কসরত যতই করেন, হাতের লেখা নকল করলেই ধরা

১০ বছরের সংসারজীবনে লাখ দশেক টাকার দুটো স্থায়ী আমানত হিসাব খুলেছিলেন স্ত্রী। স্বামীর সঙ্গে বিরোধ চরমে ওঠায় বাপের বাড়ি গিয়ে ওঠেন তিনি। হঠাৎ একদিন ব্যাংকে গিয়ে শোনেন, তাঁর স্থায়ী আমানত নেই। তিনি নিজেই নাকি ওগুলো ভাঙিয়েছেন।

খোয়া যাওয়া টাকা উদ্ধারে স্ত্রী ২০১৯ সালের মে মাসে ঢাকার বনানী থানায় মামলা করেন। বনানী থানা এই মামলার তদন্তে সিআইডির হস্তলিপিবিশারদের সাহায্য নেন। ভুক্তভোগী নারীর হাতের লেখা, স্থায়ী আমানত হিসাব খোলা ও ভেঙে ফেলার সময়ের লেখা সব পরীক্ষা করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) জানায়, দুটো লেখা দুজনের। কোনো মিল নেই।

কথা হচ্ছিল সিআইডির হস্তলিপিবিশারদ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সৈয়দ শওকত হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, জালজালিয়াতির ইচ্ছা নিয়ে অন্যের হাতের লেখা নকল করার এমন চেষ্টা অনেকে করেন। কিন্তু পৃথিবীতে একজনের আঙুলের ছাপ যেমন অন্যজনের সঙ্গে মেলে না, হাতের লেখাটাও সে রকমই। কারও সঙ্গে কারও মেলে না। অনেকের সই খুব সরল। দেখে প্রলুব্ধ হয়ে কেউ নকল করার চেষ্টা করতে পারেন।

কিন্তু হস্তলিপিবিশারদের কাছে গেলে জালজালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়বেই।

জাল স্বাক্ষর, অক্ষর বা সংখ্যার ঘষামাজা, বয়স ও তারিখ নিয়ে ঝামেলা, অজ্ঞাতনামা কারও লেখা বা বিতর্কিত চিঠি, নিবন্ধন নম্বরসহ অন্যান্য লেখা, বাণিজ্যিক ও আইনি চিঠিপত্র, চেক, নোট, রিসিট, ড্রাফট, অ্যাসাইনমেন্ট, দানপত্র, সই আছে এমন নথিপত্র পরীক্ষায় নিয়মিত হস্তলিপিবিশারদদের ডাক পড়ে। যদিও বিশেষায়িত এ জ্ঞান আছে এমন কর্মকর্তার সংখ্যা ১৫ জনের মতো।

খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, সিআইডিতে এখন হস্তলেখাবিষয়ক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি আরও বেশ কিছু বিষয়ের প্রশিক্ষণ চালু আছে। যেমন ফরেনসিক ফটোগ্রাফি, ফরেনসিক ব্যালাস্টিক, আঙুলের ছাপ, জাল নোট ও মেকি মুদ্রা শনাক্ত করা, ফরেনসিক অণু বিশ্লেষণ, পায়ের ছাপ, ফরেনসিক-রাসায়নিক, ক্রাইম সিন ম্যানেজমেন্ট, মৌলিক কম্পিউটার কোর্স এবং জাল জালিয়াতি মামলার তদন্ত পদ্ধতি প্রশিক্ষণ কোর্স।

তবে হাতের লেখা দেখে অপরাধী শনাক্তের কাজটিই সবচেয়ে পুরোনো। এটা প্রাসঙ্গিকতাও হারায়নি। জানা গেছে, চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে তাঁদের মন্তব্য চাওয়া হয়েছে প্রায় আট শ মামলায়।

যেমন প্রতিবেদনের শুরুতে বনানীর যে মামলার উল্লেখ করা হয়, সেই মামলায় পুলিশ অভিযোগপত্র দিয়েছে। হস্তলিপিবিশারদদের মন্তব্যের ওপর ভিত্তি করে পুলিশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের জেরা করে। তারা জানতে পারে, ভুক্তভোগী নারীর বাবা সাবেক অতিরিক্ত সচিব, শ্বশুর সাবেক যুগ্ম সচিব। আর স্বামী পেশায় প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা।

স্বামীই একদিন ব্যাংকে গিয়ে জানান, তাঁর স্ত্রী স্থায়ী আমানত হিসেবে থাকা টাকাটা তুলে নিতে চান। ব্যাংক প্রতিনিধি যেন তাঁর (স্বামী) কাছে গিয়ে কাজটা শেষ করেন। ব্যাংকের প্রতিনিধি ওই ব্যক্তির সঙ্গে রেস্তোরাঁয় বসে দুটি স্থায়ী আমানত ভাঙানোর সব কাজ সারেন। একই সময়ে নিজের নামে একটি হিসাব খোলার জন্য ফরম ও কাগজপত্রও তিনি পূরণ করেন। পরে তাঁর (স্বামীর) হিসাবে গিয়ে জমা হয় ভুক্তভোগী নারীর টাকা।

হস্তলিপিবিশারদ এ ঘটনায় ঠিক কী কী বিষয়ে অমিল পেয়েছিলেন? প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, ‘দুটি লেখার সাধারণ ও ব্যক্তিগত দুধরনের বৈশিষ্ট্যেই অমিল পাওয়া যায়। সাধারণ বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে মুভমেন্ট, স্পিড, স্কিল, লাইন কোয়ালিটি, অ্যালাইনমেন্ট, পেন প্রেশার, স্পেসিং, কার্ভস, লুপস, স্ল্যান্ট, রিদম ইত্যাদির অমিল রয়েছে। ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে স্ট্রোকসের গঠন বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতি, এদের সূচনা, সংযোগ, অবস্থান, সমাপ্তি ইত্যাদিসহ সম্পাদনরীতির অমিল আছে।’

এত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পরিবর্তন অবশ্য খালি চোখে ধরা পড়েনি। পদ্ধতিটি প্রাচীন। এখনো হস্তলিপিবিশারদরা এক শ বছরের পুরোনো আলবার্ট এস অসবর্নের লেখা বই অনুসরণ করেন। তবে এ প্রক্রিয়ায় এখন অত্যাধুনিক সব যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হচ্ছে হাতের লেখা দেখে অপরাধী শনাক্তের কাজে।

কবে থেকে শুরু

ব্রিটিশ ইনস্টিটিউট অব গ্রফোলজিস্টসের তথ্য অনুযায়ী, হাতের লেখা যে অপরাধ তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম, সে বিষয়টি প্রথম আলোচিত হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব পাঁচ শতকে। চীনের দার্শনিক কনফুসিয়াস হাতের লেখা দেখে মানুষ চেনা যায় এমন কথা বলেছিলেন। আধুনিক হস্তলিপিবিদ্যার চর্চা শুরু হয় ইতালিতে। পরবর্তীতে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, চীন, ভারত ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এ চর্চা শুরু হয়।

হাতের লেখা দেখে অপরাধী শনাক্তের ইতিহাসে আমেরিকার একটি ঘটনা ব্যাপক আলোড়ন তোলে। ১৯০০ সালের ওই মামলাটি পিপল অব নিউইয়র্ক সিটি বনাম আরবি মোলিনো নামে পরিচিত।

চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াস হাতের লেখা দেখে মানুষ চেনা যায় এমন কথা বলেছিলেন
ছবি: সংগৃহীত

১৮৯৮ সালের ২৪ ডিসেম্বর অজ্ঞাতনামা একজন প্রেরক উপহার পাঠিয়েছিলেন নিকারবকার অ্যাথলেটিকস ক্লাবের অন্যতম পরিচালক হ্যারি কর্নিশকে। উপহারের সেই নীলরঙা বাক্স খুলে হ্যারি কর্নিশ রুপোর দানিতে আঁটা ব্রোমো সেল্টজারের একটা বোতল পান। সে সময় ব্রোমো সেল্টজার পেটব্যথা, বুকজ্বলা, মাথাব্যথার ওষুধ হিসেবে বেশ চলত। পরদিন বাড়িওয়ালি ক্যাথেরিন অ্যাডামসকে অসুস্থ দেখে হ্যারি কর্নিশ সেই বোতলটাই এগিয়ে দেন। কিন্তু ওষুধটা পেটে যেতে না যেতেই তিনি মারা যান।

