করোনায় মৃতদের শেষ বিদায়ে পাশে থাকেন ট্রান্সজেন্ডার সঞ্জীবনী

করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের দাফন, সৎকারে থাকেন সঞ্জীবনী ও তাঁর দলের সদস্যরা
ছবি: সংগৃহীত

জীবনের বেশির ভাগ সময়ই মানুষের কাছ থেকে বিরূপ আচরণ পেয়েছেন সঞ্জীবনী। তাঁর আরেক নাম সজীব সতেজ। এরও আগে তাঁর নাম ছিল আশিকুল ইসলাম। গত বছরের মে মাস থেকে সঞ্জীবনী যে কাজ করছেন, সে কাজে তিনি সম্মান পাচ্ছেন। মানুষের ভালোবাসা পাচ্ছেন।

সঞ্জীবনী একজন ট্রান্সজেন্ডার বা লিঙ্গরূপান্তরিত নারী। তিনি গত বছরের মে মাস থেকে করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের লাশের দাফন-কাফন বা ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির সৎকারের দায়িত্ব পালন করছেন। দলনেতা হিসেবেই তিনি কাজটি করছেন। মৃত ব্যক্তির স্বজন থাকলে তাঁদের সঙ্গে কথা বলাসহ পুরো কাজের সমন্বয় তিনিই করছেন। দলের সদস্য হিসেবে লাশের গোসল, দাফনসহ অন্যান্য কাজেও হাত লাগাতে হয়।

সঞ্জীবনী কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন পরিচালিত বান্দরবানের লামায় স্কুলের একজন নাচের শিক্ষক। নিজে আগ্রহ করে করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের লাশ সৎকারে এগিয়ে এসেছেন। চট্টগ্রামে কিছুদিন কাজ করার পর থেকে তিনি ঢাকায় কাজ করছেন। রাজধানীর সেগুনবাগিচায় কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের ক্যাম্পে থেকে কাজ করছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে কোথায় করোনায় রোগী মারা গেছেন, সে তথ্য পেয়ে সঞ্জীবনী তাঁর দলের সদস্যদের নিয়ে হাসপাতালে যান। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের শুরুতে মৃত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজন লাশের কাছে যেতে ভয় পেতেন। তাই লাশের শেষ বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতার পুরো কাজটিই করতে হতো সঞ্জীবনী ও তাঁর দলের সদস্যদের।

সঞ্জীবনী বলেন, গত বছরের তুলনায় বর্তমানে পরিস্থিতি অনেক পাল্টেছে। বর্তমানে লাশের কাছে আসতে চান না, এমন স্বজনদের সংখ্যা কম। করোনায় মারা গেলে চারপাশে মানুষের মধ্যে যে আতঙ্ক ছিল, তা-ও অনেক কমেছে।

টাঙ্গাইলের সঞ্জীবনী ছোটবেলা থেকেই নাচ শেখেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স ও মাস্টার্স করে তিনি কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে নাচের শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। নাচের শিক্ষক হিসেবে যে বেতন পেতেন, তা-ই পাচ্ছেন তিনি। আর লাশ দাফন-কাফনের কাজটি করছেন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে।

সঞ্জীবনী বলেন, তিনি মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান—এই চারটি ধর্মে মৃতের শেষ বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতায় কী কী মানতে হয়, তা শিখেছেন। মৃতের ধর্মীয় পরিচয় অনুযায়ী কখনো লাশ নিয়ে যাচ্ছেন কবরস্থানে, কখনো যাচ্ছেন শ্মশানে। তিনি বলেন, কখন কে মারা যাবেন বা কখন ডাক পড়বে, তার কোনো ঠিক নেই। তাই সেই অর্থে তাঁর কোনো অবসর নেই। সব সময়ই প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হয়। সুরক্ষিত পোশাক পিপিসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনেই কাজগুলো করতে হয়।

সঞ্জীবনী
ছবি: সংগৃহীত

সঞ্জীবনী নিজেকে নারী মনে করলেও বর্তমানে তিনি পুরুষ দলের দলনেতা হিসেবে কাজ করছেন। পুরুষদের লাশ দাফন-কাফনে সহায়তা করছেন। তিনি বলেন, এ দলে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট ড্রেস কোড আছে। তিনি বলেন, এ কাজ করতে গিয়ে মৃতের স্বজন বা অন্য মানুষদের কাছ থেকে কোনো বিরূপ মন্তব্য শুনতে হচ্ছে না। কাজ করতে তেমন কোনো প্রতিবন্ধকতাও নেই। ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে কর্মীদের সুস্থ থাকার বিষয়টিতে সর্বোচ্চ নজর দেওয়া হচ্ছে।

সঞ্জীবনী বলেন, এইচএসসি পড়া পর্যন্ত পরিবারের সঙ্গেই ছিলেন। কিন্তু মানুষ যে শুধু তাঁর সঙ্গেই খারাপ ব্যবহার করত তা তো নয়, সুযোগ পেলেই তাঁর পরিবারের সদস্যদের খারাপ কথা শুনিয়ে দিত। নানাভাবে নাজেহাল করত। একসময় বাধ্য হয়ে তিনি বাড়ি ছাড়েন। সে-ও প্রায় আট বছর হয়ে গেল। একমাত্র বোন বা পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়, পড়াশোনার জন্য আর্থিক সহায়তাও পেয়েছেন। শুধু তিনি বাড়ি ফিরতে পারেন না। কারও সঙ্গে দেখা করতে পারেন না।

সঞ্জীবনী লাশ দাফন-কাফনের যে কাজটি করার সুযোগ পেয়েছেন, তাকে সৌভাগ্য হিসেবেই মনে করছেন। ট্রান্সজেন্ডার নারী হয়েও তিনি যে এক বছর ধরে কাজটি করতে পারছেন, তার জন্য সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এ পর্যন্ত কতটি লাশের শেষ বিদায়ে সহায়তা করতে পারলাম, সে সংখ্যা বা হিসাবটি আমার কাছে আছে। তবে আমার কাছে সংখ্যার চেয়েও কাজটি সব থেকে বড়। মমতার স্পর্শে শেষ বিদায় দিতে চাই সবাইকে।’

কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের দাফন সেবা কার্যক্রমের ইনচার্জ খন্দকার সজীবুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সঞ্জীবনী আমাদের ফাউন্ডেশনের লামায় ছিন্নমূল শিশুদের স্কুলের নাচের শিক্ষক। তিনি বর্তমানে ঢাকায় করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তির লাশের দাফন বা সৎকার কার্যক্রমের একটি দলের সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। পাঁচজনের দলের তিনিও একজন সদস্য। তাই তাঁকেও লাশের গোসল বা অন্যান্য কাজে সহায়তা করতে হয়। এ কাজ করতে গিয়ে কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়নি। সবাই সহযোগিতা করছেন। করোনায় কেউ মারা গেলে যখন কোনো স্বজন কাছে আসতে ভয় পেতেন, সেই তখন থেকেই সঞ্জীবনীসহ ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবকেরা দায়িত্বটি পালন করে যাচ্ছেন।