
‘দ্যাখেন তো, পানি দিবার দায়িত্ব ওয়াসার, দিচ্ছে পুলিশ। কে কয় পুলিশ ভালো কাজ করে না?’ রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের দক্ষিণ-পূর্ব কোণের পাম্পের কল থেকে কয়েকজন নারী-পুরুষকে পানি সংগ্রহ করতে দেখে এ মন্তব্য করেন মধ্যবয়সী আবীর আলী।
শান্তিনগরে আত্মীয়ের বাসায় যাওয়ার পথে গত সোমবার দুপুরে পানি সংগ্রহের এ দৃশ্য চোখে পড়ে আবীর আলীর। তাঁর মন্তব্যে সায় দিয়ে মাথা নাড়েন সঙ্গী আবুল হোসেন।
ওই কলের ঠিক ওপরে দেয়ালে টাঙানো সাইনবোর্ডে বড় বড় অক্ষরে লেখা: ‘নিরাপদ পানি সরবরাহ, সৌজন্যে: ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ’। এই সাইনবোর্ড দেখে আবীর আলী ওই মন্তব্য করেন বলে প্রথম আলোকে জানান। তাঁর মতো আরও অনেকেই এ জন্য পুলিশকে কৃতিত্ব দিচ্ছেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) এই সাইনবোর্ডের বিরোধিতা করেছে ঢাকা ওয়াসা। ওয়াসার দাবি, পাম্পটি তাদের, সরবরাহ করা পানিও তাদের। তাই সাইনবোর্ডে সৌজন্যে পুলিশ লেখা ঠিক হয়নি। সাইনবোর্ডে এ কথা লিখে ওয়াসার কৃতিত্ব নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ।
এ বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক এ ডি এম কামরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, পুলিশ পাম্প বসানোর জায়গা দিয়েছে, ওয়াসা নিজ খরচে পাম্প বসিয়েছে। সেই পাম্পের পানি মানুষ সংগ্রহ করছে। তাই সাইনবোর্ডে ওয়াসাকেও কৃতিত্ব দেওয়া উচিত।
ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মো. মাসুদুর রহমান বলেন, ওয়াসা পাম্পস্টেশনটি করেছে, এ জন্য ডিএমপি অবশ্যই কৃতজ্ঞ। কিন্তু ডিএমপি নিজ দায়িত্ব থেকেই জনগণের সঙ্গে মেলবন্ধন তৈরির জন্য পানি সরবরাহের এই সেবামূলক কাজটি করে। মিরপুরেও পুলিশ একটি পাম্পস্টেশন থেকে পানি সরবরাহ করে। গরমের সময় পানির বেশি সংকট দেখা দিলে ডিএমপি ট্রলি দিয়েও পানি সরবরাহ করে।
কৃতিত্ব যে সংস্থারই হোক না কেন, রাজারবাগের ওই পানির পাম্পটি এখন আশপাশের মানুষের বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহের অন্যতম প্রধান উৎস। দিনের বেলা তো বটেই, গভীর রাতেও সেখানে ভিড় করে পানি সংগ্রহ করছে নানা বয়সী মানুষ। ছোট ড্রাম, বড় হাঁড়ি, বালতি, জারিকেন নিয়ে লোকজনের ভিড় লেগেই থাকে। কারণ, আশপাশের এলাকায় অনেক বাড়িতেই ওয়াসার সরবরাহ করা পানিতে থাকে ময়লা ও দুর্গন্ধ।
চামেলীবাগ, শান্তিনগর, শান্তিবাগ, ফকিরেরপুল, পুরানা পল্টন, নয়াপল্টন, আরামবাগের অনেক বাড়িতে পানির এই সমস্যা। ওয়াসার এসব গ্রাহক মাসে মাসে পানির জন্য বিল দিয়েও বিশুদ্ধ পানি পাচ্ছেন না। তাঁদের বিকল্প উৎস থেকে বিশুদ্ধ পানি আনতে হচ্ছে। এ কারণেই রাজারবাগ পাম্পে সব সময়ই ভিড় থাকে। সোমবার রাত ১০টার দিকে বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষকে ওই পাম্পে দেখা গেল। সবার সঙ্গেই পানির পাত্র। তাঁদের দুজন চামেলীবাগের বাসিন্দা রহমত উল্লাহ ও তাঁর স্ত্রী। তাঁরা পানিভর্তি বড় তিনটি জারিকেন রিকশায় তুলছিলেন। রহমত উল্লাহ বললেন, বাড়িওয়ালাকে মাসে এক হাজার টাকা করে পানির বিল দেন। কলে পানি আসেও, তবে দুর্গন্ধের জন্য তা পান করা যায় না। গোসল করতেও গা ঘিন ঘিন করে।
ছয়টি জারিকেনে ভরে রিকশাভ্যানে তুলছিলেন মধ্যবয়সী এক নারী। নাম জানতে চাইলে বললেন আশরাফুলের মা। জানালেন, ফকিরেরপুলের একটি রেস্তোরাঁর জন্য তিনি পানি নিচ্ছেন। প্রতিবার পানি নেওয়ার জন্য পান ২০ টাকা। ভ্যান রেস্তোরাঁর। তিনি বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় চার-পাঁচবার পানি পৌঁছে দিয়ে দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে বেঁচে আছেন। স্বামী নিখোঁজ। এত রাতেও পানি নেন—এ কথা শুনে তিনি বলেন, ‘রাইতেও পানির দরকার। আমি পৌঁছাইয়া না দিলে হোটলঅলা অন্যজনরে রাখব।’
শান্তিনগরের টুইন টাওয়ারের কাছের এক বাসিন্দা বলেন, দিনে পানি নিয়ে রাস্তা দিয়ে যেতে লজ্জা লাগে। তাই প্রতি রাতেই তিনি এখান থেকে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করেন।
ফকিরেরপুলের বাসিন্দা দিবাকর বলেন, তিনি খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, সায়েদাবাদ পানি শোধনাগারের পানি এই এলাকায় সরবরাহ হয় না। আসে গভীর নলকূপের পানি। পানিতে দুর্গন্ধের কথা জানালে ওয়াসা বলেছে রিজার্ভ ট্যাংক পরিষ্কার করতে। বাড়িওয়ালাকে বলে ট্যাংক পরিষ্কার করিয়েও লাভ হয়নি।
পাম্পে থাকা লোকজন জানান, গভীর রাতেও এখানে পানি নিতে মানুষ আসে। এ বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার এ ডি এম কামরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, সায়েদাবাদ পানি শোধনাগারের পানি আরামবাগ, ফকিরেরপুল, নয়াপল্টন, পুরানা পল্টন, শান্তিনগরসহ আশপাশের এলাকায় সরবরাহ হয় না। তবে গভীর নলকূপের পানিও বিশুদ্ধ। অবৈধ সংযোগের কারণে এই পানি দূষিত হয়ে থাকতে পারে। তিনি বলেন, অনেকে লাইনের পানি পানে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। ফোটানোর ঝামেলা এড়াতে চান। পুলিশ লাইনের এই কলের মতো বিভিন্ন পাম্পস্টেশন থেকে সরাসরি পানি নিয়ে তাঁরা শান্তি পান।