খেলাধুলার অধিকার থেকেও বঞ্চিত পথশিশুরা

পথশিশুদের খেলাধুলার অধিকার নিয়ে আয়োজিত সেমিনারে আমন্ত্রিত অতিথিরা
ছবি: প্রথম আলো

খেলাধুলা শিশুদের অধিকার। অথচ পথশিশুরা এই অধিকার থেকে চরমভাবে বঞ্চিত। সেদিকে সরকারের নজর কম। খেলাধুলার সুযোগ না পেয়ে পথশিশুরা নেশায় আসক্ত হচ্ছে। খেলাধুলার মাধ্যমে সমতা, বিশ্বাস, নেতৃত্ব গড়ে ওঠা, নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলার মতো জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে পথশিশুরা। আজ শনিবার ‘পথশিশুদের খেলাধুলার অধিকার, তাদের জীবনের অধিকার’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।

সেমিনারটি যৌথভাবে আয়োজন করেছে এমপাওয়ারমেন্ট থ্রু ল অব দ্য কমন পিপল (এলকপ) এবং স্পোর্টস ফর হোপ অ্যান্ড ইনডিপেন্ডেন্স (শি)। রাজধানীর ধানমন্ডিতে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ল অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের (বিলিয়া) সেমিনার কক্ষে এ সেমিনারের আয়োজন করা হয়।

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) ২০১৫ সালের তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, দেশে ১৫ লাখের মতো শিশু পথে জীবন কাটায়। বেশির ভাগ পথশিশু ডাস্টবিনের ময়লা কুড়িয়ে, হকারি করে, মানুষের বোঝা টেনে ও ভিক্ষা করে জীবন যাপন করে। ৪০ শতাংশ পথশিশু দিনে একবার গোসলের সুযোগ পায় না। ৭৫ শতাংশ কোনো স্বাস্থ্যসেবা পায় না। পথশিশুদের ৮৫ শতাংশ নেশায় আসক্ত হয়।

মূল প্রবন্ধে আরও বলা হয়, খেলাধুলায় সরকারের নজর কম। মোট বাজেটের ১ শতাংশের কম খেলাধুলার জন্য বরাদ্দ, তা–ও ধর্ম ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিলিয়ে। গত অর্থবছরে বরাদ্দ ৩৫৬ কোটি টাকার কম ছিল।

পথে পথে বেড়ে ওঠা এসব শিশুর বেশির ভাগেরই মা–বাবার খোঁজ নেই। ফলে জন্মনিবন্ধন সনদও পাচ্ছে না তারা। পথশিশুদের জন্মসনদের জটিলতার বিষয়টি তুলে ধরে অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, কাতারের রাজধানী দোহায় এ বছরের অক্টোবরে পথশিশুদের বিশ্বকাপ ফুটবল অনুষ্ঠিত হবে। শুধু মেয়েদের এই আসরে অংশ নেবে ২১টি দেশ। সেখানে অংশ নেওয়ার জন্য বাংলাদেশের ১০ পথশিশু মেয়েকে ৫ মাস ধরে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কাতারে যাওয়ার পাসপোর্টের জন্য আবেদন করতে দরকার জন্মনিবন্ধন সনদ। তবে মা–বাবার খোঁজ না থাকায় এই শিশুদের তিনজনের জন্মসনদপ্রাপ্তিতে দেখা দিয়েছে জটিলতা। ওই শিশুদের মা–বাবার জন্মসনদ চাইছে প্রশাসন। জন্মসনদ না পাওয়ায় তাদের অংশগ্রহণ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

এ নিয়ে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ‘পথশিশুদের বিশ্বকাপ: জন্মসনদ পেতে জটিলতা’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ হয় প্রথম আলোতে। ১২ থেকে ১৬ বছর বয়সী ওই ১০ শিশু বাংলাদেশ লোকাল এডুকেশন অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (লিডো) নামের একটি বেসরকারি সংগঠনের আশ্রয়কেন্দ্রে থাকে। এটি ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ উপজেলার তারানগর ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) অবস্থিত। শিশুদের প্রশিক্ষণে সহায়তা দিয়েছে শি।

অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, দেশে চরম বৈষম্যপূর্ণ সমাজব্যবস্থা রয়েছে। পথশিশুদের খেলাধুলা নিয়ে কোনো আলোচনা হয় বলে শোনা যায় না। সরকারের উচিত স্কুলে স্কুলে, পাড়ায় পাড়ায় শিশুদের জন্য খেলাধুলার ব্যবস্থা রাখা।

পথশিশুদের বিশ্বকাপে অংশগ্রহণের জন্য প্রশিক্ষণ নেওয়া কয়েক শিশুর জন্মনিবন্ধন সনদ জটিলতায় আটকে থাকার বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধশিশুদের পিতার পরিচয়ের জায়গায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজের নাম বসিয়ে দিতে বলেছিলেন। রাষ্ট্রের এখন এই পথশিশুদের জন্মসনদ ও পাসপোর্টের ব্যবস্থা করা উচিত। এই শিশুদের জন্মসনদ সমস্যার সমাধান না হলে তিনি বিক্ষোভ মিছিল করবেন বলে ঘোষণা দেন।

অনুষ্ঠানে অতিথির বক্তব্যে প্রথম আলোর অনলাইন ক্রীড়া সম্পাদক উৎপল শুভ্র বলেন, শুধু পথশিশু নয়, সব শিশুর খেলাধুলার অধিকার রয়েছে। খেলাধুলার মধ্য দিয়ে না গেলে একটি শিশু পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে না। বিকেলে মাঠে গিয়ে খেলাধুলার সংস্কৃতি উঠে গেছে। অভিভাবকেরা সন্তানদের শুধু পড়াশোনার মধ্যেই যুক্ত রাখতে চান, খেলাধুলা করা সময় নষ্ট বলে মনে করেন। অথচ সন্তানকে দিনে খোলা জায়গায় অন্তত আধা ঘণ্টা খেলতে দিলে একটি শিশু নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা ও সমতা শেখার পাশাপাশি সুস্থ মানুষ হয়ে উঠতে পারে, যা তার ভবিষ্যৎ গড়ার লক্ষ্যে কার্যকরী ভূমিকা রাখবে। একটি মাঠবিমুখ প্রজন্ম তৈরির নেতিবাচক পরিণতি ১০–২০ বছরের মধ্যে প্রকট হবে। তিনি শিশুদের খেলাধুলার অধিকার নিয়ে গ্রাম–গঞ্জ–মহল্লায় সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান।

যুক্তরাজ্য থেকে অনলাইনে যুক্ত হয়ে বক্তব্য দেন এজ হিল বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক লিয়ান ওলেরি। তিনি বলেন, খেলাধুলার অধিকার হচ্ছে মানবাধিকার। প্রত্যেকে যেন খেলাধুলায় অংশগ্রহণের সুযোগ পায় তা নিশ্চিত করতে হবে।
সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন ধারাভাষ্যকার রবিউল ইসলাম। স্বাগত বক্তব্য দেন এলকপ–এর নির্বাহী পরিচালক তাপস কান্তি বল। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন শি–এর ক্রীড়া সমন্বয়ক পাপ্পু মোদক। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মাসুম বিল্লাহ। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন শি–এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শারমিন ফারহানা চৌধুরী।