কারাগারই 'আব্বার বাড়ি'

.
.

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের একটি বড় অংশ কেটেছে কারাগারে। ছয় দফা দাবি তোলার আগে ও পরে যখন বঙ্গবন্ধুকে বারবার কারাগারে যেতে হচ্ছে, তখন তাঁর ছোট ছেলে শেখ রাসেল দুধের শিশু। বঙ্গবন্ধুর কারাজীবন পরিবারের অন্যদের কাছে স্বাভাবিকের মতো হলেও রাসেলের জন্য এটি ছিল একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা। ১৮ মাসের অবুঝ শিশুটি ধরেই নিয়েছিল যে কারাগারই ‘আব্বার বাড়ি’। বাবা থেকেও নেই, তাই মাকেই আব্বা ডাকা শুরু করেছিল ছেলেটি।

বঙ্গবন্ধুর কারাজীবনের একটি অধ্যায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর নতুন বই কারাগারের রোজনামচায়, যে সময়টাতে রাসেলের বয়স ১-২ বছর। ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ছয় দফা উত্থাপনের পর ওই বছরের প্রথম তিন মাসে ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোর, ময়মনসিংহ, সিলেট, খুলনা, পাবনা, ফরিদপুর থেকে আটবার গ্রেপ্তার হন ও জামিন পান তিনি। এরপর মে মাসে আবার গ্রেপ্তার হন। তাঁর ওই সময়ের বন্দিজীবনের দিনলিপি হচ্ছে কারাগারের রোজনামচা। বইটির নাম দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ রেহানা।

বইটির ভূমিকায় বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিখেছেন, ভাষা আন্দোলন থেকে ধাপে ধাপে স্বাধীনতা অর্জনের সোপানগুলো যে কত বন্ধুর পথ অতিক্রম করে এগোতে হয়েছে, তার কিছুটা এই বই থেকে পাওয়া যাবে। তিনি লিখেছেন, ‘বাংলার মানুষ যে স্বাধীন হবে এ আত্মবিশ্বাস বারবার তাঁর (বঙ্গবন্ধু) লেখায় ফুটে উঠেছে। এত আত্মপ্রত্যয় নিয়ে পৃথিবীর আর কোনো নেতা ভবিষ্যদ্বাণী করতে পেরেছেন কি না আমি জানি না।’

বঙ্গবন্ধুর এই বইয়ে শুধু কারাগারের চিত্রই নয়, ফুটে উঠেছে সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আওয়ামী লীগের অবস্থা, পাকিস্তান সরকারের একনায়কোচিত মনোভাব ও অত্যাচার-নির্যাতনের নানা চিত্র। ফুটে উঠেছে একজন বন্দী বাবার আকুতি, অবুঝ সন্তানের ভালোবাসা। দেশ ও মানুষের জন্য বঙ্গবন্ধুর ভাবনা, রাজনৈতিক দর্শন। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বইটি গতকাল শুক্রবার থেকে পাওয়া যাচ্ছে।

আব্বার বাড়ি

জন্মের পর থেকে বেশির ভাগ সময় শিশু রাসেল দেখছে তার বাবা তাদের বাসায় থাকেন না। থাকেন কারাগারে। অবুঝ শিশু মনে করছিল, কারাগারটাই তার ‘আব্বার বাড়ি’। মাঝেমধ্যে মায়ের সঙ্গে ‘আব্বার বাড়ি’তে গিয়ে বাবাকে দেখে আসে। তেমনই একটি দিন ১৯৬৬ সালের ১৫ জুন। রাসেল গিয়েছে বাবাকে দেখতে। বাবা বঙ্গবন্ধু সেই বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, ‘১৮ মাসের রাসেল জেল অফিসে এসে একটুও হাসে না, যে পর্যন্ত আমাকে না দেখে। দেখলাম দূর থেকে পূর্বের মতোই ‘‘আব্বা আব্বা’’ বলে চিৎকার করছে। জেল গেট দিয়ে একটা মালবোঝাই ট্রাক ঢুকছিল। আমি তাই জানালায় দাঁড়াইয়া ওকে আদর করলাম। একটু পরেই ভিতরে যেতেই রাসেল আমার গলা ধরে হেসে দিল। ওরা বলল, আমি না আসা পর্যন্ত শুধু জানালার দিকে চেয়ে থাকে, বলে ‘‘আব্বার বাড়ি’’। এখন ওর ধারণা হয়েছে এটা ওর আব্বার বাড়ি। যাবার সময় হলে ওকে ফাঁকি দিতে হয়।’
পরের মাসে ১১ জুলাই বঙ্গবন্ধু লিখছেন, ‘...গেট পার হয়েও রাসেল হাত তুলে আমার কাছ থেকে বিদায় নিল। বোধ হয় বুঝে গিয়েছে এটা ওর বাবার বাড়ি, জীবনভর এখানেই থাকবে।’

