কর্মসূচি ঘোষণা করে বিএনপি পালন করে জামায়াত-শিবির
‘একতরফা’ নির্বাচনের তফসিল স্থগিত ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ১৮-দলীয় জোটের চতুর্থ দফায় ৭২ ঘণ্টার টানা অবরোধ কর্মসূচি চলছে। বরাবরের মতো এবারও জোটের প্রধান দল বিএনপি কর্মসূচি ঘোষণা করেছে, কিন্তু মাঠে নামেনি। তবে জোটের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল জামায়াতে ইসলামী বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, ককটেল বিস্ফোরণ, রেললাইন তুলে ফেলাসহ নাশকতামূলক তৎপরতায় সক্রিয় রয়েছে।
কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে দৌড়াঝাঁপ, গুলশান কার্যালয়ে সংবাদ ব্রিফিং বাদ দিলে রাজধানীতে বিএনপির নেতাদের আর কোনো তৎপরতা দেখা যায় না। নিজেদের দাবির সপক্ষে সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা তো দূরের কথা, খোদ রাজধানীতেই বিএনপির নেতা-কর্মীদের বারবার তাগাদা দিয়েও মাঠে নামাতে পারেননি খালেদা জিয়া।
আন্দোলনের মাঠে বিএনপির এই অনুপস্থিতির কথা স্বীকার করেছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানও। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সরকার বিএনপিকে কোনো কর্মসূচিই পালন করতে দেয় না, পাখির মতো গুলি করে মানুষ হত্যা করে। এসব কারণে নেতা-কর্মীদের উপস্থিতি কম দেখা যায়। এ ছাড়া বেশ কয়েকজন নেতা কারাগারে আছেন। বাকি নেতাদের অনেককেই পুলিশের ধরপাকড়ের মুখে আত্মগোপনে থাকতে হচ্ছে।
এসব অজুহাত দেখিয়ে বিএনপির নেতারা না নামলেও তাঁদের প্রধান মিত্র জামায়াতের নেতা-কর্মীরা বসে নেই। তাঁরা যখন যেখানেই সুযোগ পাচ্ছেন, সহিংস কার্যক্রম চালাচ্ছেন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, জোটগত কর্মসূচিতে থাকলেও জামায়াতের আন্দোলনের মূল হচ্ছে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ও সাজাপ্রাপ্ত দলীয় নেতাদের রক্ষা করা। এ জন্য তারা মরিয়া হয়ে মাঠে থাকে।০
এ প্রসঙ্গে নজরুল ইসলাম খান বলেন, নির্দলীয় সরকারের দাবিতে চলমান আন্দোলনে ১৮-দলের শরিক হিসেবে জামায়াতও কর্মসূচি পালন করছে। তাঁর দাবি, এটা এখন আর ১৮ দলের নয়, সারা দেশের মানুষের আন্দোলনে পরিণত হয়েছে।
ঢাকার তৎপরতা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে: আন্দোলনে বিএনপির সবচেয়ে খারাপ অবস্থা রাজধানী ঢাকায়। বিএনপি এবং এর ১১টি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কেন্দ্রীয় প্রায় সব নেতাই থাকেন ঢাকায়। এর বাইরে রয়েছে মহানগর কমিটি, ৪১ থানা ও ৯০টি ওয়ার্ড কমিটি। এসব কমিটির হিসাব করলে শুধু নেতার সংখ্যাই হবে ১০ হাজারের অধিক। এই নেতাদের সক্রিয় করে মাঠে নামাতে গত মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ঢাকাকে আটটি অঞ্চলে ভাগ করে প্রতিটি অঞ্চলের জন্য একজন করে কেন্দ্রীয় নেতাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাঁরা হলেন নজরুল ইসলাম খান, আ স ম হান্নান শাহ, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, সাদেক হোসেন খোকা, আমান উল্লাহ আমান, বরকতউল্লা ও সালাহ উদ্দিন আহমেদ।
অবশ্য দায়িত্ব পাওয়ার কয়েক দিন পর স্থায়ী কমিটির সদস্য হান্নান শাহ ও সাদেক হোসেন খোকাকে গ্রেপ্তার করা হয়। বাকি নেতাদের কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। চলমান অবরোধ কর্মসূচির গত দুই দিনে রাজধানীর কোথাও বিএনপির নেতা-কর্মীদের অবস্থান চোখে পড়েনি।
