কৃষি আবহাওয়ার তথ্য পাচ্ছে না বরিশালের কৃষক
বরিশালে কৃষি আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য স্থাপিত কৃষি আবহাওয়া প্রযুক্তি কৃষকদের কোনো কাজে আসছে না। জেলায় ৫৮টি ইউনিয়নে এই স্বয়ংক্রিয় রেইন গজ মিটার এবং তথ্য বোর্ড রয়েছে। এসব যন্ত্রপাতির বেশির ভাগই অকেজো পড়ে আছে।
এ অবস্থায় যন্ত্রপাতি আধুনিকায়ন করে প্রকল্পের মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়ানো হচ্ছে। এ জন্য ৯৪ কোটি টাকার বর্ধিত প্রকল্প প্রস্তাব গতকাল মঙ্গলবার একনেকে পাস হয়েছে বলে প্রকল্প পরিচালক মো. শাহ কামাল খান নিশ্চিত করেছেন।
বরিশাল সদর ও বাবুগঞ্জ উপজেলার ছয়টি ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) গিয়ে এই কাজের জন্য স্থাপিত স্বয়ংক্রিয় রেইন গজ মিটার এবং তথ্য বোর্ডের কার্যক্রম সচল পাওয়া যায়নি। কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, বরিশালের বিভিন্ন উপজেলায় ৫৮টি ইউনিয়নে রেইন গজ এবং তথ্য বোর্ড থাকলেও সচল মাত্র ১৯টি।
এই যন্ত্রের মাধ্যমে তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বায়ুপ্রবাহ, বৃষ্টিপাত, ঝড়ের পূর্বাভাস, আলোকঘণ্টাসহ ১০টি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ ও তা প্রকাশের ব্যবস্থা রয়েছে।
কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় ‘কৃষি আবহাওয়া তথ্যপদ্ধতি উন্নতিকরণ’ শীর্ষক প্রকল্পের অধীনে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর দেশের বিভিন্ন উপজেলায় ৪ হাজার ৫১টি ইউপিতে অটোমেটিক রেইন গজ এবং কৃষি আবহাওয়া ডিসপ্লে বোর্ড স্থাপন, ৪৮৭টি উপজেলায় কিওস্ক স্থাপন ও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের আবহাওয়াবিষয়ক তথ্য পাঠানোর জন্য ইন্টারনেট কানেকটিভিটিসহ ৬ হাজার ৬৬৪টি ট্যাব সরবরাহ করা হয়। দুই বছরের এই প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ ছিল ১১৯ কোটি টাকা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আওতায় এই কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মাঠপর্যায়ের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এসব কর্মকর্তাকে তথ্য সংগ্রহের জন্য একটি করে ট্যাব দেওয়া হয়। তাঁরা কৃষকদের বা উপকূলীয় এলাকায় জেলে থেকে শুরু করে ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীকে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়ার কথা।
এ জন্য প্রকল্পভুক্ত ইউপির ছাদে রেইন গজ মিটার ও সৌরবিদ্যুতের প্যানেল বসানো হয়েছিল। আর আবহাওয়ার তথ্য হালনাগাদ করার জন্য তথ্য বোর্ড স্থাপন করা হয়েছিল পরিষদ চত্বরের দর্শনীয় স্থানে।
নিয়ম অনুযায়ী, ৬ দিনের আবহাওয়ার হালনাগাদ তথ্য এই বোর্ডে আপডেট থাকার কথা। কিন্তু বরিশালের বিভিন্ন ইউপিতে স্থাপন করা এসব বোর্ডে তথ্য কবে হালনাগাদ করা হয়েছে, সে সম্পর্কে কেউ ওয়াকিবহাল নয়।
সরেজমিন কয়েকটি ইউনিয়নে দেখা গেছে, কোথাও বোর্ড জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে। আবার কোথাও সংখ্যা গণনার ঘুঁটিগুলো অকেজো।
সম্প্রতি সদর উপজেলার চন্দ্রমোহন ইউপিতে কথা হয় ৯ নম্বর টুমচর ওয়ার্ডের বাসিন্দা কৃষক নাসির উদ্দিন সিকদারের সঙ্গে। ইউপি ভবনের ছাদে থাকা স্বয়ংক্রিয় রেইন গজ মিটার ও নিচে থাকা আবহাওয়ার তথ্য বোর্ড সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাগো জন্য সরকারের কত কর্মসূচি অথচ কোনো কার্যকারিতা নেই। আমার বাড়ি কালাবদর নদের পারে। মানুষের কাছ থেকে বা টেলিভিশনের মাধ্যমে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার খবর পাই। আর এই বোর্ডে এক সপ্তাহের আবহাওয়ার খবর দেওয়ার কথা, এর কিছুই করা হয় না।’
এখানে টেকনিক্যাল বিষয় জড়িত বলে তাঁরা মৌসুমিভিত্তিক চাষি এবং উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেন এই পদ্ধতি নিয়ে। যাতে বৃষ্টি মাপা, দৈনন্দিন আবহাওয়ার তথ্য নিরূপণ করা সহজ হয়। এ জন্য উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের মুঠোফোন নম্বর চাষিদের কাছে দেওয়া হয়। জেলায় ৫৮টি ইউনিয়ন বা ব্লকে রেইন গজ এবং তথ্য বোর্ড থাকলেও সচল মাত্র ১৯টি।মোসাম্মাৎ মরিয়ম, ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক, কৃষি অধিদপ্তর
একই গ্রামের মো. নাসির উদ্দিন নামের আরেক কৃষক বলেন, ‘আবহাওয়ার তথ্য পেলে আমাদের কৃষিকাজে বেশ উপকার হতো। কখন পানির চাপ বাড়বে, বীজতলা তলাবে কি না বা কদিন বাদে ধান লাগালে ভালো হবে, এমন তথ্য পেলে আমাদের উপকার হতো।’
চন্দ্রমোহন ইউপির সচিব সুবোধ চন্দ্র দাস বলেন, পরিষদ ভবনের ছাদে ড্রামাকৃতির একটি যন্ত্র বসানো আছে, সঙ্গে সোলার প্যানেল। আর তথ্য বোর্ড রয়েছে ভবনের নিচতলায়। এর কাজ কী, তিনি নিজেই জানেন না।
কৃষি আবহাওয়া তথ্য বোর্ডের দায়িত্বে থাকা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা শাকুরুর রহিম বলেন, ছয় মাস হলো তিনি চন্দ্রমোহনে এসেছেন। আর এই বোর্ড অপারেট করার বিষয়ে কোনো প্রশিক্ষণও তিনি পাননি। এ সময় একই ইউনিয়নের ৪, ৫ ও ৭ নম্বর ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, আবহাওয়া তথ্য বোর্ড নষ্ট। তবে তাঁর মুঠোফোন নম্বর দেওয়া আছে কৃষকদের গ্রুপপ্রধানের কাছে। তাঁদের মাধ্যমে আবহাওয়ার তথ্য এবং পরামর্শ দেন তিনি।
বাবুগঞ্জ উপজেলার বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ইউপিতে গিয়ে দেখা যায়, বোর্ড টাঙানো আছে ঠিকই। কিন্তু তথ্য হালনাগাদ হয় না। এই ইউপির একজন সদস্য বলেন, ‘সদ্য নির্বাচিত হয়েছি। তাই এই বোর্ডের কাজ কী, তা জানা নেই।’
কৃষি অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক মোসাম্মাৎ মরিয়ম প্রথম আলোকে বলেন, এখানে টেকনিক্যাল বিষয় জড়িত বলে তাঁরা মৌসুমিভিত্তিক চাষি এবং উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেন এই পদ্ধতি নিয়ে। যাতে বৃষ্টি মাপা, দৈনন্দিন আবহাওয়ার তথ্য নিরূপণ করা সহজ হয়। এ জন্য উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের মুঠোফোন নম্বর চাষিদের কাছে দেওয়া হয়। তিনি আরও বলেন, জেলায় ৫৮টি ইউনিয়ন বা ব্লকে রেইন গজ এবং তথ্য বোর্ড থাকলেও সচল মাত্র ১৯টি।
এই প্রকল্পের পরিচালক মো. শাহ কামাল খান বলেন, দুই বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের সময়সীমা ২০২১ সালের জুনে শেষ হয়েছে। এখন এসব যন্ত্রপাতি আধুনিকায়ন করে সামনে আরও দুই বছর মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য ৯৪ কোটি টাকার বর্ধিত প্রকল্প প্রস্তাব গতকাল একনেকে পাস হয়েছে।
সচেতন নাগরিক কমিটি-সনাক বরিশাল জেলার সভাপতি অধ্যাপক সাজেদা প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পটি বর্তমান সরকারের ভালো ও গণমুখী প্রকল্পগুলোর একটি। সে জন্য এই প্রকল্প বাস্তবায়নে অবহেলা-গাফিলতির কোনো সুযোগ নেই।