কড়া নিরাপত্তায় প্রতিমা বিসর্জন

উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা ছিল। এর মধ্যেও বাদ্য বাজিয়ে দেবী দুর্গাকে বিদায় জানান দেশের হিন্দুধর্মাবলম্বীরা।

বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনে যাচ্ছেন ভক্তরা। গতকাল বিকেলে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের লাবণী পয়েন্টে।
ছবি: প্রথম আলো

দেবী দুর্গার প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হলো সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পাঁচ দিনের দুর্গাপূজা। কুমিল্লার ঘটনার কারণে দেশজুড়ে অনেকের মধ্যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা ছিল। বিসর্জনের দিন গতকাল শুক্রবার কয়েকটি জায়গায় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ঘটে। তবে থেমে থাকেনি প্রতিমা বিসর্জন; কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থার মধ্যে ঢাকের বাদ্য, খোল-করতাল ও গান বাজিয়ে দেবী দুর্গাকে বিদায় জানান দেশের হিন্দুধর্মাবলম্বীরা।

বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজা শুরু হয়েছিল ১১ অক্টোবর, ষষ্ঠী তিথিতে বেলতলায় ‘আনন্দময়ীর’ নিদ্রাভঙ্গের বন্দনার মাধ্যমে। গতকাল দশমী তিথিতে প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে এই উৎসব শেষ হয়। হিন্দুধর্মের অনুসারীদের বিশ্বাস, এবার দেবী এসেছিলেন ঘোড়ায় চড়ে। বিদায় নিয়েছেন দোলায়।

হিন্দু শাস্ত্রমতে, শ্বশুরবাড়ি কৈলাস থেকে কন্যারূপে দেবী দুর্গা বাপের বাড়ি মর্ত্যলোকে বেড়াতে এসেছিলেন। আর পাঁচ দিনের পূজার আনুষ্ঠানিকতা শেষে বিসর্জনের মধ্য দিয়ে তিনি আবার স্বামীর বাড়ি ফিরে যান।

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় গতকাল প্রতিমা বিসর্জনের ঘাট ঘুরে দেখা যায়, নারীদের উপস্থিতি ছিল তুলনামূলক কম। সকালের ভাগে মণ্ডপেও ভিড় তেমন একটা ছিল না। গতকাল সকালে রাজধানীর ফার্মগেটের কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন প্রাঙ্গণে সনাতন সমাজকল্যাণ সংঘের (সসকস) পূজামণ্ডপে গিয়ে দেখা যায়, দেবী দুর্গার বিজয়া দশমী বিহিত পূজা চলছে। ভক্তরা ছোট দলে মণ্ডপে আসছেন।

স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে মোহাম্মদপুর থেকে ফার্মগেটে আসেন সাধন চন্দ্র মজুমদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই পৃথিবী যেন সুন্দর ও নির্মল হয়। আমরা সবাই যেন ভালো থাকতে পারি। মা দুর্গার কাছে এই প্রার্থনাই করেছি।’

এর আগে সকালে রাজধানীর মণ্ডপ ও মন্দিরগুলোতে দশমী বিহিত পূজার আনুষ্ঠানিকতা হয়। এরপর দেবীর দর্পণ বিসর্জন। মূলত এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই দেবী দুর্গার আত্মার বিসর্জন ঘটে।

কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন প্রাঙ্গণ মণ্ডপের প্রতিমা খোলা ট্রাকে ওঠানো হয় বেলা সোয়া তিনটার দিকে। এরপর মণ্ডপ থেকে খামারবাড়ি মোড় পর্যন্ত অনেক ভক্ত বিজয়া শোভাযাত্রায় অংশ নেন। এই মণ্ডপ থেকে কোনো নারীকে এবার প্রতিমা বিসর্জনের জন্য ঘাটে যেতে দেখা যায়নি। আয়োজকেরা জানান, নিরাপত্তার স্বার্থে শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ সীমিত করা হয়েছে।

ফার্মগেটে সনাতন সমাজকল্যাণ সংঘের সাংস্কৃতিক সম্পাদক দিলীপ কুমার সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আজ (গতকাল) জুমার দিন। এ কারণে আমরা জুমার নামাজের সময়ের পরে প্রতিমা বিসর্জন দিতে বের হয়েছি।’