তবে প্রতিদিন বিকেলে মহানগর বিএনপির পক্ষ থেকে সংবাদমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়। তাতে ঢাকায় ২০ থেকে ২৫টি থানায় অবরোধের সমর্থনে বিএনপি মিছিল করেছে বলে দাবি করা হয়। কিন্তু অবরোধ চলাকালে গণমাধ্যমের কর্মীরা এমন কোনো মিছিল খুঁজে পান না।
অবশ্য ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্যসচিব আবদুস সালাম প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ঢাকায় পুলিশ খুব তৎপর, সরকারের মনোযোগও বেশি। এ জন্য নেতা-কর্মীরা সেভাবে রাজপথে থাকতে পারছেন না।
কূটনীতিকপাড়ায় দৌড়ঝাঁপ: রাজপথের আন্দোলনে না থাকলেও বিএনপির শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতা বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে ধরনা দিয়ে যাচ্ছেন। বিএনপির নেতাদের অনেকে মনে করেন, মাঠের আন্দোলনে সরকারকে খুব একটা চাপে ফেলা যাবে না। আন্তর্জাতিক অঙনে সরকারকে একা করে ফেলতে পারলে ক্ষমতাসীনেরা চাপে পড়বে।
বিএনপির নেতাদের মধ্যে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল, স্থায়ী কমিটির সদস্য আব্দুল মঈন খান, খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী, দলীয় চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ওসমান ফারুক ও সাবিহউদ্দিন আহমেদ কূটনীতিকপাড়ায় বেশি সক্রিয়।
জানতে চাইলে ওসমান ফারুক বলেন, কূটনীতিকদের বিভিন্ন সময়ে দলের অবস্থান সম্পর্কে জানানো হয়। এটা রাজনীতিরই অংশ।
দলটির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য দাবি করেন, বিএনপির এই দৌড়ঝাঁপ কাজে এসেছে। এখন ভারত ছাড়া প্রভাবশালী বাকি দেশগুলো সরকারের একগুঁয়ে আচরণ পছন্দ করছে না।
বিএনপির ‘ঘাঁটিতেও’ জামায়াত: বগুড়া, ফেনী, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, রাজশাহীকে বিএনপির ‘ঘাঁটি’ বলে মনে করেন দলটির নেতারা। কিন্তু এসব এলাকায়ও মাঠের আন্দোলনে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সেভাবে দেখা যায় না। বেশির ভাগ স্থানেই জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরাই সক্রিয় থাকেন, সহিংস ঘটনা ঘটান। জামায়াতের নাশকতার কারণে এই এলাকাগুলোতে বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে।
বগুড়া জেলা বিএনপির একজন নেতা বলেন, জামায়াতের নাশকতার ঘটনায় বগুড়ার বিভিন্ন থানায় গত এক মাসে অন্তত ২৫টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় বিএনপির নেতাদেরও আসামি করা হচ্ছে। এখন মামলার কারণে তাঁদের আত্মগোপনে থাকছে হচ্ছে।
বগুড়া শহরে এর আগে হরতাল-অবরোধে বিএনপি বড় ধরনের মিছিল বের করত। তারা সাতমাথা মোড়ে সমাবেশও করত। কিন্তু এবারের অবরোধ কর্মসূচির প্রথম দুই দিনে বগুড়ায় বিএনপিকে মাঠে দেখা যায়নি।
এর বাইরে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা ও মেহেরপুরে বিএনপি মিছিল-সমাবেশ করে থাকে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে বিএনপির দুটি গ্রুপ থাকায় উভয় পক্ষ কেন্দ্রের কাছে নিজেদের সক্রিয় ভূমিকা দেখাতে প্রতিযোগিতা করে বড় মিছিল বের করে থাকে।
ফেনীর সবগুলো এবং নোয়াখালীর বেশির ভাগ আসনেই বিএনপির সাংসদ রয়েছেন। কিন্তু রাজপথে বিএনপির তৎপরতা নেই বললেই চলে। বরং এ দুটি জেলায় সম্প্রতি পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষসহ সহিসংতা চালিয়ে আলোচনায় আসে জামায়াত-শিবির।