কানসাট রাজার বাগান

চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের কানসাট রাজার বাগানে ‘মেমপসন্দ’ জাতের আমগাছ।
প্রথম আলো

আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জে বেড়াতে এসে সুস্বাদু নানা জাতের আমের পুরোনো সব বাগান দেখতে চান, তবে আপনাকে যেতে হবে কানসাট রাজার বাগানে। জেলার ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোর একটি এই বাগান।

‘কানসাট রাজার বাগান’ হলো, প্রায় দুই শ বছরের পুরোনো নানা জাতের আমগাছ নিয়ে বিরাট এক আমবাগান। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাটে এর অবস্থান। বাগানটি কোনো রাজার বাড়ি নয়, জমিদারবাড়ি। প্রায় এক শ বিঘা আয়তনের বাগানটি ছিল সূর্যকান্ত চৌধুরী, শশীকান্ত চৌধুরী ও শিতাংশুকান্ত চৌধুরীদের। তখন সাধারণ মানুষ জমিদারদের রাজা বলত।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের ইতিহাস-ঐতিহ্যের লেখক অধ্যাপক মাযহারুল ইসলামের ভাষ্য, জমিদারদের রোপণ করা কোনো বাগান নয় এটি। মি. হল নামের এক আমপ্রেমী ইংরেজ এ বাগান তৈরি করেন। এ দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে তিনি এখানকার জমিদারের কাছে বাগানটি বিক্রি করে যান বলে জনশ্রুতি আছে।

এই বাগানে ‘মেমপসন্দ’ নামে রয়েছে সুস্বাদু জাতের এক গাছ। ধারণা করা হয়, কোনো এক মেম সাহেবের দারুণ পছন্দের আম ছিল এটি। তাই এমন নামকরণ। আরও আছে নবাবপসন্দ, অমৃতভোগ, বৃন্দাবনি, কালীমেঘা, গোলাপবাস, খেজুরকাইঞ্জ, জালিবান্ধা, মুলতানি, কাঁচামিঠাসহ অপ্রচলিত বহু সুস্বাদু জাতের আম। সঙ্গে বিখ্যাত ফজলি, ল্যাংড়া, ক্ষীরশাপাতি, গোপালভোগ জাতের গাছ। চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমের ঐতিহ্য যে বহু পুরোনো, এ আমবাগানও তার একটা প্রমাণ। জেলার ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ হয়ে আছে এটি।

৫৬ বছর ধরে এ বাগানে প্রহরীর দায়িত্বে আছেন সাইদুর রহমান। তাঁর মতে, এ বাগানে ছিল প্রায় ৫০ জাতের ২৯৭টি বড় বড় আমগাছ। এখন আর নেই। আগের বিশাল গাছগুলোর মধ্যে ১০-১২ জাতের মাত্র ৬৫টি গাছ আছে। ২০০১ সালের পর একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি বাগানটি বন্দোবস্ত নিয়ে পুরোনো অনেক গাছ কেটে ফেলেন। এ সময় কেটে ফেলা হয় সুস্বাদু গরজিত, বউভুলানি, ভুটভুটি, কেরাসিনাসহ আরও পুরোনো সব সুস্বাদু জাতের আমগাছ। লাগানো হয় আম্রপালিসহ বিভিন্ন গুটি জাতের আম। ঠিকমতো পরিচর্যা না হওয়ায় সে গাছগুলোতে ফলন হয় না দীর্ঘদিন। পরিণত হয় ঘন জঙ্গলে। রাজার বাগানের হয় ফকিরের দশা।

সম্প্রতি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাগানটিকে ‘বঙ্গবন্ধু লাইভ ম্যাংগো মিউজিয়াম’-এ রূপান্তরে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে সীমানাদেয়াল নির্মাণ প্রায় শেষ পর্যায়ে। শিবগঞ্জ ইউএনও সাকিব আল রাব্বি জানান, এলাকার আমপ্রেমীদের মুখে বাণিজ্যিক জাতগুলোর বাইরেও নানা সুস্বাদু জাতের কথা শোনা যায়। এ ছাড়া সারা দেশেরও নানা সুস্বাদু জাত রয়েছে। সেগুলো এখানে লাগানো হবে। এসব উদ্যোগের সঙ্গে আমবিজ্ঞানীদের সম্পৃক্ত করা হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে ১০০ জাত সংরক্ষণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া পর্যটকদের আকর্ষণ করতে এখানে নির্মাণ করা হবে ডাকবাংলো। কানসাট রাজার বাগানে ফিরিয়ে আনা হবে হারিয়ে যাওয়া রাজসিক অবস্থা।

প্রশাসনের এমন উদ্যোগে আশাবাদী শিবগঞ্জ ম্যাংগো প্রডিউসার কো-অপারেটিভ সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক শামীম খান। জেলার অন্যতম বড় এই আমচাষি বলেন, ‘আমকেন্দ্রিক পর্যটনে এ বাগান দারুণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করি।’

রাজার বাগানসংলগ্ন গ্রাম হচ্ছে পারকানসাট। এ গ্রামের বাসিন্দা মো. নইজুদ্দীন (৮৬)। প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজার বাগানে এখুন যে বড় বড় গাছগালা দেখছ, হামরা ছুটুবেলাতেই এ রকুম দেখাছি। এ বাগানের বয়স দুই শ বচ্ছরের কম লয়। সব কুনঠে যে হারিয়া গেল।’ স্মৃতিচারণা করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন বাড়ির সামনে খালি গায়ে বসে থাকা নইজুদ্দীন। তিনি আরও বলেন, ‘বাগানে এখুনো যেগলা আছে, সেগলা আর যেনে না হারায়।’

প্রবীণ এই মানুষের মতো এমন প্রত্যাশা জেলার আমপ্রেমী সব মানুষের।