কয়েকটি পূর্বশর্ত পূরণ না হলে আন্দোলন অহিংস থাকে না

নিরপেক্ষ প্রশাসন, কার্যকর বিচার ব্যবস্থা ও সাংবিধানিক নিয়ম-নীতি রক্ষা অহিংস আন্দোলনের পূর্বশর্ত বা রক্ষাকবচ। এগুলো রক্ষা না করলে অহিংস আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নিতে পারে। দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে এগুলো করে অহিংসা ও শান্তির নীতি সমাজে ছড়িয়ে দিতে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাব্রতী সংস্থা দি হাঙ্গার প্রজেক্টের উদ্যোগে আজ শনিবার আয়োজিত এক বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। বিশ্ব অহিংসা দিবস উপলক্ষে ভার্চ্যুয়ালি এ বৈঠকের আয়োজন করা হয়। দি হাঙ্গার প্রজেক্টের কান্ট্রি ডিরেক্টর ও গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট বদিউল আলম মজুমদার বৈঠক সঞ্চালনা করেন।

বৈঠকে লেখক ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সময় শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলন করে দাবি আদায়ের চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু প্রতিপক্ষ সহিংস পথে গেছে এবং পরাজিত হয়েছে। তবে শান্তি ও অহিংসার পক্ষেই মানুষ রায় দিয়েছে। অহিংস নীতি সমাজে ফলপ্রসূ হওয়ার প্রত্যাশা করেন তিনি।

বৈঠকে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, অহিংসার চিন্তা খুবই জটিল একটি বিষয়। বঙ্গবন্ধুও অসহযোগ আন্দোলন করেছিলেন, কিন্তু ২৬ মার্চের পর অহিংস আন্দোলনকে সশস্ত্র আন্দোলনে রূপ নিতে হয়েছে। তিনি বলেন, অহিংস আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিচার ব্যবস্থা, মৌলিক কিছু সাংবিধানিক নিয়ম-নীতি পরিপালন, প্রশাসনের নিরপেক্ষতাসহ কিছু পূর্বশর্ত থাকে। পূর্বশর্তগুলো নষ্ট হয়ে গেলে অহিংস আন্দোলন করা খুবই দুষ্কর হয়ে পড়ে। পৃথিবীতে এখন বঞ্চনা এবং বৈষম্য বেড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দারিদ্র্য ও বৈষম্য যদি থাকে, তবে এর চেয়ে বড় সহিংসতা আর কিছু হতে পারে না। তিনি বলেন, অহিংসতায় বিশ্বাস করলে বিশ্ব মানবতায় বিশ্বাস করতে হবে, এ ক্ষেত্রে সর্বজনীন মানবাধিকারের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর বলেন, সমাজ দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে, বৈচিত্র্য বাড়ছে। একটি অংশ বৈচিত্র্যকে গ্রহণ করছেন, আরেকটি অংশ ঠেকানোর চেষ্টা করছেন। যারা ঠেকানোর চেষ্টা করছেন তাঁরা যুক্তির বাইরে গিয়ে শক্তির প্রয়োগ করে সহিংস ঘটনা ঘটাচ্ছেন। প্রযুক্তির মাধ্যমে যাতে হিংসা না ছাড়ানো হয় সেই পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে সচেতন থাকলে অহিংস সমাজ গড়ার পথকে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, সহিংসতার দিক দিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে আছে। এমনকি সহিংসতার মাত্রার বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও বাংলাদেশের অবস্থা ভালো। তারপরও যে কোনো মৃত্যুই কষ্টদায়ক এবং কোনো মৃত্যুই গ্রহণযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেন এই অধ্যাপক।

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, নানান জাতি-ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষ নিয়েই আমাদের সুন্দর-সমৃদ্ধ-সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ—এই স্বীকৃতি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে থাকতে হবে। বৈচিত্র্যকে ভয় না পেয়ে উদ্‌যাপন করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ তখনই মহিমান্বিত হবে যখন একজন গারো, একজন চাকমা বা রাখাইন বলতে পারবে যে তাঁরা সমান অধিকার ও মর্যাদা ভোগ করতে পারছেন।

বৈঠকে রাজনীতিবিদ, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। লিখিত প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন দি হাঙ্গার প্রজেক্টর প্রকল্প ব্যবস্থাপক সৈকত আইচ।

দি হাঙ্গার প্রজেক্টের কান্ট্রি ডিরেক্টর বদিউল আলম মজুমদার বলেন, দি হাঙ্গার প্রজেক্ট যখন স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্যদের মধ্যে শান্তি, সম্প্রীতি সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ শুরু করে তখন দলগুলো নিজেদের মধ্যে একসঙ্গে বসতে চাইত না।

আমাদের শান্তির দূতেরা অনেক কষ্ট করে তাঁদের একসঙ্গে করে কাজ করে যাচ্ছেন।