কাঁধে সংসার, লাঠিতে শরীরের ভার

দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর টিসিবির পণ্য পেয়েছেন ষাটোর্ধ্ব অলিউল্লাহ।
ছবি: প্রথম আলো

অল্প কিছু জমি, ছোট্ট একটা ঘর। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ভালোই চলছিল অলিউল্লাহর জীবন। কিন্তু কপালে সুখ সইল না বেশি দিন। হঠাৎ জীবনে নেমে আসে দুর্যোগ। নদীভাঙনে সর্বস্ব হারিয়ে ভোলার লালমোহন থেকে ঢাকায় আসেন। রিকশার প্যাডেল ঘুরিয়ে চালাতে থাকেন সংসারের চাকা।

৫০ বছর বয়সে স্ত্রী–সন্তান নিয়ে ঢাকায় আসা অলিউল্লাহর বয়স প্রায় ৬৫। ইতিমধ্যে শরীরে হানা দিয়েছে ক্যানসার। লাঠি ছাড়া ঠিকমতো দাঁড়াতেই পারেন না, সংসার চালাবেন কীভাবে! তবু দায়িত্ব পিছু ছাড়ে না। লাঠিতে ভর দিয়ে রামপুরায় টিসিবির পণ্য নিতে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। প্রয়োজনীয় পণ্য কিনে বাসায় ফিরলে রান্না হবে।

সোমবার দুপুরে রামপুরায় কথা হয় অলিউল্লাহর সঙ্গে। বলেন, লালমোহন ছেড়ে ঢাকায় আসার সময় সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী ও চার ছেলেমেয়ে। মেয়েদের বিয়ে হয়েছে, ছেলেরাও বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছে। এখন স্ত্রীকে নিয়ে পূর্ব রামপুরায় এক কক্ষের একটি ঘরে থাকেন। ভাড়া মাসে সাড়ে তিন হাজার। বার্ধক্য ও শারীরিক অসুস্থতার কারণে স্ত্রীও কিছু করতে পারেন না।

সংসার চলে কীভাবে—প্রশ্ন শুনে কিছুটা অপ্রস্তুত অলিউল্লাহ। কিছু সময় নীরব থেকে বললেন, ‘সংসার চলে না, কোনোমতে বাইচ্চা আছি।’ ছেলেরা দেখে না?—জানতে চাইলে বলেন, ‘তারা দিনমজুর, নিজেদের সংসারই ঠিকমতো চলে না, আমাদের দিব ক্যামনে। তবে বড় মেয়ে বাসাভাড়ার টাকা দেয়।’

অলিউল্লাহর মতো শতাধিক নিম্ন ও মধ্যবিত্তের মানুষ এসেছেন সুলভ মূল্যে টিসিবির পণ্য কিনতে। রামপুরা বাজারের পাশে টিসিবির ট্রাকের পেছনে লাইনে দাঁড়িয়েছেন তাঁরা। পণ্যের দাম বাড়ায় তাঁদের কারও সংসারে টান পড়েছে; কারও স্বামীর চাকরি গেছে; কারও ঘরে চাল ছাড়া কিছু নেই। আবার এমন লোকও এসেছেন, সুলভ মূল্যেও পণ্য কেনার সামর্থ্য নেই তাঁর।

কথা হয় এমনই একজন মোস্তফা কামালের সঙ্গে। থাকেন বনশ্রী এলাকায়। শুকনা মুখে ঘণ্টাখানেক দাঁড়িয়ে আছেন টিসিবির লাইনে। এরপর জানতে পারলেন ট্রাক থেকে ছয়টি পণ্য প্যাকেজ আকারে বিক্রি হচ্ছে। যার মধ্যে আছে সয়াবিন তেল, পেঁয়াজ, মসুর ডাল, চিনি, খেজুর ও ছোলা। প্যাকেজ মূল্য ৭৯০ টাকা। কিন্তু এত টাকা তিনি কোথায় পাবেন। পকেটে হাতড়ে কয়েকটি ৫০ ও ১০ টাকার নোট বের করলেন মোস্তফা। গুনে দেখেন মোটে আছে ৩০০ টাকা।

মোস্তফা কামাল বলেন, সকালে চাল কিনে টাকা শেষ হয়ে গেছে। কম দামে টিসিবির পণ্য কিনতে এসেছিলেন। কিন্তু প্যাকেজ কেনার মতো টাকা নেই। টাকার অভাবে শেষমেশ লাইন ছেড়ে বাড়ির পথে হাঁটা ধরেন তিনি।

রামপুরা বাজারের সামনে টিসিবির পণ্য বিক্রির ডিলার মেসার্স এস এস এন্টারপ্রাইজ। বনশ্রী আইডিয়াল স্কুলের পাশে ট্রাকে পণ্য বিক্রির কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে স্থান পরিবর্তন করে নেওয়া হয় রামপুরা বাজারের সামনে।

ডিলার সাইফুল ইসলাম বলেন, রাস্তায় যানজটের কথা ভেবে স্থানীয় কমিশনার রামপুরায় পণ্য বিক্রির পরামর্শ দিয়েছেন। গুদাম থেকে মালামাল বোঝাই ট্রাক রামপুরা আসে বেলা দুইটার দিকে। পণ্য মেপে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করতে লাগে আরও প্রায় এক ঘণ্টা।

ডিলারের প্রতিনিধি মো. রাজা বলেন, ২৫০ জনের জন্য ৫০০ লিটার সয়াবিন তেল, ৫০০ কেজি চিনি, ৫০০ কেজি মসুর ডাল, ১ হাজার কেজি পেঁয়াজ, ৭৫০ কেজি ছোলা ও ২৫০ কেজি খেজুর এনেছেন।

টিসিবির অন্য পণ্য ভালো হলেও পেঁয়াজের মান খুব খারাপ বলে জানান লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন। তপ্ত রোদে প্রায় তিন ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে এমন পেঁয়াজ পেয়ে মন খারাপ গৃহিণী শারমিন আক্তারের। শারমিন বলেন, পাঁচ কেজি পেঁয়াজের প্রায় এক কেজিই নষ্ট। সরকারের উচিত ভালো পণ্য দেওয়া। নষ্ট পণ্য দেওয়ার চেয়ে না দেওয়াই ভালো।

পেঁয়াজের মান নিয়ে ডিলার সাইফুল বলেন, এখানে তাঁদের কিছু করার নেই। সরকার তাঁদের যে পণ্য দেয়, তাঁরা তা বিক্রি করেন।