খড়-মাটি-বাঁশের চোখ জুড়ানো আনন্দালয়

নকশা করেছেন জার্মান স্থপতি আন্না হেরিংগার। এই ভবনের জন্য তিনি এ বছর ‘ওবেল অ্যাওয়ার্ড’ পান।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দীপশিখা চত্বরে বাঁশ-মাটি-খড় দিয়ে তৈরি দ্বিতল ভবন। এখানে প্রতিবন্ধীদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হচ্ছে। গত সোমবার দিনাজপুরের বিরল উপজেলার মঙ্গলপুর ইউনিয়নের রুদ্রপুর গ্রামে
ছবি: রাজিউল ইসলাম

দূর থেকে স্থাপনাটিকে দেখলে মনে হবে ডানা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কোনো ইগল। বাঁশ-কাঠ-খড়-মাটি দিয়ে তৈরি হয়েছে দ্বিতল ভবনটি। দোতলার করিডোরে বাঁশের চাটাই দিয়ে খোপ খোপ করে বেড়া দেয়া হয়েছে। নিচতলার বারান্দায় প্রতিটি খুঁটিতে নির্দিষ্ট মাপের তিনটি করে বাঁশ–দঁড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা (ফ্রেপিং করা)। মাটির সঙ্গে খড়ের সংমিশ্রণে নির্মিত হয়েছে মাটির দেয়াল। নিচতলা থেকে দোতলায় উঠতে রয়েছে কাঠের সিঁড়ি। প্রতিবন্ধীদের হুইলচেয়ার নিয়ে ওঠার জন্য র‍্যাম্পের ব্যবস্থাও রয়েছে। এমন স্থাপত্যশৈলী দেখতে প্রতিদিনই এখানে দর্শনার্থীরা আসছেন।

নান্দনিক ভবনটি দিনাজপুরের বিরল উপজেলার মঙ্গলপুর ইউনিয়ের রুদ্রপুর গ্রামে। বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) দীপশিখার প্রাঙ্গণে সম্প্রতি ভবনটি নির্মাণ করা হয়। এই ভবনটির নাম রাখা হয়েছে আনন্দালয়। আনন্দালয়ের নকশা করেছেন জার্মান স্থপতি আন্না হেরিংগার। এ বছর তিনি এই ভবন নির্মাণের জন্য আন্তর্জাতিক ‘ওবেল অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেছেন। দীপশিখার প্রাঙ্গণে একই উপকরণে তৈরি আরও দুটি ভবন রয়েছে। সেগুলোরও স্থপতি আন্না হেরিংগার। এর জন্য ২০০৭ সালে আগা খান আর্কিটেকচার অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছিলেন তিনি।

ভবনের সুপারভাইজার মন্টু রাম জানান, ২০০৩ সালে দীপশিখায় প্রথম মাটির ভবনটি নির্মাণের সময় স্থপতি আন্না হেরিংগার এখানেই ছিলেন। সর্বশেষ আনন্দালয় তৈরির জন্য তিনি কেবল নকশাটিই পাঠিয়েছেন। সেই নকশা অনুযায়ী তাঁর তত্ত্বাবধানে স্থানীয় ব্যক্তিদের শ্রমে ৯ মাসের ব্যবধানে এই ভবন নির্মিত হয়েছে। ভবনটি নির্মাণে মাটি লেগেছে ৯ হাজার বর্গফুট মাটি, খড় লেগেছে ১০ কাহন (১৬ হাজার আঁটি), আর বাঁশ লেগেছে প্রায় ১ হাজার ৪০০টি। দেয়ালের প্লাস্টারে মাটি, বালু ও সিমেন্ট ব্যবহার হলেও মেঝের প্লাস্টারে ব্যবহার করা হয়েছে পাম তেল ও সাবান। সাবান ও পাম তেল ব্যবহারে ধুলা হয় না। ভবনে ব্যবহৃত বাঁশগুলোর ঘুন রোধে সিজনিং করা হয়েছে। ভবনটির সম্পূর্ণ নির্মাণ ব্যয় প্রায় ৭৩ লাখ টাকা।

রুদ্রপুর এলাকায় প্রায় ছয় একর জমিজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দীপশিখার কার্যালয়। দিনাজপুর শহর থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার পিচ ঢালাই রাস্তা। যাত্রা শুরু থেকে দীপশিখার প্রধান ফটক পর্যান্ত দীপশিখার অবস্থান জানতে চাইলে পথ দেখিয়ে দেবে এলাকার মানুষ। প্রধান ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে বোঝার উপায় থাকবে না ভেতরে কী আছে। ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়বে সাজানো–গোছানো বাগান। বড় বড় গাছ। সেই গাছের ছায়ায় নির্দিষ্ট দূরত্বে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে তিনটি মাটির দ্বিতলা ভবন, যার একটিতে প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন, অন্যটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে প্রতিবন্ধী স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র (আনন্দালয়)।

আনন্দালয় ভবনটিতে ঢুকতেই শরীরে কেমন একটা শীতল পরশ পাওয়া গেল। বোঝা গেল পারিপার্শ্বিক তাপামাত্রার চেয়ে ভবনের তাপমাত্রা কিছুটা কম। ভবনের নিচতলায় রয়েছে অফিস, প্রতিবন্ধী শিশুদের ফিজিওথেরাপি কক্ষ এবং খেলাধুলাসহ বিনোদনের বিশেষ ব্যবস্থা। নিচতলার পশ্চিম প্রান্তের দেয়ালে প্রতিবন্ধী শিশুদের খেলা ও ব্যায়ামের জন্য চারটি সুড়ঙ্গের মতো খোপ দেখা গেল। দ্বিতীয় তলায় রয়েছে ফিজিথেরাপি বিভাগের অফিসকক্ষ, ইনচার্জের কক্ষ, বড় একটি হল রুমে পিছিয়ে পড়া নারীদের অংশগ্রহণে চলবে সেলাই কার্যক্রম। প্রতিটি কক্ষেই রয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা ও সৌরবিদ্যুতের সংযোগ। করিডোরগুলোতে রয়েছে বাঁশের তৈরি বিশ্রাম–বেঞ্চ।

দীপশিখা কার্যালয় থেকে জানা গেল, ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত সংস্থাটি সম্প্রতি তিন বছর মেয়াদী ‘ইমপ্রুভিং দ্যা লাইভস অব পিপলস উইথ ডিজঅ্যাবিলিটি (আইএলপিডি)’ নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এতে অর্থের জোগান দিচ্ছে হংকং–ভিত্তিক দাতব্য সংস্থা ‘দি কাদোরি চ্যারিটেবল ফাউন্ডেশন’। এই প্রকল্পের জন্যই আনন্দালয় তৈরি করা হয়। ২০১৮ সালের নভেম্বরের শুরুতে আনন্দালয় উদ্বোধন হয় এবং সেইসঙ্গে শুরু হয় প্রকল্পের কাজ।