সেবার দুটি ঈদ বঙ্গবন্ধুকে কাটাতে হয়েছিল কারাগারে। এটি অবশ্য তাঁর জন্য নতুন অভিজ্ঞতা নয়। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন, আরও অনেক ঈদ এই কারাগারেই তাঁকে কাটাতে হবে। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘রাসেল ছোট্ট তাই এখনও বুঝতে শিখে নাই। শরীর ভাল না। কিছুদিন ভুগেছে। দেখা করতে এসে রাসেল আমাকে মাঝে মাঝে ছাড়তে চায় না। ওর কাছ থেকে বিদায় নিতে কষ্ট হয়। জীবনে বহু ঈদ এই কারাগারে আমাকে কাটাতে হয়েছে, আরও কত কাটাতে হয় ঠিক কি! তবে কোনো আঘাতেই আমাকে বাঁকাতে পারবে না।’

আজীবন সংগ্রামী শেখ মুজিব দিন শেষে একজন পিতাও। সন্তানদের প্রতি মমতা তো আর কারাগারে আটকে রাখা যায় না। ঈদের দুই দিন আগে তিনি স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘বাচ্চাদের সবকিছু কিনে দিও। ভাল করে ঈদ করিও, না হলে ওদের মন ছোট হয়ে যাবে।’

কারাগারে থাকাটা অনেকটা অভ্যাসে পরিণত হলেও উৎসবের দিন হয়তো সবারই মন কাঁদে। ১৯৬৭ সালের ২২ মার্চ বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আজ কোরবানির ঈদ। গত ঈদেও জেলে ছিলাম। এবারও জেলে। বন্দী জীবনে ঈদ উদ্‌যাপন করা একটি মর্মান্তিক ঘটনা বলা চলে।’

কারাগারের ভেতরে একাকী বন্দিজীবন, সেভাবে কারও সঙ্গে কথা বলার, দেখা করার সুযোগ নেই। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও চাইলেই দেখা করা যায় না। সব সময় পরিবারের সদস্যরা দেখা করার সুযোগ পেতেন না। জানতে পারতেন না পরিবার অনুমতি পেয়েছে কি না। তিনি অপেক্ষায়ই থাকতেন। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘...চারটা থেকে চেয়ে ছিলাম রাস্তার দিকে। মনে হতেছিল এই বোধ হয় আসে খবর। যখন ৫টা বেজে গেল তখন ভাবলাম, না অনুমতি পায় নাই।’

দেখতে দেখতে প্রায় বছর কেটে গেল। শিশু রাসেলও বড় হচ্ছে। সে বাবাকে চায়, কিন্তু বাবা কারাগারে। বাবার অভাব পূরণ করতে মাকেই ‘আব্বা’ বানালেন বেগম মুজিব। বঙ্গবন্ধু ১৯৬৭ সালের ১৪ এপ্রিল বর্ণনা করেছেন, ‘জেল গেটে যখন উপস্থিত হলাম ছোট ছেলেটা আজ আর বাইরে এসে দাঁড়াইয়া নাই দেখে একটু আশ্চর্য হলাম। আমি যখন রুমের ভিতর যেয়ে ওকে কোলে করলাম আমার গলা ধরে ‘‘আব্বা আব্বা’’ করে কয়েকবার ডাক দিয়ে ওর মার কোলে যেয়ে ‘‘আব্বা আব্বা’’ করে ডাকতে শুরু করল। ওর মাকে আব্বা বলে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ব্যাপার কি? ওর মা বলল, বাড়িতে আব্বা আব্বা করে কাঁদে, তাই ওকে বলেছি আমাকে আব্বা বলে ডাকতে। রাসেল আব্বা আব্বা বলে ডাকতে লাগল। যেই আমি জবাব দেই সেই ওর মার গলা ধরে বলে, “তুমি আমার আব্বা”। আমার উপর অভিমান করেছে বলে মনে হয়।’

রাসেল একটু বড় হয়েছে। কিন্তু কারাগার থেকে চাইলেই কেউ বের হতে পারে না, এটি বোঝার মতো বড় সে হয়নি। সে এখন বাবাকে তার সঙ্গে বাড়ি নিয়ে যেতে চায়। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, ‘৮ই ফেব্রুয়ারি ২ বৎসরের ছেলেটা এসে বলে, ‘আব্বা বালি চলো’। কি উত্তর ওকে আমি দেব? ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম, ও তো বুঝে না আমি কারাবন্দী। ওকে বললাম, ‘তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো। ও কি বুঝতে চায়! কি করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে!’

পিতার মনও কাঁদে। পিতা শেখ মুজিব লিখেছেন, ‘দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলেমেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনও বুঝতে শিখে নাই। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে।’

আত্মপ্রত্যয়ী

একাকী বন্দী রেখেও পাকিস্তানি শাসক বঙ্গবন্ধুর মনোবলে চিড় ধরাতে পারেনি। তাঁর প্রতিদিনকার বর্ণনাতেই এর ইঙ্গিত পাওয়া যায়। যেমন ১৯৬৬ সালের ৫ জুন বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘তিনি (মোনায়েম খান) ভুলে গেছেন এটা পূর্ব বাংলা, পশ্চিম পাকিস্তান নহে! আন্দোলন করা এবং নির্যাতন সহ্য করার ক্ষমতা এরা রাখে।’

১২ই জুন লিখেছেন, ‘ভরসা আমার আছে, জনগণের সমর্থন এবং ভালবাসা দুইই আছে আমাদের জন্য। তাই আন্দোলন ও পার্টির কাজ চলবে।’

ওই সময়টাতে শুধু বঙ্গবন্ধুই নন, আওয়ামী লীগের বড় নেতাদের প্রায় সবাইকে জেলে নিয়েছিল সরকার। উদ্দেশ্য, ছয় দফা বানচাল করা। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ছিলেন দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ী। ১৯৬৬ সালের ১৭ জুলাই তিনি লেখেন, ‘...সব কয়জন সেক্রেটারিকে নিয়ে এসেছে, এখন একমাত্র মহিলা সম্পাদিকা আমেনা বেগম আছে। জেলখাটা ও কষ্টকরা শিখতে দেও, এতে কর্মীদের মধ্যে ত্যাগের প্রেরণা জাগবে। ত্যাগই তো দরকার। ত্যাগের ভিতর দিয়েই জনগণের মুক্তি আসবে।’

সরকারের দমন-পীড়ন, ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও ছয় দফার বিষয়ে শেখ মুজিব ছিলেন অনড়। ডায়েরিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘৬ দফা বাদ দিয়া কোনো দলের সাথে আওয়ামী লীগ হাত মেলাতে পারে না। আর করবেও না।’ ‘৬ দফা ছাড়তে পারব না। যেদিন বের হব ৬ দফারই আন্দোলন করব।’ ‘সারা পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদের ওপর জুলুম চলছে...মানুষকে জেলে নিতে পারে কিন্তু নীতিকে তো জেলে নিতে পারে না।’

বঙ্গবন্ধুর কারাজীবনের এই লেখালেখিতে ১৯৬৬ সালের কর্তৃত্ববাদী সরকারের চরিত্র ফুটে উঠেছে তাঁর বিভিন্ন দিনের বর্ণনায়। তেমনই একটি ৪ জুনের বর্ণনা। তিনি লিখেছেন, ‘ইত্তেফাক দেখে মনে হলো ৭ই জুনের হরতাল সম্বন্ধে কোনো সংবাদ ছাপাতে পারবে না বলে সরকার হুকুম দিয়েছে। কিছুদিন পূর্বেও দিয়েছিল, ‘‘এক অংশ অন্য অংশকে শোষণ করেছে এটা লেখতে পারবা না। ছাত্রদের কোনো নিউজ ছাপাতে পারবা না। এই যে হুকুম দিলাম সে খবরও ছাপাতে পারবা না।’’ যে দেশে মানুষের মতামত বলার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে, সে দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকবে কেমন করে? যারা আজও বুঝছে না, জীবনেও বুঝবে না।’