চিকিৎসকেরা পরে ক্যাথেরিন অ্যাডামসের ময়নাতদন্ত করে জানতে পারেন, ব্রোমো সেল্টজারের বোতলে সায়ানাইড মারকারি ছিল, ওষুধ ছিল না। ওতেই মৃত্যু হয়েছে তাঁর। মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পান ডিটেকটিভ সার্জেন্ট আর্থার এ ক্যারি। ক্লু হিসেবে তাঁর হাতে ছিল নীল রঙের বাক্সটা, যার গায়ে লেখা মিস্টার হ্যারি কর্নিশ, নিকারবকার অ্যাথলেটিকস ক্লাব, ম্যাডিসন অ্যাভিনিউ, অ্যান্ড ফর্টি ফিফথ স্ট্রিট, নিউইয়র্ক সিটি। ফর্টি বানানটা আবার ভুল করে ইংরেজিতে ফোরটি লেখা।

পিপল অব নিউইয়র্ক সিটি বনাম আর ডি মোলিনো মামলা নিয়ে পত্রিকায় ছাপা প্রতিবেদনে ব্যবহৃত হয়েছিল ছবিটি
সূত্র: লাইব্রেরি অব কংগ্রেস

রহস্যজনক এ মৃত্যুর ঘটনা এবং পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ খবরের কাগজের পাতায় বড় বড় করে নিয়মিত ছাপা হতে শুরু করে। এর মধ্যেই নিকারবকার অ্যাথলেটিকস ক্লাবের লোকজনের কাছে হাতের লেখাটা চেনা চেনা ঠেকে ক্লাবের সদস্য মোলিনো বেশ কিছুদিন ধরে বকাঝকা করে চিঠি পাঠাচ্ছিলেন। সংবাদমাধ্যমগুলো ক্লাবের এ সন্দেহের খবর প্রচার করে দেয়। কিন্তু শুধু এটুকু তথ্যের ওপর মোলিনোকে গ্রেপ্তার করা ঠিক হবে না বলে মনে করেন আর্থার এ ক্যারি।

কিছু সময় পর মোলিনোর স্ত্রী ব্লঁশের আগের স্বামীর মৃত্যু প্রসঙ্গ নিয়ে সংবাদপত্রে প্রতিবেদন ছাপা হয়। তদন্ত কর্মকর্তারা জানতে পারেন ব্লঁশের স্বামীর মৃত্যুও হয়েছিল সায়ানাইড মার্কারিতে।

সায়ানাইড মার্কারি কী কাজে লাগে, কে কোথা থেকে কিনছেন এবার সেই তথ্য অনুসন্ধানে নামেন সার্জেন্ট আর্থার এ ক্যারি। তিনি জানতে পারেন কাপড়ে রং করায় এ ধরনের রাসায়নিক ব্যবহৃত হয়। মোলিনো যেই কারখানার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তার কাছেই একটি পোস্ট বক্সও খুঁজে পান তদন্ত কর্মকর্তা। তার ভেতরে তখনো সায়ানাইড মার্কারি চেয়ে কোনো এক বিক্রেতার কাছে লেখা দুটি চিঠি। আর চিঠিতে প্রাপক হিসেবে হ্যারি কর্নিশের নাম লেখা।

এ পর্যায়ে কাহিনিতে যুক্ত হন হস্তলেখাবিশারদেরা। তাঁরা হ্যারি কর্নিশের কাছে থাকা নীলরঙা বাক্স, নিকারবকার ক্লাবে পাঠানো চিঠি, পোস্ট বক্সে থাকা চিঠি নিয়ে বসেন। দেখা গেল হাতের লেখা এক, আর সব কটিতে ফর্টি বানান লেখা হয়েছে ভুল বানানে।

পরে জানা যায় নিকারবকার ক্লাবে ভারোত্তোলন প্রতিযোগিতায় হ্যারি কর্নিশের কাছে হেরে গিয়েছিলেন মোলিনো। তখন থেকেই তিনি তক্কেতক্কে ছিলেন। আর ব্লঁশেকে তিনি ভালোবাসলেও ব্লঁশে কেন তাঁর বন্ধুকে বিয়ে করলেন এ নিয়ে জেদ চেপে গিয়েছিল। তাঁকে সরিয়ে দিতে ওই একই কৌশল খাটিয়েছিলেন। দুটি ঘটনার মধ্যে সময়ের ব্যবধান ছিল মাত্র এক মাস।

খুনের ঘটনায় হস্তলিপি ক্লু হিসেবে ব্যবহারের নজির আছে গোটা দুনিয়াতেই। সৈয়দ শওকত হোসেন বলছিলেন, একটি হত্যাকাণ্ডের ক্রাইম সিনে রক্তে ভেসে যাওয়া চেক পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল। ওই চেকে একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা এক ব্যক্তিকে শোধ করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন ব্যাংক হিসাবের মালিক। কিন্তু সই করে যেতে পারেননি, তার আগেই তিনি খুন হন। যে ব্যক্তির নাম চেকে লেখা ছিল, হত্যাকাণ্ডের তদন্তে পরে তাঁর সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়।

আত্মহত্যা না হত্যা তা নির্ধারণেও হাতের লেখা পরীক্ষা করে দেখা হয়। ২০১৯ সালে ঢাকার উত্তরখানের ময়নারটেকে একটি বাসার দরজা ভেঙে তিনজনের লাশ উদ্ধার করেছিল পুলিশ। মা জাহানারা বেগম মুক্তা (৪৮) ও তাঁর প্রতিবন্ধী মেয়ে আতিয়া সুলতানা মিমের (১৯) মৃতদেহ উদ্ধার হয় বিছানা থেকে। শ্বাসরোধে তাঁদের মৃত্যু হয় বলে জানা যায়। একই সময়ে মেঝেতে পড়ে ছিল ছেলে মহিব হাসান রশ্মির (২৭) লাশ। তাঁর গলায় ধারালো অস্ত্রের পোঁচ।

চিরকুট পাওয়া গিয়েছিল সালমান শাহর মৃতদেহের কাছে

হত্যা না আত্মহত্যা এমন দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ একটা চিরকুট উদ্ধার করে। হস্তলিপিবিশারদের সহযোগিতায় সে সময় ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) সিদ্ধান্ত পৌঁছায় লেখাটি মহিবের। সেখানেই লেখা ছিল আত্মহত্যার কথা।

জনপ্রিয় নায়ক সালমান শাহর মৃতদেহের পাশেও হাতে লেখা চিরকুট পাওয়া গিয়েছিল। তাঁর মৃত্যুরহস্য উদ্ঘাটনে সেই চিরকুট নিয়ে কাজ করেছিলেন তদন্তকারীরা।

হাতের লেখা, সই নকল করা যায় না

সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সৈয়দ শওকত হোসেন বলেন, একজনের লেখা কিছুতেই অন্যজন নকল করতে পারেন না। এমনকি একজন ব্যক্তি একবার যে অক্ষরটি একভাবে লিখেছেন, পরেরবার তিনি নিজেই আর অবিকল সেই অক্ষরটি লিখতে পারেন না। এটাই নিয়ম।

সিআইডি বলছে, হস্তলিপিবিশারদেরা কমপক্ষে ১৬টি বিষয় মাথায় রেখে কাজ করেন। যেমন প্রত্যেকের লেখার কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে। লেখাটি কার বুঝতে লিখিয়ের অন্যান্য লেখার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে হয়। শুধু একটি বৈশিষ্ট্য মিলে গেলেই কাউকে প্রকৃত লিখিয়ে বলে ধরে নেওয়া যাবে না। কখনো কখনো লেখায় হাতের ছাপ পড়ে, আবার যিনি জালিয়াতি করতে চান, তিনি হয়তো শুধু অক্ষরটাই মোটামুটি নকল করতে পারেন, সংখ্যা নয়।

হস্তলিপিবিশারদেরা বলছেন, মানুষ যখন অন্যের লেখা নকল করে তখন আসলে সে লেখে না, আঁকে। লেখার সময় মানুষ কলম বা পেনসিলে যতটা চাপ দেয়, আঁকার সময় ততটা দেয় না। আবার অতি সতর্কতা থেকে জালিয়াতির সময় কাগজে যেন অতিরিক্ত কোনো আঁক বা দাগ পড়ে না যায়, সেদিকে সচেষ্ট থাকে। প্রকৃত লিখিয়ে এত সতর্কতা অবলম্বন করেন না। তাঁর লেখার অবশেষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়ে যায়।

অক্ষরের এই অংশগুলো পার্থক্য গড়ে, কেউ ডানে হেলিয়ে লেখেন, কেউ বামে

এমনকি ট্রেসিং করলেও লেখা মূল লেখার মতো হবে না। ট্রেসিং করার সময় কাগজ হাত থেকে ফসকে যেতে পারে, তাতে করে বিচ্যুতি দেখা দেয়। কালির ছিটা, লেখায় বিরতি, হাত কাঁপতে থাকায় রেখা আঁকাবাঁকা হয়ে যাওয়া বা মুছে ফেলার চেষ্টা এমন কোনো না কোনো ছাপ থাকবেই। লেখাজুড়ে থাকবে জোড়াতালি, দ্বিধার চিহ্ন।

তবে অন্যের লেখা নকল করায় সিদ্ধহস্ত লিখিয়েদের লেখার সঙ্গে প্রকৃত লিখিয়ের লেখায় পার্থক্য খুঁজে পাওয়া কখনো কখনো কঠিন হয়ে যায়।

‘ক্যাচ মি ইফ ইউ ক্যান’

পাঠকদের নিশ্চয়ই ‘ক্যাচ মি ইফ ইউ ক্যান’ সিনেমাটার কথা মনে আছে। সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত এ সিনেমায় ফ্র্যাঙ্ক উইলিয়াম অ্যাবানগেইলের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও। একজীবনে ফ্র্যাঙ্ক কখনো হয়েছেন এয়ারলাইনসের পাইলট, কখনো চিকিৎসক আবার কখনো অ্যাটর্নির সহকারী। ব্যাংক চেক জালিয়াতিতে তিনি গোটা দেশে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। চিকিৎসক না হয়েও নিয়োগকর্তার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের সনদ। নিয়োগকর্তারা সাদাচোখে জাল সনদ না–ই চিনতে পারেন, তবে ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) ঠিকই ধরে ফেলেছিল। কেবল ফ্র্যাঙ্ককে ধরতে পারছিল না তারা।

সিনেমার একটি দৃশ্যে সহযোগিতার শর্তে মুক্তির প্রস্তাব নিয়ে ফ্র্যাঙ্কের কাছে যান এফবিআই কর্তারা। ফ্র্যাঙ্কের সামনে তাঁরা একটি চেক রাখতেই তিনি বলেন, ‘এটা তো জাল। চেকের আশপাশে ছিদ্র থাকার কথা, নেই। কাগজটা হাতে কেটেছে। সত্যিকারের চেকের চেয়ে ভারী। লেখাটা হাতে লাগে, আসল চেকে লাগে না। এমআইসিআর নেই। যে কালিটা ব্যবহার করেছে, সেটাও যেকোনো স্টেশনারি দোকানের। গন্ধ পাওয়া যায়।’

ক্যাচ মি ইফ ইউ ক্যান সিনেমায় লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও

সিআইডির হস্তলিপিবিশারদ সৈয়দ শওকত হোসেন এই প্রতিবেদককে এমন একটা উদাহরণ দিলেন। পাসপোর্টে ঢেউয়ের ওপর ভেসে থাকা শাপলা আছে এমন একটি পাতা দেখিয়ে জানতে চাইলেন এখানে কিছু লেখা আছে কি না। খালি চোখে কিছুই দেখা যায় না। পাশে থাকা ম্যাগনিফাইং গ্লাস পাতার ওপর ধরতেই বেরিয়ে এল লেখা।

সিআইডি বলছে, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম এসব বিষয় ধরতে এখন যন্ত্রপাতির ব্যবহার করছেন তাঁরা। খালি চোখে তো নয়ই, এমনকি ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়েও সব সময় সবকিছু ধরা যায় না। ঘষামাজার বিষয়টি ধরতে ইউভি রে এর ব্যবহার হয়। আবার একজনের লেখার গতি, অন্যের চেয়ে আলাদা। খালি চোখে কে কত গতিতে লিখেছেন বোঝা না গেলেও যন্ত্রের সাহায্যে সহজেই দুই লিখিয়ের গতি কেমন তা বোঝা সম্ভব। ভিডিও স্পেক্ট্রাল কমপ্যারেটর নামে যন্ত্র আছে একটি। ধরুন জাল জালিয়াতির জন্য প্রকৃত চেকে ঘষামাজা করলেন কেউ। কালির রং বা গাঢ়ত্বের ফারাক খালি চোখে বোঝা না গেলেও এ যন্ত্রে বোঝা যাবে পরিষ্কার।

সিআইডির হস্তলিপি শাখায় মো. ওয়াসিম উদ্দিন আহমেদ জনি এ যন্ত্র ব্যবহার করেছিলেন এক প্রবাসী নারী চিকিৎসকের দায়ের করা মামলায়। ওই চিকিৎসকের ব্যাংকার ভাই তাঁর আপন বোনের স্বাক্ষর ও লেখা জাল করে সব টাকাপয়সা তুলে নিয়েছিলেন। নিজের স্ত্রীকে বোন হিসেবে হাজির করেছিলেন ব্যাংকে। পরে ধরা পড়েন হাতের লেখা পরীক্ষায়। এ নিয়ে মিরপুরে নারী চিকিৎসক মামলা করেছিলেন।