ক্লান্ত শরীর, পেটে ক্ষুধা

রাখাইন রাজ্য থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা একদল রোহিঙ্গা গতকাল বাংলাদেশে ঢুকেছে। টেকনাফের হোয়াইক্যংয়ের লম্বাবিল খালের ওপারে নৌকার জন্য অপেক্ষা করছে তারা l ছবি: আশরাফুল আলম
রাখাইন রাজ্য থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা একদল রোহিঙ্গা গতকাল বাংলাদেশে ঢুকেছে। টেকনাফের হোয়াইক্যংয়ের লম্বাবিল খালের ওপারে নৌকার জন্য অপেক্ষা করছে তারা l ছবি: আশরাফুল আলম

চোখের সামনে গুলিতে মারা গেছেন আবদুল বাসেতের বাবা ফয়েজুল্লাহ (৪৫)। শোকের জন্যও সময় লাগে। সেই সময়টুকুও পাননি বাসেত। নিজের প্রাণ বাঁচাতে বাবার লাশ ফেলে রেখেই ছুটে পালিয়েছেন তিনি। শুক্রবার সন্ধ্যায় তিনি বসে ছিলেন টেকনাফ বাসস্ট্যান্ডের সামনে। সেখানে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসা জনা চল্লিশ শিশু-নর-নারীর সঙ্গে তিনিও ছিলেন। প্রায় দুই দিন চলার পর তাঁদের এই সাময়িক বিশ্রাম। তখনই বাসেত বলছিলেন কী ঘটেছিল।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংগদু জেলার রাচি দং থানার ডুমছের গ্রামে বাসেতের বাড়ি। মা-বাবাসহ তাঁদের ছয়জনের পরিবার। জমি ছিল প্রায় ১৫ বিঘা। গরু আটটি। তেমন অভাব ছিল না। সবকিছুই গেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর রোষানলে পড়ে। বাসেত বলছিলেন, সেনাবাহিনীর লোকেরা ঈদের আগের দিন গ্রামে এসে তাঁদের গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হুকুম দেয়। অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে চলেও যেতে থাকেন। যাঁরা যাচ্ছিলেন না, দুই দিন আগে তাঁদের গ্রামের একটি ধানখেতে নিয়ে জমায়েত করে সেনারা। তারপর তাঁদের মাথার ওপর দিয়ে, আশপাশ দিয়ে টানা গুলি চালাতে থাকে। এতে প্রাণভয়ে সবাই দৌড়ে পালাতে থাকেন। কেউ কেউ গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যান। তাঁদের মধ্যে বাসেতের বাবাও ছিলেন। তাঁর পেটের ডান পাশে গুলি লেগে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায়। তৎক্ষণাৎ মৃত্যু। বাবার লাশ ফেলে রেখে অন্যদের মতোই জন্মের ভিটেমাটি ছেড়ে ছুটতে হয়েছে বাসেতকে।

তাড়া খাওয়া মানুষের ছুটে চলা

জন্মস্থান, পৈতৃক ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হওয়া হাজার হাজার রোহিঙ্গা ঢুকছে টেকনাফে। ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত, সর্বহারা, শোকাতুর এসব মানুষকে দেখা যায় কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের পাশ দিয়ে লম্বা সারিতে হাঁটতে। চলতে চলতে কেউ কেউ পথের পাশেই বসে পড়ে। কেউ কেউ শহরের কোনো বাড়ি বা দোকানের সামনে, কেউ গাছতলায়, পাহাড়ের ঢালের পাশে দল বেঁধে বসে থাকে। তাদের কিছু করার নেই, কোনো গন্তব্য নেই। আসলে প্রাণ ছাড়া তাদের বলতে গেলে আর কিছুই নেই। খাবারের প্রচণ্ড সংকট। কেউ কেউ নিজের টাকায় কিছু কিনে খাচ্ছে। কখনো কখনো পাচ্ছে সামান্য ত্রাণ।

নির্যাতনের কথা

রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বসতবাড়ি থেকে উৎখাত করতে বিশেষ কিছু কায়দায় নিপীড়ন চালানো হচ্ছে বলে জানালেন মংগদুর নাপিতের দ্বীপ গ্রামের আনোয়ারা বেগম। সেনাবাহিনী ও পুলিশের লোকেরা একেকটি গ্রামে এসে প্রথমে লক্ষ্য করে সেখানকার ধনী বা গ্রামপ্রধানকে। তাঁদের বাড়িতে আগুন লাগায়। বাড়ির লোকদের মারধর করে বা হত্যা করে। নারীদের নির্যাতন ও ধর্ষণ করে। গ্রামের মাথা-মুরব্বিদের এই অবস্থা দেখে গরিব, দুর্বলেরা বিনা প্রশ্নে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে শুরু করে।

নাপিতের দ্বীপের হাজি রফিক ও ইসাহাকের পাকা বাড়ি রকেট লঞ্চার দিয়ে গোলা ছুড়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আরেক গণ্যমান্য ব্যক্তি আবু হাসানের বাড়িতে আগুন দিয়ে বাড়ির নারী-পুরুষ সবাইকে প্রকাশ্যে বেধড়ক পিটিয়ে গ্রাম থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। গত ২৫ আগস্ট থেকে এই কায়দায় নির্যাতন চলছে বলে টেকনাফে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানালেন।

আনোয়ারা বেগমেরও অবস্থা সচ্ছল ছিল। তাঁর স্বামী আবদুস সালাম মালয়েশিয়ায় শ্রমিকের কাজ করেন। তিনি সেখান থেকে আসতে পারেননি। দুই কিশোরী মেয়ে আর এক শিশুছেলেকে নিয়ে আনোয়ারা পলায়নপর জনস্রোতের সঙ্গে ছোটেন। গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে নৌকায় নাফ নদী পেরিয়ে পরদিন এসে উঠেছেন টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে।

যাও, যাও, যাও...

টেকনাফের মিয়ানমারে যে রোহিঙ্গা জনস্রোত এসে আছড়ে পড়ছে, তাদের অধিকাংশই আসছে নাফ নদী পেরিয়ে। রাখাইন রাজ্যের মংগদু, আকিয়াব, গুচিডং, রাচিডং—এসব জেলা ও থানার রোহিঙ্গারা নাফ নদীর আশপাশের সীমান্তবর্তী পাহাড়ি জঙ্গলে এসে লুকিয়ে থাকে। রাচিডং থানার নূর ইসলাম জানালেন, বর্মি (তাঁরা মিয়ানমারকে বর্মি বলেন) সেনারা গ্রামের লোকদের এক জায়গায় সমবেত হতে হুকুম করে। এরপর তারা গ্রাম থেকে চলে যেতে বলে। ‘যাও, যাও, যাও’ বলে তাদের তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয় নাফ নদীর তীর বরাবর বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে। বাধ্য হয়ে হাজার হাজার মানুষ সীমান্তঘেঁষা প্যারাবন ও পাহাড়ি জঙ্গলে লুকিয়ে থাকে। পরনের কাপড়, একটি-দুটি হাঁড়ি-পাতিল আর টাকা যার কাছে যা থাকে তাই নিয়ে তাঁরা ঘরবাড়ি ফেলে চলে আসেন। মূল্যবান বিবেচনা করে কেউ কেউ তাঁদের বাড়ির সোলার প্যানেল পিঠে করে বয়ে আনেন জঙ্গলে। তারপর অপেক্ষায় থাকেন নৌকার। গ্রাম থেকে বের হয়ে আসার পর আর ফিরে যাওয়ার উপায় থাকে না। কারণ গ্রামে পুলিশ ও সেনাবাহিনী পাহারা দিচ্ছে। তারা কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না।

জনপ্রতি ৩ থেকে ১০ হাজার

নাফ নদীই মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সীমান্তরেখা। নদীর স্রোত গিয়ে মিশে যায় বঙ্গোপসাগরে আর রাতে নৌকায় ভেসে ভেসে রোহিঙ্গা জনস্রোত এসে পড়ছে বাংলাদেশে। মংগদুর গর্জনদিয়া গ্রামের সৈয়দ মোহাম্মদ তাঁর স্ত্রী সেতারা বেগম, দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে গত বৃহস্পতিবার এসে পৌঁছান টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে। তারপর সেখান থেকে খানিকটা হেঁটে, খানিকটা টমটমে (ব্যাটারিচালিত বাইককে এখানে টমটম বলে) চড়ে শুক্রবার দুপুরে এসেছেন টেকনাফ শহরের পানবাজারে। তিনি বললেন, নদী পার হতে তাঁদের জনপ্রতি ১০ হাজার বাংলাদেশি টাকা খরচ হয়েছে। পাঁচজনের ৫০ হাজার টাকা। গত মঙ্গলবার তাঁদের গ্রামে পাঁচ ট্রাক পুলিশ ও সেনা এসে ওই একই কায়দায় সবাইকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলে। সৈয়দ মোহাম্মদ পেশায় নৌকার মিস্ত্রি। জমি ছিল প্রায় আট বিঘা। তাঁদের সঙ্গে আরও ৫ জন মোট ১০ জনে ১ লাখ টাকার চুক্তিতে নৌকা ভাড়া করে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে শাহপরীর দ্বীপে আসেন।

এসব নৌকায় সাধারণত ২৫ থেকে ৩০ জন পর্যন্ত তোলা হচ্ছে। রাতে অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে নদী পার হতে গিয়ে প্রায়ই নৌকা ডুবে যায়। এ পর্যন্ত ১৯টি নৌকাডুবির কথা শোনা যায় টেকনাফে। লাশ উদ্ধার হয়েছে ৯৩ জনের। নৌকায় নদী পার হয়ে আসা মংগদুর হাসুরাতা গ্রামের আবদুল আমিন বললেন, তিনি পার হয়েছেন ৩ হাজার টাকায়। এটাই সর্বনিম্ন। দরদাম নির্ভর করে লোকসংখ্যার ওপর। বেশি লোক নৌকায় উঠলে দাম কমে।

রাখাইনের সীমান্তসংলগ্ন জঙ্গল থেকে রাতে লোকেরা নৌকায় ওঠে। নৌকা আসে সাগরের কোল ঘেঁষে। ইঞ্জিনচালিত নৌকায় সময় লাগে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা আর বৈঠার নৌকায় তিন থেকে চার ঘণ্টা। খরচ উভয় নৌকায় একই। শাহপরীর দ্বীপের বেশ খানিকটা দূরে প্রায় বুকপানিতে রোহিঙ্গাদের নামানো হয়। রাতটি শাহপরীর দ্বীপে কাটিয়ে পরদিন তারা রওনা দেয় জীবনের নতুন পথে। এপারে এসে রোহিঙ্গারা যা পায় তা হলো মৃত্যুর আতঙ্ক থেকে মুক্তি।