কোকেন উদ্ধারের পর মামলা, পরে জানা গেল এটি কোকেনই নয়

প্রতীকী ছবি

এক কেজি কোকেন উদ্ধারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তিনজনের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করেছিল। পরবর্তী সময়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) রাসায়নিক পরীক্ষার প্রতিবেদনে উঠে আসে, পুলিশের জব্দ করা নমুনায় কোকেনের উপাদান নেই। আসামিদের কাছ থেকে উদ্ধার করা নমুনা ছিল হলুদ রঙের। দানাদার–জাতীয় পদার্থ। পরে ডিবি তিন আসামির বিরুদ্ধে আর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে অভিযোগপত্র দেয়নি।

প্রতারণার অভিযোগে তাঁদের বিরুদ্ধে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। অবশ্য অভিযোগপত্র পর্যালোচনা করে আদালত অভিমত দেন, তদন্ত কর্মকর্তা সঠিকভাবে মামলাটি তদন্ত করেননি।

জব্দ করা নমুনায় কোকেন না থাকলে, কী উপাদান ছিল, সেটিও উল্লেখ নেই প্রতিবেদনে। তাই মামলাটি পুনরায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। পিবিআই পরে নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠায় বাংলাদেশ রেফারেন্স ইনস্টিটিউট ফর কেমিক্যাল মেজারমেন্টস (বিআরআইসিএম) নামের এই সরকারি পরীক্ষাগারে। এই সংস্থাও প্রতিবেদন দিয়ে বলেছে, ডিবির জব্দ করা নমুনায় কোকেন ছিল না।

পিবিআইয়ের প্রতিবেদন বলছে, প্রতারণার উদ্দেশ্যে আসামিরা কোকেনের নামে ভুয়া পদার্থ বিক্রি করার জন্য নিজেদের হেফাজতে রেখেছিল।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও পিবিআইয়ের পরিদর্শক মুহাম্মদ মাসুদ রানা প্রথম আলোকে বলেন, ডিবির জব্দ করা এক কেজি কোকেনের নমুনায় বাস্তবে কোকেন ছিল না, সেটি দুটি সরকারি রাসায়নিক পরীক্ষাগার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। তবে জব্দ করা কথিত কোকেনে কী ধরনের রাসায়নিক উপাদান ছিল, সেটিও জানা সম্ভব হয়নি।
এ মামলায় গ্রেপ্তার তিন আসামি আজিজার, মহসিন ও মোতালেব জামিনে রয়েছেন।

কোকেনের মামলা পরে হয়ে গেল প্রতারণার মামলা

দেড় বছরের বেশি সময় আগে (২০২০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর সবুজবাগ এলাকা থেকে এক কেজি কোকেনসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সিরিয়াস ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের সদস্যরা। ওই তিনজন হলেন দিনাজপুরের আজিজার রহমান, মহসিন আলম ও মোতালেব। তাঁদের বিরুদ্ধে সবুজবাগ থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করে ডিবি পুলিশ।

মামলার এজাহারে ডিবির এসআই ছানোয়ার হোসেন দাবি করেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পারেন, সবজুবাগের ওয়াসা সড়কে কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ী কোকেন বিক্রির জন্য অবস্থান নিয়েছেন। তখন সেখানে অভিযান চালিয়ে আজিজারের কাছ থেকে একটি প্লাস্টিক ব্যাগ উদ্ধার করা হয়। সেই ব্যাগের ভেতর একটি প্যাকেটে এক কেজি কোকেন পাওয়া যায়।

মামলার বাদী ছানোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আসামিদের কাছ থেকে কথিত যে কোকেন পাওয়া গিয়েছিল, তা সত্যিকারের কোকেন–জাতীয় মাদকই মনে হয়েছিল। তাই তাঁদের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে তিনি মামলা করেন।

আসামিদের কাছ থেকে পাওয়া কথিত কোকেনের প্যাকেটের গায়ে লেখা ছিল, ‘পপি ফ্লাওয়ার্ড, কোম্পানি মেড ইন আফগানিস্তান’। এরপর জব্দ করা কোকেনের নমুনার রাসায়িনক পরীক্ষার জন্য সিআইডির প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষাগারে নেওয়া হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে সিআইডির সহকারী রাসায়নিক পরীক্ষক মজিবুর রহমান প্রতিবেদন দেন, ডিবির দেওয়া নমুনায় কোনো ‘কোকেন’ পাওয়া যায়নি।

ছয় মাস ধরে মামলাটি তদন্ত করে ঢাকার সিএমএম আদালতে আসামি আজিজার, মহসিন ও মোতালেবের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগে গত বছরের ১৮ আগস্ট অভিযোগপত্র দেয় ডিবি। অভিযোগপত্রে বলা হয়, কথিত কোকেন নেশাজাতীয় মাদক না হওয়া সত্ত্বেও এটি কোকেন বলে জনগণের কাছে মোটা অঙ্কের টাকায় বিক্রি করে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিলেন। আসামিরা সাদাপোশাকে ডিবি পুলিশকে জনগণ মনে করে বিক্রি করার সময় হাতেনাতে গ্রেপ্তার হন।

তবে পুলিশের দেওয়া অভিযোগপত্র পর্যালোচনা করে এক আদেশে আদালত বলেন, সিআইডি মামলার আলামতের রাসায়নিক পরীক্ষা করে কোনো মাদক বা কোকেন না পেলেও আলামতটা কিসের, এ সম্পর্কে কোনো মতামত দেননি। তদন্তকারী কর্মকর্তা সঠিক ও সুষ্ঠুভাবে মামলাটি তদন্ত করেননি।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক আহসান হাবিব খান প্রথম আলোকে বলেন, আসামিদের কাছ থেকে কথিত যে কোকেন উদ্ধার করা হয়, সেটির নমুনা পরীক্ষায় কোকেনের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। এ জন্য আসামিদের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে আনা অভিযোগের প্রমাণ মেলেনি। প্রতারণার অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় তাঁদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৬, ৪২০–সহ অন্যান্য ধারায় আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।

অবশ্য তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইমের অতিরিক্ত উপকমিশনার মহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আসামিরা সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের সদস্য। আসামিদের কাছ থেকে কথিত এক কেজি কোকেন উদ্ধার করা হয়েছিল। তবে রাসায়নিক পরীক্ষায় বাস্তবে কোকেনের অস্তিত্ব মেলেনি। মাদক না পাওয়ায় প্রতারণার দায়ে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।

অবশ্য পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, আসামি আজিজার রহমান ও মহসিন আলমের গ্রামের বাড়ি ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায়। দীর্ঘদিন ধরে আসামিরা মাদক ব্যবসায় জড়িত। ঢাকা মহানগরের মাদকসেবী ও খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পূর্ব থেকে তাঁদের যোগাযোগ ছিল।

তবে আসামি আজিজার রহমানের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আজিজার ধানের ব্যবসা করেন। তিনি মাদক ব্যবসায় জড়িত নন। অপর আসামি মোতালেবের আইনজীবী ওসমান গনি প্রথম আলোকে বলেন, মোতালেব পেশায় রিকশাচালক। রাস্তা থেকে ধরে তাঁকে এ মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে।