচ) ক্ল্যারিসার এদেশীয় সমন্বয়কারী জিনিয়া আফরোজ।