বিশ্ব কিডনি দিবস আজ
কিডনি চিকিৎসায় সচেতনতা ও দক্ষ জনবলে ঘাটতি
বছরে ৪০ হাজার রোগীর কিডনি আকস্মিক বিকল হয়, যাদের ৮০ শতাংশই মারা যান ডায়ালাইসিস বা সংযোজনের চিকিৎসার অভাবে।
নারায়ণগঞ্জের শাকিল খান আগে ঢালাইয়ের কাজ করে মাসে প্রায় ২০ হাজার টাকা আয় করতেন। ২০১৬ সালে তাঁর কিডনি রোগ ধরা পড়ে। গত পাঁচ বছর নারায়ণগঞ্জ থেকে রাজধানীর মিরপুরে কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটে এসে সপ্তাহে দুই দিন ডায়ালাইসিস করাতে হচ্ছে তাঁকে। একেকবার ডায়ালাইসিসের খরচ ১ হাজার ৬০০ টাকা, এর সঙ্গে যাতায়াত ভাড়া, খাবারের খরচসহ অন্যান্য খরচ তো আছেই। চিকিৎসা খরচ চালাতে গিয়ে চার সন্তানের বাবা শাকিল জমিজমা যেটুকু ছিল, তা–ও প্রায় বিক্রি করে দিয়েছেন।
গতকাল বুধবার শাকিল বললেন, ‘অনেক জায়গায় ঘুরছি। ডাক্তার কেবল ওষুধের ডোজ বাড়ান, আমি আর ভালো হই না। পরে এই হাসপাতালের খোঁজ পাই। নিয়মমতো ডায়ালাইসিস করতে না পারলে শরীর ভয়াবহ খারাপ হয়। ডাক্তারেরা বলছেন, যত দিন বাঁচি, তত দিনই ডায়ালাইসিস করাতে হবে। এখন আর কোনো কাজ করতে পারি না। জানি না কত দিন আর চিকিৎসা করাতে পারব।’
কিডনি রোগ শনাক্তকরণে সরকার ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিককে কাজে লাগাতে পারে। হাতের কাছে চিকিৎসা সেবা পেলে রোগটির প্রকোপ কমিয়ে আনা সম্ভব।
দেশের দুই কোটি মানুষ কিডনি-সংক্রান্ত নানা জটিলতায় ভোগেন। এর মধ্যে বছরে ৪০ হাজার রোগীর কিডনি আকস্মিক বিকল হয়, যাদের ৮০ শতাংশই মারা যান কিডনি ডায়ালাইসিস বা সংযোজনের চিকিৎসার অভাবে।
সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, দেশে ১২ থেকে ১৫ লাখ মানুষের জন্য আছেন মাত্র একজন কিডনি বিশেষজ্ঞ। আর এ খাতে প্রশিক্ষিত নার্সের সংখ্যা ২০০ জনেরও কম। সারা দেশে অনুমোদনপ্রাপ্ত কিডনি সংযোজন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা করোনা শুরুর আগে ছিল ১০টি, বর্তমানে তা চারটিতে নেমে এসেছে। দেশে কিডনি রোগ নিয়ে কোনো নীতিমালা, কৌশলপত্র এবং কোনো নির্দেশিকাও নেই।
চলতি বছরের জানুয়ারির শুরুতে দেশের ৮ বিভাগীয় শহরে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৪৬০ শয্যাবিশিষ্ট সমন্বিত ক্যানসার, কিডনি ও হৃদ্রোগ ইউনিটের নির্মাণকাজের উদ্বোধন ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এ ছাড়া সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ক্যানসার, কিডনি, লিভার সিরোসিস, স্ট্রোকে প্যারালাইজড, জন্মগত হৃদ্রোগ এবং থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের আর্থিক সহায়তায় কার্যক্রম পরিচালনা করছে। প্রতিবছর ৩০ হাজার রোগীকে জনপ্রতি ৫০ হাজার টাকা করে অনুদান দিচ্ছে।
ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউটে রোগীদের ডায়ালাইসিস বন্ধ থাকায় রোগী ও স্বজনেরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। ডায়ালাইসিস বন্ধ ছিল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও। বেসরকারি সংস্থা স্যানডোর ডায়ালাইসিস সার্ভিসেস বাংলাদেশ লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান এই দুটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস সেবা দেওয়ার জন্য চুক্তিবদ্ধ। এ সংস্থার ২১ কোটি টাকা বকেয়া থাকায় ডায়ালাইসিস সেবা বন্ধ করে দিয়েছিল তারা। জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে এ রোগের বিশেষায়িত সেবা নেই বললেই চলে।
এ ধরনের পরিস্থিতিতে দেশে আজ বৃহস্পতিবার (মার্চ মাসের দ্বিতীয় বৃহস্পতিবার) পালিত হচ্ছে বিশ্ব কিডনি দিবস। এবারের দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘সুস্থ কিডনি সবার জন্য, জ্ঞানের সেতুবন্ধনে সাফল্য’।
সরকারের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর মো. রোবেদ আমিন বলেন, দেশে কিডনি রোগীর সংখ্যা অসংখ্য, সেই অনুপাতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, নার্সসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রেই ঘাটতি আছে। রোগটি প্রতিরোধে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ও ব্যথানাশক ওষুধ না খাওয়া, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, বাইরের অস্বাস্থ্যকর খাবার না খাওয়া, ব্যায়াম করা বা হাঁটার মতো বিষয়গুলোতে মানুষের সচেতনতা বাড়ানো জরুরি।
গত ২২ জানুয়ারি রাজধানীর শ্যামলীতে সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালে (সিকেডি) ৫৪ বছর বয়সী বুলি বেগমের দেওয়া কিডনি ২৪ বছর বয়সী ছেলে জাহিদ হাসানের শরীরে প্রতিস্থাপন করেছেন চিকিৎসকেরা। এতে সব মিলে খরচ হয়ে গেছে প্রায় ১০ লাখ টাকা। জমি, বাড়ির ভিটা পর্যন্ত বিক্রি করতে হয়েছে। শ্যামলীতেই বাসা ভাড়া করে চিকিৎসকের ফলোআপে থাকতে হচ্ছে পঞ্চগড় থেকে আসা এই মা–ছেলেকে।
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে স্নাতকোত্তরে ভর্তির আগেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন জাহিদ হাসান। গতকাল মুঠোফোনে জাহিদ জানান, তিনি ও তাঁর মা এখন বেশ ভালো আছেন। তবে আফসোস একটাই, দুই বছর আগে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের যে চিকিৎসক তাঁকে দেখেছিলেন, তিনি একবারের জন্যও জাহিদকে সতর্ক করেননি, কিডনি বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগও করতে বলেননি। প্রস্রাবে সমস্যা বলে ওষুধ দিয়ে ছেড়ে দিয়েছিলেন।
কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা এবং সভাপতি অধ্যাপক হারুন-আর-রশিদ কিডনি চিকিৎসায় দক্ষ জনবল বাড়ানোর বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, কিডনি রোগ শনাক্তকরণে সরকার ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিককে কাজে লাগাতে পারে। হাতের কাছে চিকিৎসা সেবা পেলে রোগটির প্রকোপ কমিয়ে আনা সম্ভব।
আন্তর্জাতিক কিডনি সমিতি কোনো ব্যক্তির কিডনি রোগ আছে কি না, তা জানার জন্য সাতটি প্রশ্ন ঠিক করেছে। এসব প্রশ্নের উত্তর না–সূচক হলে বুঝতে হবে ওই ব্যক্তি কিডনি রোগে আক্রান্ত নন। মানুষ সহজেই বুঝতে পারে এ ধরনের বিষয়ে সরকার যাতে প্রচার বাড়ায় সে আহ্বানও জানান অধ্যাপক হারুন-আর-রশিদ।