ক্যাঙ্গারু পারভেজ কোথায়?

ক্যাঙ্গারু পারভেজ
ক্যাঙ্গারু পারভেজ

নারায়ণগঞ্জের তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যা মামলার অন্যতম সন্দেহভাজন জহিরুল ইসলাম পারভেজ ওরফে ক্যাঙ্গারু পারভেজ। তিনি শামীম ওসমানের প্রধান সহযোগী। তাঁর নিখোঁজ হওয়া নিয়ে এখন শহরজুড়ে চলছে নানা আলোচনা। কেউ কেউ মনে করছেন, ওসমান পরিবারের বহু অপকর্মের সাক্ষী নারায়ণগঞ্জ যুবলীগের বহিষ্কৃত এই নেতা পারভেজ। তাই শামীম ওসমান প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে নিজেই তাঁকে গুম করাতে পারেন। আবার কারও কারও মতে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁকে আটক করেছে।ক্যাঙ্গারু পারভেজের পরিবারের দাবি, ৬ জুলাই তিনি রাজধানীর গুলশান থেকে নিখোঁজ হন। আর গত ৮ মার্চ শীতলক্ষ্যায় তানভীরের লাশ উদ্ধারের পর তার বাবা রফিউর রাব্বি নারায়ণগঞ্জ থানায় মামলা করেন। পরে ১৮ মার্চ হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে তিনি সাতজনের নামে থানায় অবগতিপত্র দেন। এতে প্রথম সন্দেহভাজন শামীম ওসমান এবং তৃতীয় হলেন ক্যাঙ্গারু পারভেজ। আরেক সন্দেহভাজন সালেহ রহমান ক্যাঙ্গারু পারভেজের স্ত্রীর মামাতো ভাই।নারায়ণগঞ্জের বেশ কিছু বাসিন্দা প্রথম আলোকে বলেছেন, ওসমান পরিবারের নির্দেশে শহরে এ পর্যন্ত বেশ কটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। পরে হত্যাকারী গুম হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। তাঁদের ধারণা, সাক্ষী না রাখার জন্য ওসমান পরিবারের লোকজনই খুন করেছে হত্যাকারীদের।স্থানীয় অনেকেই ব্যবসায়ী আশিক ইসলাম হত্যাকাণ্ডের কথা জানিয়ে বলেছেন, ২০১১ সালের ১১ মে আশিক নিখোঁজ হওয়ার পর তাঁর পরিবার শামীম ওসমানের সহযোগী সিজার ও সিদ্দিকের বিরুদ্ধে মামলা করে। নিখোঁজ হওয়ার দু-এক দিন পর আশিকের লাশ পাওয়া যায়। এর পর থেকেই নিখোঁজ সিদ্দিক। ২০১২ সালে মিঠু নামের আরেক ব্যক্তিকে হত্যার অভিযোগে সিজার ও আমিনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। মিঠু হত্যাকাণ্ডের কয়েক দিন পর কক্সবাজারে একটি হোটেলের কক্ষ থেকে আমিনের লাশ উদ্ধার হয়।গত বুধবার শামীম ওসমানের আয়োজনে নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় ক্যাঙ্গারু পারভেজের সন্ধানের দাবিতে সমাবেশ হয়েছে। সেখানে পারভেজের স্বামী সোহানা দাবি করেন, মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী ও রফিউর রাব্বি পারভেজকে গুম করিয়েছেন। এর আগের দিন মঙ্গলবার শামীম ওসমানও একই অভিযোগ করেন। তাঁর সন্ধান দিতে তিনি ২৪ ঘণ্টা সময়ও বেঁধে দেন। ওই সমাবেশ শেষে শামীম ওসমানের ক্যাডাররা চাষাঢ়ায় শহীদ মিনারে তানভীরের ছবি ছিঁড়ে ফেলে সেখানে ক্যাঙ্গারু পারভেজের ছবি সেঁটে দিয়েছে।এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে শামীম ওসমান প্রথম আলোকে বলেন, পারভেজের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে তাঁর স্ত্রী চিৎকার করে বলেছেন। তাঁকে যখন তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন তাঁর স্ত্রী গাড়িতে ছিলেন। তিনি দেখেছেন। সোহানা বেগমের অভিযোগ প্রসঙ্গে রফিউর রাব্বি বলেন, ‘ত্বকী হত্যার ঘটনায় শামীম ওসমান, তাঁর ছেলে অয়ন ওসমান ও ক্যাঙ্গারু পারভেজ অন্যতম সন্দেহভাজন। শামীম ওসমান ত্বকী হত্যাকাণ্ড থেকে নিজে বাঁচতে ও অন্যদের বাঁচাতে এই নাটক সাজিয়েছেন।’গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আসলে কী ঘটেছে, তা তাঁরা খুঁজে দেখছেন। তাঁরা ক্যাঙ্গারু পারভেজকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন।

কে এই ক্যাঙ্গারু পারভেজ: ১৯৯৬ সালে শামীম ওসমান নারায়ণগঞ্জের সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর ক্যাঙ্গারু পারভেজ তাঁর ক্যাডার বাহিনীতে যুক্ত হন। তিনি চাষাঢ়ার একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। তাঁর সহোদরেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন। তিনি পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন বহু বছর। এবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ক্যাঙ্গারু পারভেজ হয়ে ওঠেন শামীম ওসমানের প্রধান সহযোগী। গতকাল চাষাঢ়ায় শহীদ মিনারে আয়োজিত সমাবেশে সোহানা বলেন, শামীম ওসমানকে ভালোবাসা ছাড়া তাঁর স্বামী আর কোনো অন্যায় করেননি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তিন দিন আগে সেনাবাহিনী পঞ্চবটী এলাকায় ক্যাঙ্গারু পারভেজকে অত্যাধুনিক দুটি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র, বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, মুখোশ, বিপুল পরিমাণ গুলিসহ গ্রেপ্তার করে। কয়েক মাস পর জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। ফেরেন ২০০৯ সালে শামীম ওসমান ফেরার কয়েক দিন পরে। শহরে ঢুকেই শামীম ওসমানের আশীর্বাদে পারভেজ চাঁদাবাজি, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়, অস্ত্রের মহড়া দেওয়াসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত ছিলেন।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, ক্যাঙ্গারু পারভেজ ২০১০ সালের ২ সেপ্টেম্বর চাঁদার দাবিতে শহরের উত্তর চাষাঢ়ায় ব্যবসায়ী শাখাওয়াত হোসেনের বাড়িতে হামলা চালান। ২০১১ সালের ৪ জুলাই শহরের উত্তর মাসদাইর এলাকার ব্যবসায়ী আল আমিনকে অপহরণ করে ৪০ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায়, একই বছরের ১২ জুলাই ঝুট চেয়ে না পেয়ে ফতুল্লার একটি রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানার ঊর্ধ্বতন তিন কর্মকর্তাকে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে নির্যাতন, একই কারণে রপ্তানিমুখী অপর এক প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মনির হোসেনকে অপহরণ করে নির্যাতনসহ নানা অভিযোগ রয়েছে পারভেজের বিরুদ্ধে।

গত ২ মার্চ ক্যাঙ্গারু পারভেজ শহরের জনাকীর্ণ উকিলপাড়া এলাকায় পুলিশের সামনে প্রকাশ্যে অবৈধ অস্ত্র হাতে মহড়া দেন। ৪ মার্চ প্রথম আলোতে এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনও ছাপা হয়। এসব ঘটনায় ভুক্তভোগীরা পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ করলেও শামীম ওসমানের চাপে তাঁরা অভিযোগ প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন।

নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম বলেছেন, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর গত চার মাসে পারভেজের বিরুদ্ধে কেউ কোনো অভিযোগ করেননি। শুধু রফিউর রাব্বি তানভীর হত্যায় তাঁকে দায়ী করে পুলিশকে অবগতিপত্র দিয়েছেন।

তবে ক্যাঙ্গারু পারভেজ সর্বশেষ গত ২৮ এপ্রিল শহীদ মিনারে ত্বকী মঞ্চের সমাবেশে রফিউর রাব্বিকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করলে জনতা তাঁকে আটক করে পুলিশে দেয়। পরে গভীর রাতে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার পুলিশ তাঁকে ছেড়ে দেয়।