বিকেল চারটায় হাজারীবাগ থানাধীন বছিলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে থানা-পুলিশ, নৌ পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও বিজিবির সদস্যরা নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা নিশ্চিতে দায়িত্ব পালন করছেন। সোয়া চারটার দিকে মোহাম্মদপুর ও হাজারীবাগ থানা এলাকার বিভিন্ন মণ্ডপের প্রতিমা বিসর্জনের জন্য একে একে এই ঘাটে নেওয়া হয়। তখন বাদ্য-বাজনা ও গানে উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়। বিসর্জনের আগে শেষবারের মতো হাত জোড় করে মা দুর্গার কাছে প্রার্থনা করেন ভক্তদের অনেকে।

এদিকে বাংলাদেশ পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের পক্ষ থেকে দশমীর দিন চিরায়ত সিঁদুর খেলা বন্ধ রাখার আহ্বান জানানো হয়েছিল। তবে কিছু কিছু জায়গায় সীমিত পর্যায়ে সিঁদুর খেলা হয়। রাজধানীর ঢাকেশ্বরী দুর্গা মন্দিরে দেবী দুর্গার পায়ে সিঁদুর মাখা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল এই খেলা।

এদিকে কুমিল্লাসহ সারা দেশে পূজামণ্ডপে হামলা ও প্রতিমা ভাঙচুরের প্রতিবাদে এবং দুষ্কৃতকারীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবিতে গতকাল ঢাকেশ্বরী দুর্গা মন্দিরের ভেতরে প্রতিবাদী অবস্থান করেন বাংলাদেশ পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের নেতারা। বেলা ১১টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত এই প্রতিবাদী অবস্থান করা হয়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নির্মল কুমার চ্যাটার্জি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের উৎসবটাকে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি ম্লান করে দিয়েছে। কোনো সম্প্রদায়ের উৎসবে এত বড় হামলা আমরা চিন্তাও করতে পারি না।’ তিনি বলেন, ‘সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে রাষ্ট্র যথাযথ ব্যবস্থা নিক, এটাই আমাদের চাওয়া।’

ঢাকেশ্বরী দুর্গা মন্দিরের কাছাকাছি চকবাজার এলাকা থেকে গতকাল বিকেলে পুলিশ ছয়জনকে আটক করেছে। পুলিশ বলছে, তাঁদের সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করা হয়।

দুর্গাপূজার অষ্টমীর দিন গত বুধবার কুমিল্লায় পবিত্র কোরআন অবমাননার খবরে পূজামণ্ডপে হামলা, বিক্ষোভ ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। একই ঘটনার জেরে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে ওই দিনই চারজনের মৃত্যু হয়। বুধবার দেশের আরও কয়েকটি জায়গায় পূজামণ্ডপে হামলার ঘটনা ঘটে। এরপর বৃহস্পতিবারও বিভিন্ন স্থানে হামলার ঘটনা ঘটেছে।

প্রতিমা বিসর্জনের দিন গতকাল সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সতর্ক অবস্থানে ছিল। দেশজুড়ে ভোর থেকে বিকেল পর্যন্ত ইন্টারনেটও বন্ধ ছিল। এরই মধ্যে তিন জেলায় অন্তত ১২টি মণ্ডপে হামলার ঘটনা ঘটে। এসবের মধ্যেই বেশির ভাগ এলাকায় শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতিতে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়।

বরিশাল, খুলনা, সিলেট, শেরপুর, নওগাঁ, বগুড়া, চুয়াডাঙ্গা, রংপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাজশাহী, ফেনীসহ বিভিন্ন জেলা থেকে প্রথম আলোর প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, মন্দির-মণ্ডপ ও প্রতিমা বিসর্জনের জন্য নির্ধারিত ঘাট এলাকাগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নিরাপত্তা নিশ্চিতে দায়িত্ব পালন করেন। বাড়তি সতর্কতা হিসেবে কোথাও কোথাও বিজিবি সদস্যও মোতায়েন করা হয়। জুমার নামাজের কারণে কোনো কোনো এলাকায় সকালে বিসর্জনকাজ শেষ হয়। বেশির ভাগ এলাকায় প্রতিমা বিসর্জন হয় বিকেলে।

রংপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার আবদুল আলীম মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, রংপুরের প্রতিটি মণ্ডপে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে পূজা উদ্‌যাপিত হয়েছে। কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি।