কুষ্টিয়ার সেই শিক্ষক গ্রেপ্তার

একাধিক ছাত্রীসহ কয়েকজন নারীর সঙ্গে মেলামেশা ও ভিডিওচিত্রে তা ধারণের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে কুষ্টিয়ার স্কুলশিক্ষক হেলাল উদ্দিন ওরফে পান্নাকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) গ্রেপ্তার করেছে। গত শনিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার একটি বাসা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে পুলিশ দাবি করেছে।
তবে একাধিক সূত্র প্রথম আলোকে জানায়, সহকারী কমিশনার (এসি) রায়হানের নেতৃত্বে ডিবির একটি দল শুক্রবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মোহাম্মদপুরের চিনু মিয়া রোডের একটি ভাড়া বাসা থেকে হেলালকে গ্রেপ্তার করে। সেখানে বেনামে তিনি বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন।
গতকাল রোববার দুপুরে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ ব্রিফিংয়ের আয়োজন করা হয়। যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, কুষ্টিয়া ডিবি পুলিশের অনুরোধে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ হেলালকে গ্রেপ্তার করেছে। তাঁর কাছ থেকে বেশ কিছু আলামত উদ্ধার করা হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি স্বীকার করেছেন, অনেক মেয়েকে ফুসলিয়ে তিনি সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। এরপর সেই সব সম্পর্কের দৃশ্য তিনি ভিডিওতে ধারণ করেন। তাঁকে কুষ্টিয়া পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে।
গোয়েন্দা পুলিশের সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে হেলাল জানান, ২০০৬ সাল থেকে তিনি এই কাজ করে আসছিলেন। মাধ্যমিক পাস করা মেয়েরাই তাঁর টার্গেট ছিল। অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে তিনি এসএসসি পরীক্ষার সময় যাদের প্রাইভেট পড়াতেন তাদের কয়েকজনের সঙ্গে তিনি এমন সম্পর্ক গড়েন। হেলাল জানান, নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান তিনি, বাবা ছিলেন কাঠমিস্ত্রি। কুষ্টিয়া কলেজ থেকে গণিতে এমএ পাস করে ২০০১ সালে কুষ্টিয়ার কবুরহাট স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। হেলালের সাত বছরের একটি সন্তান আছে। ২০০৩ সালে তিনি বর্তমান কর্মস্থল আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গণিতের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।
হেলাল বলেন, ২০০৫ সালের দিকে প্রাইভেট পড়াতে গিয়ে এক মেয়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক শুরু হয়। এ নিয়ে তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া বাধে। এরপর ওই মেয়েটির সঙ্গে মেলামেশার জন্য কুষ্টিয়া শহরের বাবর আলী লেনে সোনালী ব্যাংকের পাশে একটি বাসা ভাড়া নেন। হেলাল বলেন, বাসা ভাড়া নেওয়ার কাজে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশলী আলিমুজ্জামান ওরফে টুটুল, যুবলীগ নেতা মনিরুল ইসলাম ওরফে মনো তাঁকে সহায়তা করেন। পরে প্রকৌশলী শরিফুল ইসলাম ওরফে সজল ও প্রকৌশলী হাসানুজ্জামান হাসান, মনিরুল ইসলামের ভাগনে দুলাল হোসেনও তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। তাঁরা সবাই ওই কক্ষটি ব্যবহার করতেন।
গোয়েন্দা কর্মকর্তা অতিরিক্ত উপকমিশনার মাহফুজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আর্থিকভাবে অসচ্ছল পরিবারের ছাত্রীরাই তাঁর শিকারে পরিণত হয়েছে। হেলাল স্বীকার করেন, কৌশলে মোবাইলে তিনি ভিডিও ধারণ করতেন। পরে কেউ তার কথামতো না চললে তাকে ভিডিওচিত্র দেখাতেন। তিনি ছাড়া আর কারা কারা এর সঙ্গে জড়িত, তার প্রমাণ হিসেবে তিনি অন্যদের ভিডিও ধারণ করেছিলেন। ঘটনা জানাজানির পর হেলাল তাঁর ল্যাপটপটি মাটিতে পুঁতে ফেলেন। পরে পুলিশ সেটা উদ্ধার করে।
গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, ভিডিও ধারণের ঘটনা নিয়ে মামলা হওয়ার পর হেলাল ঢাকায় এসে আত্মগোপন করেন। তিনি মোহাম্মদপুরে বেনামে বাসা ভাড়া দেন। বাড়িওয়ালাকে জানান, চাকরির খোঁজে তিনি ঢাকায় এসেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনায় হওয়া মামলার প্রধান দুই আসামিকে কুষ্টিয়া পুলিশ ইচ্ছে করেই ধরছে না।
আমাদের কুষ্টিয়া অফিস জানায়, হেলাল উদ্দীন গ্রেপ্তারের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর হেলালের গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়া সদর উপজেলার হাটশ হরিপুর গ্রাম, কুষ্টিয়া শহরের বাসিন্দা ও ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা তাঁর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।
কুষ্টিয়ার মানবাধিকার কর্মী আইনজীবী কামরুন্নাহার বলেন, হেলাল নিজের ছাত্রীদের ফাঁদে ফেলে তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। তাঁর কারণে ওই সব পরিবারের সদস্যরা সামাজিকভাবে হেয় হয়েছেন।
৭ জুলাই কুষ্টিয়া মডেল থানায় পুলিশ বাদী হয়ে চারজনকে আসামি করে মামলা করে। বাংলাদেশ পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২-এর ৮(১) (৬) ও (৭) ধারায় করা মামলায় হেলাল ছাড়াও অন্য আসামিরা হলেন প্রকৌশলী আলিমুজ্জামান ওরফে টুটুল, ডিপ্লোমা প্রকৌশলী শরিফুল ইসলাম ওরফে সজল ও ডিপ্লোমা প্রকৌশলী হাসানুজ্জামান হাসান। তাঁরা সবাই হেলালের গ্রামের বাসিন্দা। হাসানুজ্জামানকে ৮ জুলাই কুষ্টিয়া মডেল থানা-পুলিশ গ্রেপ্তার করে। গত বৃহস্পতিবার হেলালের সহযোগী মনিরুল ইসলাম ওরফে মনোকে (মামলার এজাহারে নাম ছিল না) গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায় কুষ্টিয়া গোয়েন্দা পুলিশ। আসামি আলিমুজ্জামান ও শরিফুল এখনো পলাতক।
মামলাটি কুষ্টিয়া গোয়েন্দা শাখায় স্থানান্তর করা হলে গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম আজাদ তা তদন্ত করছেন। আজাদ প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, হেলালকে আজ সোমবার কুষ্টিয়ায় আনা হবে।