ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নারী নিপীড়নের যে তথ্য দিল কাপেং ফাউন্ডেশন
কক্সবাজারের টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের লালা অং চাকমার মেয়ে লাকিং মে চাকমা। স্থানীয় একটি স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী ছিল সে। লাকিং মে–কে ২০২০ সালের ৫ জানুয়ারি সন্ধ্যায় নিজ বাড়ি থেকে স্থানীয় যুবক আতাউল্লাহর নেতৃত্বে কয়েকজন ‘অপহরণ’ করে। পরে কুমিল্লায় নিয়ে জোর করে ধর্মান্তর ও বাল্যবিবাহ করা হয়।
অপহরণের ঘটনার পর লাকিং মের বাবা টেকনাফ মডেল থানায় অপরহণের মামলার চেষ্টা করেন। লাকিং মের বাবার ভাষায়, সে সময় পুলিশের আশানুরূপ সহায়তা না পেয়ে জেলার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে তিনি মামলা করেন। ট্রাইব্যুনালের বিচারক ওই অপহরণের ঘটনার তদন্ত পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কাছে হস্তান্তর করেন।
পিবিআই ২০২০ সালের আগস্ট মাসে তদন্ত শেষে তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, সে সময় মেয়েটি ‘নিজে থেকেই অজ্ঞাত স্থানে চলে যায়’। আর যাঁদের বিরুদ্ধে অপহরণের অভিযোগ আনা হয়েছে, তাঁদের ‘অপরাধ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়নি।’
ওই বছরের ৯ ডিসেম্বর আতাউল্লাহর ঘরে মারা যায় লাকিং মে। মারা যাওয়ার ১২ দিন আগে জন্ম দেয় একটি কন্যাসন্তান। লাকিং মের মৃত্যুর পর তার লাশ দাফন নিয়ে তার পরিবার ও আতাউল্লাহর পরিবারের মধ্যে বিরোধ বাধে। কক্সবাজার সদর হাসপাতালের হিমঘরে টানা ২৫ দিন ধরে পড়ে থাকে তার লাশ। পরে আদালতের নির্দেশে ১৫ বছর বয়সী মেয়েটির লাশ ফেরত পান তার স্বজনেরা।
এ ঘটনা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। লাকিং মে অপহরণ ও হত্যা মামলা এখন র্যাবের তদন্তাধীন।
মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী মহিউদ্দিন খান গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বুধবার এর তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার কথা রয়েছে।’
দেশে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নারী ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে নিগ্রহের ঘটনাও। ধর্ষণসহ বেশির ভাগ যৌন নিপীড়নের ঘটনা বেশি পার্বত্য চট্টগ্রামে। করোনাকালে গত দুই বছরে নিপীড়নের সংখ্যা এর আগের বছরের চেয়ে বেশি। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান কাপেং ফাউন্ডেশনের গবেষণায় এ তথ্য পাওয়া গেছে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক (কর্মসূচি) নীনা গোস্বামী প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনাকালে পাহাড় ও সমতল সবখানে নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে। পাহাড়ের দুর্গমতা নারীদের অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ফেলে। অপরাধী চক্র এর সুযোগ নেয়।’
কাপেং ফাউন্ডেশন ২০০৭ সাল থেকে দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয় নিয়ে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নথিবদ্ধ করে। এর পাশাপাশি নিজেরাই এসব ঘটনার তথ্যানুসন্ধান করে গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করে।
কাপেং ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত বছর (২০২১) সমতল ও পাহাড়ে মোট ২২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে চারজন নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। ধর্ষণের চেষ্টা ছিল ১২টি। অপহরণ, পাচার ও নিগ্রহের ঘটনা ছিল একটি করে। শারীরিক হেনস্তার শিকার হন দুজন। সব মিলিয়ে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৪২টি।
২০২০ সালে মোট নিপীড়নের সংখ্যা ছিল ৬২টি। এর মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে ২০টি। আর দুই নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। শারীরিক হেনস্তার শিকার হন ১৬ জন। আর অপহরণের শিকার হন ছয়জন। এ বছর ঘটা নিপীড়নের ঘটনা তার আগের বছরের বা ২০১৯ সালের দ্বিগুণ। ২০১৯ সালে মোট নিপীড়নের ঘটনা ছিল ৩৩টি। ধর্ষণের ঘটনা ছিল ১০টি। আর ধর্ষণের চেষ্টা, অপহরণসহ অন্য নিপীড়নের সংখ্যা ছিল ২৩টি।
কাপেং ফাউন্ডেশনের সমন্বয়ক (প্রকল্প) ফাল্পুনী ত্রিপুরা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর যেসব নারী সহিংসতার শিকার হচ্ছেন, তাঁদের প্রায় সবাই আর্থিক ও সামাজিকভাবে প্রান্তিক। তাঁদের সংগতি একেবারেই কম। অন্যদিকে তাঁদের নিপীড়নকারীরা অনেক প্রভাবশালী। লাকিং মের ঘটনা এর একটি উদাহরণ। তাই অপরাধ হলেও বিচার হয় কমই।’
কাপেংয়ের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত বছর ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নারীদের ওপর সহিংসতার যে ৪২টি ঘটনা ঘটেছে, এর মধ্যে ২৪টিই ঘটেছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। ২২টি ধর্ষণের ঘটনার মধ্যে ১২টিই পাহাড়ে হয়েছে। এসব ঘটনায় ভুক্তভোগী নারীদের সংখ্যা ৪৬ জন। আর এর মধ্যে ২৪ জনই পাহাড়ের।
দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারীদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা এবং হার ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ার বিষয়টিতে দীর্ঘদিন ধরেই উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুযায়ী, এখনো স্থানীয় সরকারে, প্রশাসনে, ক্ষমতা হস্তান্তর হয়নি। তাই সেখানে পাহাড়ি নারীদের ওপর নির্যাতনের প্রতিরোধ বা প্রতিকারে রাষ্ট্র বা প্রশাসনের সহযোগিতা পাওয়া দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিশু থেকে শুরু করে নারী নির্যাতনের যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেগুলোর প্রথমত অস্বীকৃতি, মামলা না নেওয়ার প্রবণতা, তদন্ত সৎ ও সুষ্ঠু না হওয়ার মতো অসংখ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন হওয়ার তথ্য আমাদের নজরে এসেছে।’