কেরানীগঞ্জে পাখির মতো গুলি করে মানুষ হত্যা

পালানোর পথ ছিল না। একদিকে বুড়িগঙ্গা নদীতে গানবোটে করে পাকিস্তানি সেনাদের টহল, অন্যদিকে বিলের চারপাশে সদ্য লাগানো কাঁটাতারের বেড়া। ভোররাতে আকস্মিক আক্রমণের প্রথম ধাক্কায় ওদিক দিয়ে পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে অনেকে সেই বেড়ায় আটকা পড়ে। তাদের একে একে গুলি করে মারা হয়। সেই সঙ্গে গ্রামে গ্রামে চলে ব্যাপক লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ।

১৯৭১ সালের ২ এপ্রিল ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরা, শুভাঢ্যা ও কালিন্দী ইউনিয়নজুড়ে সংঘটিত এক পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞে নিহত হন কয়েক হাজার নারী-পুরুষ ও শিশু। এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা এবং এই গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য, এদিন ভোররাত থেকে প্রায় দুপুর পর্যন্ত পরিচালিত এই গণহত্যায় শহীদদের বেশির ভাগ ছিল ২৫ মার্চ কালরাতের পর ঢাকা ছেড়ে আশ্রয় নেওয়া মানুষ। স্থানীয় মানুষ জানত কোথায়, কীভাবে লুকাতে হবে। কিন্তু আচমকা আক্রমণে আশ্রিত মানুষ দিশেহারা হয়ে ছুটেছিল খোলা মাঠ, বিল ও সড়কপথ ধরে। তারাই সেদিন পাকিস্তানি সেনাদের সহজ শিকারে পরিণত হয়।

অনেকের মতে, অপারেশন সার্চলাইটের এক সপ্তাহের মধ্যে ঢাকার আশপাশ এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী যেসব পরিকল্পিত গণহত্যা চালিয়েছে, তার মধ্যে কেরানীগঞ্জের গণহত্যাই প্রথম। কেরানীগঞ্জকে লক্ষ্যবস্তু করার অন্যতম কারণ, এই এলাকার অধিকাংশ বাসিন্দা ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের। আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি হিসেবেও এর পরিচিতি ছিল। অপারেশন সার্চলাইটের পর ঢাকা থেকে যাওয়া হাজার হাজার মানুষ এলাকাটিকে নিরাপদ আশ্রয় মনে করেছিল।

কেরানীগঞ্জে আশ্রয় নেওয়া জাতীয় নেতাদের মধ্যে ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, শাজাহান সিরাজ, সিরাজুল আলম খান, তোফায়েল আহমেদ, নূরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রবসহ আরও অনেকে।

মুক্তিযুদ্ধকালীন ঢাকা জেলা কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করা মোস্তফা মহসীন মন্টু প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রথমে বুড়িগঙ্গার ওপারে মিটফোর্ড হাসপাতালের ছাদের ওপর থেকে মর্টার আর ফ্লেয়ার মারছিল পাকিস্তানি সেনারা। আমরা তখন পটকাজোর-নেকরোজবাগের খালপথ ধরে পাঁচ কিলোমিটার দূরে অবস্থান নিই। অপারেশনের পর সন্ধ্যায় ফিরে এসে দেখতে পাই কালিন্দী, মান্দাইল, নজরগঞ্জ, কসাইভিটা, ইমামবাড়ি, নেকরোজবাগসহ কেরানীগঞ্জের মাঠ-ঘাট-ডোবায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা শত শত মানুষের লাশ। পরের দু-তিন দিন ধরে জায়গায় জায়গায় গর্ত করে এসব লাশ দাফনের ব্যবস্থা করা হয়।’

মোস্তফা মহসীন মন্টুর অনুমান, ওই দিন আড়াই থেকে তিন হাজার মানুষ নিহত হয়েছিল। বেশির ভাগই ছিল আশ্রিত।

পরদিন তৎকালীন পাকিস্তান সরকার-সমর্থিত পত্রিকা মর্নিং নিউজ-এ প্রকাশিত একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘অ্যাকশন অ্যাগেইনস্ট মিসক্রিয়ান্টস অ্যাট জিঞ্জিরা।’

সম্প্রতি কেরানীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে মনু ব্যাপারীর ঢাল, নজরগঞ্জ, কসাইভিটা ও নেকরোজবাগে কয়েকটি গণকবর চোখে পড়ে। মনু ব্যাপারীর ঢালে ওই দিন একসঙ্গে প্রায় সাড়ে চার শ মানুষকে হত্যা করা হয়। এখন সেখানে গড়ে উঠেছে একটি স্মৃতিসৌধ।

মনু ব্যাপারীর ঢাল এলাকায় ওই গণহত্যার একজন প্রত্যক্ষদর্শী নাজমা বেগম। তিনি সেদিন তাঁর স্বামী-শ্বশুর ও ননদকে হারান। সে সময় তাঁর বাড়ি ছিল জিঞ্জিরা ইউনিয়নের হাউলী গ্রামে। সম্প্রতি পুরান ঢাকার রহমতগঞ্জের বাড়িতে বসে তিনি সেদিনের স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘ভোরের আজান তখন হইছে কি হয় নাই। মিটফোর্ডের দিক থেইক্যা গুলির শব্দ শুইন্যা আমরা বাড়ির সবাই বাইর হয়্যা আসি। রাস্তায় দেখি হাজার হাজার মানুষ আর পিছন দিকে মিলিটারি। বাচ্চা কোলে মা দৌড়াইতাছে, কিন্তু বাচ্চা বাঁইচ্যা নাই।’

নাজমা বেগম আরও বলেন, ‘আমার কোলেও তখন চাইর মাসের বাচ্চা। আমরা লুকাইলাম মনু ব্যাপারীর ঢালের কাছে একটা পুকুরের মইধ্যে। অনেক মানুষ। আমার স্বামীর কোলে তাঁর ভাইয়ের ছেলে। ওরে মারল কিন্তু বাচ্চাটা বাঁইচ্যা গেল। আমারে গুলি করল পায়ে। পাখির মতন মানুষ মারছে সেদিন। লাশের ওপর লাশ।’

রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদীর একাত্তরের দশ মাস গ্রন্থে জিঞ্জিরার গণহত্যা নিয়ে বলা হয়েছে, ‘পাক সেনাবাহিনীর জিঞ্জিরা অপারেশনের কোনো তুলনা নেই সমকালীন বিশ্বে। মিলিটারিরা সেদিন জিঞ্জিরা ও বড়িশুর বাজারটি জ্বালিয়ে দেয়। চুনকুটিয়া-শুভাঢ্যা ধরে বড়িশুর পর্যন্ত পাঁচ থেকে সাত মাইল এলাকা মিলিটারি ঘিরে ফেলে এবং নারী-শিশুনির্বিশেষে যাকে হাতের কাছে পেয়েছে তাকেই গুলি করে মেরেছে। নারীদের চরমভাবে লাঞ্ছিত করেছে।’

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র-এর অষ্টম খণ্ডে মফিজুল্লাহ কবীরের একটি রচনায় লেখা হয়েছে, ‘মান্দাইল ডাকের সড়কের সামনের পুকুরপাড়ে দস্যুরা ৬০ জনকে দাঁড় করিয়ে হত্যা করে। খোলা মাঠ ও গ্রাম দিয়ে যখন গ্রামবাসী ছোটাছুটি করছিল, তখন খানসেনারা উপহাসভরে ব্রাশফায়ার করেছে। বহু অপরিচিত লাশ এখানে-ওখানে বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে ছিল।’

কেরানীগঞ্জে এই গণহত্যার দিনে শুভাঢ্যা ইউনিয়নের একটি গ্রামে লুকিয়ে ছিলেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। এই গণহত্যা নিয়ে তিনি তাঁর জিঞ্জিরা জেনোসাইড ১৯৭১ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘একটি ডোবার ভিতরে মাথা গুঁজে বসে তখন আমি এমন একটি করুণ মৃত্যু প্রত্যক্ষ করি, যা আমি কোনো দিন ভুলতে পারব না, পারিনি। আমি দেখি শেলের আঘাতে একজন ধাবমান মানুষের দেহ থেকে তার মস্তকটি বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিটকে পড়েছে আমি যে ডোবায় লুকিয়ে ছিলাম সেই ডোবার জলে, কিন্তু ওই মানুষটি তারপরও দৌড়াচ্ছে।’