কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মরদেহ তাঁর গ্রামের বাড়ি শেরপুরে নেওয়া হচ্ছে। ছবি: ফোকাস বাংলা
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মরদেহ তাঁর গ্রামের বাড়ি শেরপুরে নেওয়া হচ্ছে। ছবি: ফোকাস বাংলা

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। তাঁর লাশ গ্রামের বাড়ি শেরপুরে নিয়ে যাওয়া পাঠানো হ​য়েছে।
আজ শনিবার রাত ১০টা ৩০ মিনিটে কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর হয় বলে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া।
জ্যেষ্ঠ জেল সুপার ফরমান আলী রাত পৌনে ১২টার দিকে সাংবাদিকদের জানান, আজ রাত ১০টা ৩০ মিনিটে কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। তিনি প্রাণ ভিক্ষা চাননি। তাঁর মরদেহ গ্রামের বাড়িতে পাঠানো হয়েছে। পুলিশ ও র‍্যাবের বেশ কয়েকটি গাড়ি নিরাপত্তার জন্য মরদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে পাঠানো হয়েছে। 
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামিদের মধ্যে দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে কামারুজ্জামানের শাস্তি কার্যকর করা হলো।

কর্মকর্তাদের কারাগারে প্রবেশ
রাত ৮টা ৫৫ মিনিটের দিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রবেশ করেন ঢাকা জেলা প্রশাসক তোফাজ্জল হোসেন মিয়া। এর আগে সন্ধ্যার দিকে কারাগারে যান আইজি (প্রিজন) ইফতেখার উদ্দিন, অতিরিক্ত আইজি (প্রিজন) কবির হোসেন ও ডিআইজি (প্রিজন) গোলাম হায়দার। জ্যেষ্ঠ কারা তত্ত্বাবধায়ক ফরমান আলী আগে থেকেই কারাগারের ভেতরে ছিলেন বলে জানা যায়।
কারাগারে অ্যাম্বুলেন্স
রাত সোয়া আটটার দিকে লাশ বহন করে এমন একটি ফ্রিজিং অ্যাম্বুলেন্স কারাগারের সামনে এনে রাখা হয়। রাত ৯টা ৫০ মিনিটের দিকে আরেকটি অ্যাম্বুলেন্স কারাগারের ভেতরে ঢোকে।

স্বজনদের সাক্ষাৎ
আজ বিকেল চারটার দিকে কামারুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যান তাঁর স্বজনেরা। সোয়া এক ঘণ্টা পর তাঁরা কারাগার থেকে বের হয়ে আসেন। কামারুজ্জামানের ছেলে হাসান ইকবাল প্রথম আলোকে মুঠোফোনে বলেন, তাঁরা ৩৫ মিনিটের মতো সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন। তিনি তাঁদের হাসিমুখে বিদায় দিয়েছেন।

রিভিউ খারিজের পর
রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে কামারুজ্জামানের করা আবেদন গত ৬ এপ্রিল খারিজ করে দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। এর পর গত ৮ এপ্রিল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কামারুজ্জামানকে ফাঁসির আদেশ পড়ে শোনানো হয়। ওই দিন প্রাণভিক্ষার আবেদন করবেন কি না, সে ব্যাপারে আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করতে সময় চান তিনি। সেই অনুযায়ী গত বৃহস্পতিবার সকালে তাঁর আইনজীবীরা তাঁর সঙ্গে কারাগারে দেখা করেন। দেখা করে বের হয়ে আসার পর তাঁর আইনজীবী শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, ক্ষমা চাওয়ার ব্যাপারে তিনি ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেবেন। তিনি তাঁর সিদ্ধান্তের কথা কারা কর্তৃপক্ষকে জানাবেন।

গতকাল শুক্রবার সকালে ম্যাজিস্ট্রেট তানজিম মোহাম্মদ আজিম ও মাহবুব জামিল কামারুজ্জামানের সঙ্গে কারাগারে দেখা করেন। তবে কারাগারের সামনে থাকা গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে তাঁরা কোনো ধরনের কথা বলেননি। সন্ধ্যার দিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ও এর আশপাশে হঠাৎ করে নিরাপত্তা জোরদার করা করা। কিন্তু গতকাল তাঁর ফাঁসি কার্যকর হয়নি।

কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে সাত অভিযোগ
কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ হলো, একাত্তরের ২৯ জুন তাঁর নেতৃত্বে আলবদররা শেরপুরের ঝিনাইগাতী থানার রামনগর গ্রামের বদিউজ্জামানকে অপহরণ ও নির্যাতনের পর গুলি করে হত্যা করে।
দ্বিতীয় অভিযোগ অনুযায়ী, কামারুজ্জামান ও তাঁর সহযোগীরা শেরপুর কলেজের অধ্যক্ষ সৈয়দ আবদুল হান্নানকে প্রায় নগ্ন করে শহরের রাস্তায় হাঁটাতে হাঁটাতে চাবুকপেটা করেন।
তৃতীয় অভিযোগ, ২৫ জুলাই কামারুজ্জামানের পরামর্শে পরিকল্পিতভাবে আলবদর ও রাজাকার বাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে শেরপুরের নালিতাবাড়ীর সোহাগপুর গ্রামে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চালায় ও নারীদের ধর্ষণ করে।

চতুর্থ অভিযোগ, কামারুজ্জামানের নির্দেশে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা গুলি করে শেরপুরের গোলাম মোস্তফাকে হত্যা ও আবুল কাসেমকে আহত করে।

পঞ্চম অভিযোগ অনুসারে, মুক্তিযুদ্ধকালে কামারুজ্জামান ও সহযোগীরা শেরপুরের লিয়াকত আলী ও মুজিবুর রহমান পানুকে অপহরণ ও নির্যাতন করে।

ষষ্ঠ অভিযোগ, একাত্তরের নভেম্বরে কামারুজ্জামানের নির্দেশে আলবদররা টুনু ও জাহাঙ্গীরকে আটকের পর নির্যাতন করে। টুনুকে হত্যা করা হয়।

সপ্তম অভিযোগে বলা হয়েছে, কামারুজ্জামান ও আলবদরের সদস্যরা ছয়জনকে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে।

কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে পঞ্চম ও ষষ্ঠ অভিযোগ ছাড়া বাকি পাঁচটি অভিযোগে অপরাধ প্রমাণিত হয়। প্রথম, তৃতীয়, চতুর্থ ও সপ্তম-এই চারটি অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে হত্যায় সংশ্লিষ্টতা বা সহযোগিতার জন্য এবং দ্বিতীয় অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে অমানবিক আচরণের দায়ে কামারুজ্জামানকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।

ট্রাইব্যুনাল ও আপিল বিভাগে সাজা
একাত্তরে শেরপুরের সোহাগপুর গ্রামে ১৪৪ জনকে হত্যা ও নারী নির্যাতনের দায়ে ২০১৩ সালের ৯ মে কামারুজ্জামানকে ফাঁসির আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে আসামিপক্ষ। গত বছরের ৩ নভেম্বর সোহাগপুর হত্যাকাণ্ডের দায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতে কামারুজ্জামানের ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। চলতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হলে ৫ মার্চ তা পুনর্বিবেচনার আবেদন করেন কামারুজ্জামান। এরপর দুই দফা শুনানি পেছানোর পর ৫ এপ্রিল আপিল বিভাগে ওই আবেদনের শুনানি হয়। পরদিন আদালত তাঁর রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেন।