গরিববান্ধব কৃষি ব্যবসা সম্ভাবনা ও সমস্যা

৬ ডিসেম্বর ২০১৪, প্রথম আলোর আয়োজনে ‘গরিববান্ধব কৃষি ব্যবসা: সম্ভাবনা ও সমস্যা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো 

সহযোগিতায়: বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অ​ধীনে এগ্রি-বিজনেস ফর ট্রেড কম্পি​িটটিভনেস প্রকল্প-ক্যাটালিস্ট পরিচালনা করছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সুইসকন্টাক্ট। প্রকল্পটির অর্থায়নে রয়ে​েছ ব্রিটিশ সরকার, সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট কো–অপারেশন (এসডিসি) ও ড্যানিডা।

সুত্র: বিবিএস–শ্রমশক্তি সমীক্ষা–২০১০, প্রথম আলো ১৪ নভেম্বর ২০১৪, বাংলাদেশ ব্যাংক, আইএফসি
সুত্র: বিবিএস–শ্রমশক্তি সমীক্ষা–২০১০, প্রথম আলো ১৪ নভেম্বর ২০১৪, বাংলাদেশ ব্যাংক, আইএফসি

আলোচনা

আব্দুল কাইয়ুম: বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ কৃষিকাজ করে। গত কয়েক দশকে কৃষিপণ্যের ব্যাপক উৎপাদন বেড়েছে। এর পেছনে কৃষিকেন্দ্রিক বাণিজ্যব্যবস্থার ভূমিকা রয়েছে। কৃষিভিত্তিক বাণিজ্যে সার, বীজ, সেচের মতো প্রত্যক্ষ বিষয় ছাড়াও উৎপাদিত কৃষিপণ্য সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, পরিবহন, বিপণন ও বাজারজাত করার অনেক শাখা-উপশাখা রয়েছে। কৃষি ব্যবসার উন্নয়নের সঙ্গে বিশাল জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন জড়িত।

কৃষির এ উন্নয়নকে গতিশীল করার জন্য প্রয়োজন গরিববান্ধব অন্তর্ভুক্তিমূলক কৃষি ব্যবসা। তাই কৃষির সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য কাজ করতে হবে। দারিদ্র্য বিমোচনে কৃষি ব্যবসার আধুনিকায়ন প্রয়োজন। কৃষিব্যবস্থার পুরো বিষয়টি গরিববান্ধব করে তোলা খুবই জরুরি। আলোচনায় এসব বিষয় আসবে। এখন আলোচনা করবেন আনোয়ার ফারুক।

আনোয়ার ফারুক: কৃষক অনেক কষ্ট করে ফসল উৎপাদন করেন। এ জন্য তিনি একটি ভালো দাম আশা করেন। বাস্তবতা হলো, ফস​​ল কাটার সময় ধান, গম, ভুট্টা, শাকসবজি—সবকিছুর দাম কমে যায়। প্রায় প্রতিবছরই শুনি, কৃষক ন্যূনতম দামের অভাবে মনের দুঃখে তঁার সবজি ফেলে দিচ্ছেন। কৃষিপণ্যের বাজারব্যবস্থায় আমাদের কোনো অবদান নেই। আমরা বরং বাজারব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত করেছি। কৃষিপণ্য সংরক্ষণের জন্য গুদামের ব্যবস্থা নেই। পর্যাপ্ত যানবাহনের ব্যবস্থা নেই। যোগাযোগব্যবস্থা ভালো না। 

কৃষির সবচেয়ে বড় বাধা হলো চাঁদাবজি। পরিবহনের ব্যয় অত্যন্ত বেশি। পঞ্চগ​েড়র পাঁচ টাকার কপি  ঢাকায় কিনতে হয় ৩০ টাকায়। কৃষকদের অনেক পণ্য পচে যায়। নষ্ট হয়। এখানে আমরা কিছুই করতে পারিনি। আমরা হয়তো সারসহ কিছু ক্ষেত্রে ভর্তুকি দিচ্ছি। কিন্তু কৃষি ব্যবসার ক্ষেত্রে আমাদের কোনো কাজ হয়নি। এখনই আমাদের এ ক্ষেত্রে দ্রুত কিছু করতে হবে। তা না হলো আগামী দিনে কৃষিব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের কৃষিপণ্যের উৎপাদন সব সময় ঘাটতি ছিল। কিন্তু বিগত পাঁচ থেকে সাত বছর ধান, আলুসহ কিছু কৃষিপণ্য চাহিদার তুলনায় বেশি উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু এর ব্যবস্থাপনার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ১৬ কোটি মানুষের খাদ্যের ব্যবস্থা করে আজ আমরা চাল রপ্তানি করছি। এটি একটি বড় সাফল্য। এ সরকারের প্রথম ক্যাবিনেট সভাতেই সারের দাম কামানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। তিনবার সারের দাম কমানো হয়। এখন আর শোনা যায় না কৃষক সার পাচ্ছেন না। সরকার তো ব্যবসা করবে না। সরকার নীতিগত সমর্থন দেবে। ব্যবসা করবেন ব্যক্তিমালিকেরা অর্থাৎ​ বেসরকারি খাত।

গত বছর এক লাখ ২২ হাজার টন আলু রপ্তানি হয়েছে। এ বছর ভারত আলু নিতে চেয়েছে। অর্থাৎ আমরা মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন করছি। ১০ বছর আগে আমাদের মুগডাল প্রায় হারিয়ে গিয়েছিল। প্রাণএর উদ্যোগে সেটা ফিরে এসেছে। কৃষক সব সময় তাঁর উৎপাদিত পণ্যের একটি ভালো দাম চান। এ জন্য ভর্তুকি দিতে হবে। সহজ শর্তে ঋণসহ সব সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রান্তিক কৃষক যাতে তাঁর উৎপাদিত ফসলের সত্যিকার দাম পান, তার জন্য যা যা করা দরকার আমাদের সবাইকে সেটা করতে হবে।

নাসির উদ্দিন আহমেদ: ক্যাটালিস্ট বাংলাদেশ সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি কারিগরি সহায়তা প্রকল্প।  আমরা ২০০৩ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ১০ বছরব্যাপী দুটি পর্য​ায়ে কাজ করেছি। তৃতীয় ধাপে ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এ প্রকল্পের কাজ চলবে। কৃষির কয়েকটি ভ্যালু চেইনে আমরা কাজ করি। আমাদের মূল উদ্দেশ্য হলো গরিব ও প্রান্তিক কৃষকদের সক্ষম করে গড়ে তোলা। আমরা বীজ, শাকসবজি, সার ইত্যাদি নিয়ে কাজ করছি। দরিদ্র কৃষকদের উৎপাদন কম। কিন্তু তাঁদের উৎপাদনের খরচ বেশি। আবার পণ্যের ভালো দাম পান না। সুষ্ঠু বাজারব্যবস্থার অনুপস্থিতি এর প্রধান কারণ। এসব বাধা দূর করার জন্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে। কীভাবে এ সমস্যার সমাধান করা যায়, সেটি ভাবতে হবে। আমরা অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবসার কথা বলি। ২০০৫ সাল থেকে অন্তর্ভু‌ক্তিমূলক ব্যবসা বা ইনক্লুসিভ বিজনেসের ধারণাটি এসেছে। এর প্রধান উদ্দেশ্য হলো সবচেয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে উৎপাদন, ব্যবসা, ভোক্তা বা শ্রম, এসবের কোনো একটি বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা। একটি উদাহরণ দিই, ভারতের ইউনিলিভার দেখল বেশি দামের জন্য গ্রামের মানুষ তাদের শ্যাম্পু কিনছে না। তখন তারা শ্যাম্পুর মিনিপ্যাক বের করল। ইউনিলিভার এটি সামাজিক দায়বদ্ধতা বা গরিব মানুষের সেবা করার জন্য করেনি। মূল উদ্দেশ্য ছিল মুনাফা অর্জন। এভাবে কোনো না কোনো উপায় বের করতে হবে, যাতে দরিদ্র জনগোষ্ঠী কৃষির কোনো একটি কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারে। আমরা সে লক্ষ্যে কাজ করছি। তবে এ ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। কৃষির জন্য সরকারের দিক থেকে যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। 

ফিরোজ শাহ শিকদার: বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। ১৬ কোটি মানুষের জীবিকা কৃষির ওপর। তাই এ দেশে কৃষি ব্যবসার বড় ধরনের সুযোগ রয়েছে। দেশের মধ্যেই কৃষির বড় বাজার রয়েছে। কিন্তু গ্রামীণ ব্যবসার জন্য প্রয়োজন পুঁজির। কৃষকের পুঁজির যথেষ্ট অভাব রয়েছে। মূলধনের অভাবে তাঁরা কোনো কাজই ঠিকভাবে করতে পারেন না। অন্যদিকে তাঁদের কৃষিপণ্যের উৎপাদন ও মূল্যের ক্ষেত্রে রয়েছে অনিশ্চয়তা। এখন দেশে ১০ হাজার মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হচ্ছে। ভালো ফলনের জন্য কৃষকেরা হাই​ি্ব্রড ধান উৎপাদন করছেন। অথচ সরকারি লোকজন হাইব্রিড ধান কিনছেন না। আবার এ ধান না কেনার জন্য সরকারের দিক থেকে কোনো নীতিমালা নেই। মাঝখান থেকে কৃষকেরা ক্ষতির মুখে পড়বেন।

কৃষকদের সহজ শর্তে ঋণের জন্য এগ্রি বিজনেস তহবিলের ব্যবস্থা করা একান্ত প্রয়োজন। আজ প্রাণ, এসিআইসহ অনেক ব্যক্তিমালিকানা কোম্পানি কৃষকের দোরগোড়ায় চলে গেছে। তঁাদের কৃষিপ্রযুক্তি দিয়ে সহায়তা করছে। কৃষিপণ্য কেনার নিশ্চয়তা দিচ্ছে। অনেক কৃষক কন্ট্রাক্ট ফার্মিং করছেন। কিন্তু মূলধনের অভাবে সেটা ঠিকভাবে করতে পারছেন না। আমরা ছোট প্যাকেটে অল্প টাকায় কৃষকদের বীজ দিচ্ছি। সরকারি পর্যায়ে অতিপ্রয়োজনীয় কিছু নীতি নেওয়া প্রয়োজন। এর মধ্যে অন্যতম হলো কৃষকদের সচেতন করা। বাজারব্যবস্থার জন্য অবকাঠামো তৈরি করা। কৃষির বিভিন্ন বিষয়ে তদারকি বাড়ানো ইত্যাদি। সরকারের কোনো একটি সংস্থাকে এসবের জন্য দায়িত্ব নিতে হবে। কৃষক সচেতন হলে তঁারা অনেক ধরনের ঝুঁকি থেকে রক্ষা পাবেন। কৃষি অধিদপ্তরের প্রধান কাজ বাজারে মূল্যতালিকা ঝোলানো। দেশে ৩০টি নতুন বাজার করা হয়েছে। অবকাঠামোর অভাবে সেগুলো ঠিকভাবে চলছে না। কিন্তু এটা

কেউ দেখছে না। প্রান্তিক কৃষকদের উন্নয়ন করতে হলে এসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে।

ফওজিয়া ইয়াসমীন: আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এগ্রি বিজনেসের ঋণের পদ্ধতি সাধারণ ঋণের মতো। ফলে এ ঋণ থেকে কৃষক কোনো সুবিধা পান না। আমাদের বীজ সংরক্ষণের জন্য একটি গুদাম করতে পাঁচ থেকে সাত কোটি টাকা খরচ হয়। কিছুটা কম সুদের হারে কোথাও ঋণ পাওয়া যায় না। টেক্সটাইলসহ বিভিন্ন খাত ঋণের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা আছে। কিন্তু আমরা কখনো এ ধরনের সুবিধা পাই না। ফলে এর যত চাপ পড়ে কৃষকের ওপর। কৃষকদের মধ্যে সামান্যতম সচেতনতা নেই। একবার মাঠে গিয়ে দেখি এক কৃষক তাঁর সবজিতে ওষুধ দিচ্ছেন। এ ওষুধ তাঁর গায়ে লাগছে। যে সবজি বিক্রির জন্য তোলা হয়েছে, তাতেও লাগছে।

কৃষক এ ব্যাপারে মোটেও চিন্তিত নন। সে এটাকে স্বাভাবিক ঘটনা বলে মনে করেন। তাই কৃষকদের সচেতন করাটা অত্যন্ত জরুরি। আমরা বায়োপেস্টিসাইডের দিকে যাচ্ছি এবং এটা তৈরি করছি। কিন্তু এখনো সম্পূর্ণভাবে কেমিক্যাল পেস্টিসাইডের ওপর নির্ভরতা কমানো যাচ্ছে না। প্রাণ আমাদের বায়োপেস্টিসাইড ব্যবহার করে। ধীরে ধীরে হয়তো একসময় কেমিক্যালের ওপর নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারব। বায়োপেস্ট্রিসাইডের সুবিধা হলো, দাম কেমিক্যাল পেস্টিসাইডের তিন ভাগের এক ভাগ। পরিবেশের কোনো ক্ষতি হয় না। ফসলের ফলন বেশি হয়। কিন্তু কৃষকেরা না জানার জন্য এ সুবিধা গ্রহণ করতে পারছেন না। কৃষকদের সচেতন করার জন্য সরকারকে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে হবে। হাইব্রিড ধান সরকারের লোকজন কেন কিনছেন না, অতি দ্রুত সরকারকে সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে।

মো. হাফিজুর রহমান: আমি বিজনেস প্রমোশন কাউন্সিলে আছি। কৃষিপণ্যসহ ছয়টি ক্ষেত্রে আমরা কাজ করি। আমাদের প্রধান কাজ পণ্য রপ্তানিতে সহযোগিতা করা। এ ক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকলে সেটা দূর করার চেষ্টা করা। এর জন্য প্রশিক্ষণ, গবেষণা, আলোচনাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ রয়েছে। কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে ১০টি অ্যাসোসিয়েশন আছে। তাদের সঙ্গে আমরা কাজ করি। সরাসরি ৪০ শতাংশ মানুষ কৃষিতে জড়িত। বর্তমান সরকার কৃষিপণ্য রপ্তানিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে। কৃষিপণ্যের মধ্যে রয়েছে পাট, শাকসবজি, ফলমূল, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, মৎস্য ইত্যাদি। প্রধান আমদানিকারক দেশ হলো মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ। সম্প্রতি রাশিয়ায় আমাদের পণ্য রপ্তানি হচ্ছে।

রপ্তানি বাণিজ্যে আমাদের ভোক্তা হলো বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা। সঙ্গে যোগ হয়েছে চীন, নেপাল, ভুটান, ভিয়েতনাম ইত্যাদি দেশের মানুষ। এরা যুক্ত হওয়ার প্রধান কারণ আমাদের পণ্যের দাম কম। তা ছাড়া খাওয়ার পদ্ধতিটা এরা জানে। কৃষিক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকার সহযোগিতার জন্য কতকগুলো পণ্যের উৎপাদন আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। কিন্তু আমাদের পণ্যের মান নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। এ কারণে রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মান ঠিক না থাকায় আগামী জুন পর্যন্ত আমাদের পণ্যের রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে।

মাছ নিয়ে কিছু কাজ করার পর এখন একটি আন্তর্জাতিক মান দাঁড়িয়েছে। শাকসবজি, ফলমূলে মান ঠিক থাকছে না। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলেছে, আমাদের শাকসবজিতে পোকামাকড় থাকে। তারা আলট্রা রে দিয়ে এটা দেখেছে আমাদের সতর্ক করেছে। এসবের মান না বাড়ালে ভবিষ্যতে রপ্তানির সংকট তৈরি হতে পারে। যুক্তরাজ্যের বড় দুটো বাজারে বিভিন্ন দেশের পণ্য আসে। সেখানে বাংলাদেশের পণ্য ১ শতাংশের কম। শাকসবজি, ফলমূল গার্মেন্টসের ফেলে দেওয়া প্যাকেটে ঢুকিয়ে রশি দিয়ে বেঁধে রপ্তানি করা হয়। বিদেশে গিয়ে অর্ধেক নষ্ট হয়। নতুন করে প্যাকেট করা হয়। ফলে মূল্য অনেক বেড়ে যায়। অথচ একটু সতর্ক হলে এ কাজটি দেশেই করা যায়। ভারত-পাকিস্তানের আমে রাসায়নিক পাওয়ায় এবার বাংলাদেশি আমের চাহিদা খুব বেশি ছিল। কিন্তু প্যাকেজিংয়ের মান খুবই খারাপ।

অন্য দেশ ফলমূলের ছবিসহ এমন প্যাকেট করে, যেখানে আলো-বাতাস ঢোকার জন্য প্যাকেটে নেটের ছিদ্র থাকে। মালয়েশিয়া সোলার প্যাকেটে আইস দিয়ে বরবটি পাঠায়। প্যাকেটটি দেখতে অনেক সুন্দর। প্যাকেটের একটি বরবটিও নষ্ট হয় না। পণ্যকে  ঠান্ডা করে প্যাকেট করলে ভালো থাকে। আমাদের এয়ারপোর্টে একটা কুল সেন্টার আছে। এটা কখনো ব্যবহার করা হয় না। স্থানীয়ভাবে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে  ‘কুল ভ্যানের’ ব্যবস্থা জরুরি। পার্শ্ববর্তী দেশের পরিবহনের ব্যয় থেকে আমাদের বিমান পরিবহনের ব্যয় অনেক বেশি। পরিবহন, প্যাকেজিং, মান, কুল চেইন সংরক্ষণসহ আরও কিছু সমস্যা দূর করতে পারলে আমাদের রপ্তানি অনেক বেড়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে সরকারসহ সবাইকে গুরুত্বসহকারে ভাবতে হবে।

আমজাদ খান চৌধুরী: পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক বিভিন্ন কারণে দেশের জমি ছোট খণ্ডে বিভক্ত হচ্ছে। ছোট খণ্ডের জমিগুলো একত্র করে বড় করা প্রয়োজন। তাহলে উৎপাদন অনেক বেড়ে যাবে। কৃষিতে একটি ব্যাপক সফলতা আসবে। আমরা বিগত ৩০ বছর কাজ করছি। আমাদের সঙ্গে কাজ করে কৃষকদের দারিদ্র্য বিমোচন হচ্ছে। ৭৮ হাজার কৃষক প্রাণের কাজের ওপর নির্ভরশীল। তাঁরা আমাদের কোম্পানির জন্য মুগডাল, চিনাবাদাম, টমেটো, সরিষা, চাল, মরিচ, রসুন, আম ইত্যাদি ফলস উৎপাদন করছেন। আমরা তাঁদের পণ্য কেনার নিশ্চয়তা দিয়েছি।          

আমাদের কোম্পানির বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রায় দুই লাখ মানুষের কর্মসংস্থান আছে। দিন দিন কর্মসংস্থানের পরিমাণ বাড়ছে।  আমরা চাল, ডাল, আলু, বাদাম, হলুদ, মরিচ, ধনে, টমেটো, আম, আনারস, বরই, তেঁতুল ইত্যাদির প্রায় তিন হাজার মণ কৃষিপণ্য কৃষকদের কাছ থেকে ক্রয় করি। এসব পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করি। গাভি পালন দারিদ্র্য বিমোচনের একটি অন্যতম উপায়। কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় আমি এটা প্রমাণ করেছি। আমাদের দুই হাজার ৮৩০ জন কৃষক গাভি পালন করেন। গাভির দুধ বিক্রি করে তাঁরা স্বাবলম্বী হয়েছেন। আগে ছিল দ্বিতীয় আয়ের উৎস, এখন প্রধান আয়। আমাদের ৩০ বছরের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, কৃষি একটি লাভজনক ব্যবসা। তবে বড় প্রকল্প নিতে হবে। মানুষ বলে ঝুঁকি আছে। লাভ হয় না। আমরা বলতে পারি, কৃষি যথেষ্ট নিশ্চিত লাভের ব্যবসা। আমরা বছরের পর বছর উৎপাদন বৃদ্ধি করছি। বিক্রি বৃদ্ধি করছি। সরকারসহ সবাইকে কৃষিকে গুরুত্ব দেওয়ার অনুরোধ করব। কৃষির মাধ্যমে আমাদের দেশ ধনী হতে পারবে।

এফ এইচ আনসারী: এসিআইয়ের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, কৃষি অবশ্যই একটি লাভজনক ব্যবসা। আমাদের  উদ্দেশ্য দেশের দারিদ্র্য দূর করা। আমাদের এগ্রি বিজনেসের  উদ্দেশ্য কৃষকদের আত্মনির্ভশীল করা। সৃষ্টিশীলতা, প্রযুক্তি, যোগাযোগ, ভ্যালু চেইন, কোল্ড চেইন, বাজারজাতকরণ—কোনো কিছুতে কৃষকের করার কিছু নেই। এসব কাজ অন্যদের করতে হবে। কৃষক কেবল উৎপাদনে অবদান রাখতে পারেন। কৃষির উৎপাদনের ক্ষেত্রে এখন প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। ছোট কৃষককে বড় কৃষকের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয়। ছোট কৃষকদের স্বাবলম্বী করতে হলে তাঁদের কাছে প্রযুক্তি পৌঁছাতে হবে। কোম্পানি ও অন্যান্য সংস্থা বড় কৃষকদের সহায়তা দেয়। ছোট কৃষকদের কথা কেউ ভাবে না। সরকার, আমাদের মতো কোম্পানি, গণমাধ্যম সবাইকে ছোট কৃষকদের জন্য কাজ করতে হবে। তাঁদের কাছে প্রযুক্তি ও তহবিল পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। সিঙ্গাপুরের মতো দেশ, যারা সম্পূর্ণ ক্রয় করা খাদ্যের ওপর নির্ভরশীল, তারা খাদ্যনিরাপত্তার কথা বলতে পারে। আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা কৃষির ওপর নির্ভর করে। যে করেই হোক কৃষকদের সব রকম নিরাপত্তা দিতে হবে। তাহলে দেশের উন্নয়ন হবে।

শেখ মোরশেদ জাহান: আমাদের কৃষকেরা গরিব না।  মূল্য সাইকেলে আছে ফড়িয়া, করপোরেশন, ভোক্তা ইত্যাদি। কৃষির প্রধান লক্ষ্য রাখা হয়েছে উৎপাদনের ওপর। অন্যান্য ক্ষেত্র ভাবা হয়নি। ক্যাটালিস্টের উদ্যোগে প্যাকেজিং নিয়ে কিছু কাজ করেছি। প্যাকেজিংয়ের অবস্থা ভয়ানক খারাপ। ফসল তোলার পর কয়েক ঘণ্টার অব্যবস্থাপনায় প্যাকেজিংয়ের আগেই প্রায় অর্ধেক ফসল নষ্ট হয়। এটা খুবই দুঃখজনক ঘটনা। তিন-চার মাস পরিশ্রম করে ফসল উৎপাদন করা হয়। অথচ মাত্র কয়েক ঘণ্টার অব্যবস্থাপনায় প্রায় অর্ধেক ফসল বাদ যায়।

কৃষককে কেবল চাষাবাদের প্রযুক্তি দিলে হবে না। প্যাকেজিং, মার্কেটিং, কোল্ড চেইনসহ সব প্রযুক্তি দিতে হবে। কৃষকেরা একটু সচেতন হলে অল্প খরচেই অনেক সময় ভালো ফল পাওয়া যায়। যেমন, বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, ২০ লিটার পানি দুই টাকা দামের হ্যালোজেন ট্যাবলেট দিয়ে পরিষ্কার করা যায়। এ পানিতে মাছ ভালো করে ধুলে ১০ ঘণ্টার বেশি বেঁচে থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে ২০-২৫ শতাংশ দাম বেশি পাওয়া যায়। মাছ প্রক্রিয়াকরণ  শ্রমিকদের হাত–পায়ে দিনের প্রায় সারাক্ষণ পানি লাগে। হাত –পায়ে অনেক সময় ঘা হয়। এটা মাছে সংক্রমিত হয়ে আমাদের ক্ষতি করতে পারে। খুব অল্প টাকার জুতা ও গ্ল​াভস কিনলে এ সমস্যার সমাধান করা যায়।

অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবসায় ধনী-দরিদ্র সবাই সুবিধা পাবেন। প্রাণ, স্কয়ার, এসিআই কিন্তু সেটা করছে। একই সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠান মুনাফা করছে, আবার দরিদ্র কৃষকেরা তাঁদের কাছে বিশাল পরিমাণ পণ্য বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন। এখানে কেউ কাউকে সাহায্য করছেন না। একজনের ভাগ্যের সঙ্গে অন্যজনের ভাগ্য বাঁধা—এ মনমানসিকতা নিয়ে কৃষক ও কৃষিপণ্য ব্যবসায়ী উভয়কে এগিয়ে আসতে হবে।

 ভোক্তাদের কাছ থেকে ভালো পণ্যের দাবি না তুললে ভালো পণ্য বাজারে আসবে না। আবর ভ্যালু চেইন, কোল্ড চেইন, যোগাযোগ, প্রযুক্তি, প্যাকেজিং—সবকিছুর ব্যাপক উন্নয়ন ঘটাতে হবে। এসব করতে পারলে দরিদ্র কৃষকের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে।

অনির্বাণ ভৌমিক: কৃষিতে একটা গুণগত পরিবর্তন এসেছে। এ জন্য গ্রামীণ দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে। কৃষি উৎপাদন থেকে এখন বাণিজ্যের দিকে আসছে। এ দেশের প্রেক্ষাপটে এ​িট খুবই ইতিবাচক। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যেমন যদি বিশ্ববাজারের কথা ভাবি, সেখানে খাদ্যনিরাপত্তাসহ অনেক বিষয় রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র কৃষকের করার কিছুই নেই। বিশ্ববাজারে আমাদের কৃষির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তবে এ বাজারে প্রবেশের যোগ্যতা আমাদের কতটুকু আছে, সেটি বড় প্রশ্ন। এখানে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার অনেক নিয়মের বিষয় আছে। কমপ্লায়েন্স (বিভিন্ন ক্ষেত্রে সঠিক মান) ঠিক করার বিষয় আছে।

এসব বিষয়ে আমাদের কোনো প্রস্তুতি নেই। এ বাধাগুলো দ্রুত দূর করতে হবে। দেশের বাজারের জন্য একজন কৃষক একজন উদ্যোক্তা। তাঁরা এগ্রি বিজনেস কোম্পানিগুলোর কৃষিপণ্যের সবটাই সরবরাহ করছেন। আবার যাঁরা বীজ, সার বিক্রি করছেন, তাঁদের ক্রেতাও এসব উদ্যোক্তা কৃষক। অর্থাৎ এঁরা সব ক্ষেত্রে সাপ্লাই চেইন হিসেবে কাজ করছেন। কৃষকেরা উদ্যোক্তা হওয়ায় অন্য উদ্যোক্তাদের মতো অনেক চ্যালেঞ্জ তাঁদের সামনে এসেছে। যেমন সহজ শর্তে ঋণপ্রাপ্তি, প্রযু‌ক্তি ইত্যাদি। এখানে কৃষিকে আলাদা করে দেখার জন্য সমস্যা হচ্ছে। কৃষিকে আর দশটা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মতো ভাবতে হবে। সেগুলোর ক্ষেত্রে যেভাবে সমস্যার সমাধান করা হয়, কৃষির ক্ষেত্রে তা–ই করতে হবে। কারণ, কৃষি এখন বাণিজ্যে প্রবেশ করেছে। কৃষিঋণের ক্ষেত্রে প্রচুর বাধা ও দুর্বলতা রয়েছে। সপ্তাহ বা ১৫ দিন অন্তর পরিশোধ করতে হয় বলে মাইক্রো ফাইন্যান্সের সুযোগ ক্ষুদ্র কৃষকেরা নিতে পারেন না। কারণ, তাঁদের ফসল তুলতে সময় লাগে ১২০ দিন। সরকারের দিক থেকে কৃষিঋণের জন্য তহবিল আছে। কিন্তু সেটা কৃষি উৎপাদনের পরিবর্তে কৃষি ব্যবসার ক্ষেত্রে ব্যবহার হচ্ছে। এটি নিয়ে আমরা কেউ কখনো কোনো প্রশ্ন তুলিনি। এসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে না ভাবলে ক্ষুদ্র কৃষক ও কৃষি ব্যবসার উন্নয়ন হবে না।

পার্থ সারথী রায়: আমরা ২৫ বছর ধরে সার ও বীজ নিয়ে কাজ করছি। এখন কৃষিতে সোলার সিস্টেম এনেছি। কৃষক সব সময় পণ্যের মানকে গুরুত্ব দেয়। ব্রি–২৮, ২৯ ধানের চাষের চাহিদা বাড়ছে। ক্যাটালিস্টের সঙ্গে আমরা পাঁচটি প্রকল্প নিয়ে কাজ করছি। এর মধ্যে তিস্তা ও যমুনার চরে এক লাখ ২০ হাজার কৃষককে আমাদের আওতায় আনতে পেরেছি। ক্যাটালিস্টের সহযোগিতায় একটি সফটওয়্যার করা হচ্ছে। এ সফটওয়্যার দিয়ে বাংলাদেশের যেকোনো অঞ্চলে কৃষকের ফসলের রোগবালাই এবং তার প্রতিকারের পরামর্শ দেওয়া হবে। সবাই লাভের জন্য ব্যবসা করেন। করপোরেট হাউস ছাড়া কেউ গবেষণা করছে না। আমরা ১৩০ জনের সমন্বয়ে একটি গবেষণা দল গঠন করেছি। তারা কৃষকের জমির পরিমাণ, মোবাইল নম্বরসহ তিনি কী চাষ করছেন, ভবিষ্যতে কী করবেন এসব তথ্য সংগ্রহ করবে। ঝিনাইদহের কমিউনিটি ‘রেডিও ঝিনুক’ আমাদের বিরাট ঝুঁকি থেকে রক্ষা করেছে। গত বছর ভুট্টার চাষ ভালো হওয়ায় আমরা ভেবেছি এবার আরও ২০-৩০ শতাংশ চাষ বাড়বে।

কমিউনিটি রেডিওর মাধ্যমে জানতে পেরেছি, এবার চাষ ৫০ শতাংশ কমবে। কারণ, ভুট্টার দাম ২১ থেকে আট টাকায় নেমে আসায় কৃষকের কাছে প্রচুর মজুদ রয়েছে এবং তঁারা এ বছর ভুট্টা চাষে অনাগ্রহী। কমিউনিটি রেডিওর এ তথ্য অনুযায়ী আমরা বীজ এনে​ছি। মিডিয়া এভাবে আমাদের বিপদ থেকে রক্ষা করল। বিশ্বব্যাপী এখন গ্রিন কেমিস্ট্রির চাহিদা বেড়েছে। আমরা গ্রিন কেমিস্ট্রির ব্যাপারে কাজ করছি। সমস্যা আমাদের মধ্যে, কৃষকদের মধ্যে সমস্যা নেই। কৃষকদের প্রযুক্তি দিতে হবে। প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। আমরা এসব দিতে পারছি কি না, এটি বড় প্রশ্ন।

নাজনীন আহমেদ: আজকের আলোচনার মূল বিষয় অন্তর্ভু‌ক্তিমূলক উন্নয়ন। সবার জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে উন্নয়নটা হতে হবে। কর্মসংস্থান যদি কৃষি ব্যবসা হয়, সেটা হবে গরিববান্ধব। যে কৃষক  দরিদ্র হয়ে যেতে পারতেন, তিনি এই কৃষির মাধ্যমে মূল ধারায় অবস্থান করছেন। এটিই হলো গরিববান্ধব কৃষি ব্যবসা। কৃষিতে ধনী-দরিদ্র সবার জন্য  কর্মসংস্থান হবে। ভ্যালু চেইনের সব জায়গায় উদ্যোগ গ্রহণের সুযোগ আছে। প্যাকেজিং, কোল্ড চেইন, যা-ই হোক না কেন। সরকার ব্যবসা করবে না। কিন্তু সরকারের সহযে​াগিতা ছাড়া ব্যবসা হবে না। সমস্যার জায়গাগুলোতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। দেশের অনেক জায়গায় এমন চর আছে, যেখানে কোনো ধরনের যোগাযোগব্যবস্থা নেই। তারা সপ্তাহে এক দিন দূর থেকে হাটবাজার করে। এসিআই, প্রাণ বা তাদের মতো  অন্য যারা আছে, তারা যদি এখানে কন্ট্রাক্ট ফার্মিং করে, তাহলে এই মানুষগুলো ঘুরে দাঁড়াতে পারে। অন্তর্ভুক্তিমূলক কৃষি ব্যবসায় সবার অন্তর্ভু​িক্ত না হলে উন্নয়ন হবে না।

নির্মল চন্দ্র ভক্ত: কৃষি বাংলাদেশের চালিকাশক্তি। প্রায় ৫০ শতাংশ কর্মসংস্থান কৃষিতে। ২০১৩ সালে কৃষি খাতের অবদান ১৭ দশমিক ২ শতাংশ। কৃষি একটি সম্মানিত পেশা। এটা উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণ পর্যন্ত বিস্তৃত। ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন তথ্যমতে, ফসল তোলার পর দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি ফসল নষ্ট হয়। এ অঞ্চলে পণ্যের গুণগতমান খারাপ। কৃষিপণ্য ঠিকভাবে প্রক্রিয়া করা হয় না। জমির উর্বরতা শক্তি কমে যাচ্ছে। কৃষকেরা অ​েনক সময় ফসলের ন্যায্য মূল্য পান না। ঠিকভাবে অার্থিক সেবা পান না। তবে এখন কৃষকের আর্থিক সেবার ব্যাপারে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছে।

বর্তমান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই কৃষির বিষয়টি খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রথম সভায় তিনি বলেছিলেন, কৃষিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে। কৃষিঋণের পরিমাণ আমরা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নির্ধারণ করে বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য পাঠাই। সেভাবেই বাজেট ঘোষণা হয়। সরকারের নীতিগুলো আমরা কার্যকর করি। কৃষকদের জন্য সরকার ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলার ব্যবস্থা করেছে। এ পর্যন্ত এক কোটির বেশি হিসাব খোলা হয়েছে। হিসাবগুলোকে সচল রাখার জন্য সরকার ২০০ কোটি টাকার তহবিল দিয়েছে। সরকারের দিক থেকে কৃষকদের দেওয়া সুযোগ-সুবিধাগুলো এ হিসাবে জমা হবে। এখন প্রায় দুই কোটি মোবাইল ব্যাংক হিসাব আছে। প্রতিটি ব্যাংক তার মোট ঋণের ২ শতাংশ কৃষিঋণ দিতে বাধ্য। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১৬ হাজার কোটি টাকা কৃষিঋণ দেওয়া হয়েছে। আদা, রসুন, পেঁয়াজ, ভুট্টার ক্ষেত্রে  চার শতাংশ সুদে কৃষকদের ঋণ দেওয়া হচ্ছে। অর্থের অভাবে কৃষক ফসল ফলাতে পারছেন না। তবে অন্য অনেক অসুবিধা আছে, সবাই মিলে সেগুলো দূর করতে হবে।

আনোয়ার ফারুক: সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবের ভিত্তিতে নীতিমালা পরিবর্তন করা সম্ভব। বায়োপেস্টিসাইডের বিষয়টি আমরা ভাবছি। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে আমরা প্রায় ১০০ শতাংশ জমি পাওয়ারটিলারের মাধ্যমে চাষ করি। ফসল সংরক্ষণের জায়গায় আমাদের দুর্বলতা রয়েছে। কৃষিপ্রযুক্তির জন্য সরকার প্রতিবছর অর্থ বরাদ্দ দিচ্ছে। প্রযুক্তি ক্রয়ের জন্য সরকার ২৫ শতাংশ অর্থ সহায়তা দিচ্ছে।

ফসলের মূল্য বৃদ্ধি ও ফসল সংরক্ষণের জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া উপায় নেই। কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের দ্রুত একটি নীতিমালা প্রণয়নের কাজ শেষ করব। গণমাধ্যম মুহূর্তে কোটি কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। কৃষকদের বিপক্ষে যায় এমন খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে কিছুটা সাবধানতা মেনে চলা প্রয়োজন। কৃষক বাংলাদেশের প্রাণ। কৃষকের স্বার্থটাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তাঁরা না বাঁচলে আমরা এখানে আলোচনা করতে পারব না। আজকের আলোচনার নির্দেশনাগুলো আমরা মেনে চলার চেষ্টা করব।

আব্দুল কাইয়ুম: একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষ​য় নিয়ে আজকের আলোচনা। পণ্য সংরক্ষণ, পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি. প্যাকেজিং, ঋণ, প্রযুক্তি ইত্যাদি ক্ষেত্রে আরও উদ্যোগী হতে হবে। এসব ক্ষেত্রে সরকারের সহযোগিতা খুবই জরুরি। প্যাকেজিং–ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে পারলে কৃষিপণ্যের রপ্তানি অনেক বেড়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

এসব কাজ করতে পারলে প্রান্তিক কৃষক ও দেশের উন্নতি হবে। এসব বিষয়ে সরকার অতি দ্রুত সুনির্দিষ্ট নীতিমালা গ্রহণ করবে বলে আশা করি। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।  

যাঁরা অংশ নিলেন

আনোয়ার ফারুক         :  মহাপরিচালক, সিডউইং, কৃষি মন্ত্রণালয়

নির্মল চন্দ্র ভক্ত             :  নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক

মো. হাফিজুর রহমান    :  উপসচিব, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও উপসমন্বয়ক, বিজনেস প্রমোশন কাউন্সিল

শেখ মোরশেদ জাহান   :  সহযোগী অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

নাজনীন আহমেদ          :  জ্যেষ্ঠ গবেষক, বাংলাদেশ উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান

আমজাদ খান চৌধুরী    :  প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, আরএফএল গ্রুপ, প্রাণ

ফওজিয়া ইয়াসমীন       :  জেনারেল ম্যানেজার, সাপ্লাই চেইন ও বিজনেস ডেভেলপমেন্ট, এমএম ইস্পাহানি লিমিটেড

পার্থ সারথী রায়            :  জেনারেল ম্যানেজার বিপণন, প্যাট্রোকেম বাংলাদেশ

এফ এইচ আনসারী       :  নির্বাহী পরিচালক, এসিআই এগ্রি বিজনেস

অনির্বাণ ভৌমিক           :  হেড অব পোর্টফোলিও, সুইসকন্ট্যাক্ট

ফিরোজ শাহ শিকদার   :  নির্বাহী সমন্বয়ক, লাল তীর সিড লিমিটেড

নাসির উদ্দিন আহমেদ   :  হেড অব ক্যাপিটালাইজেশন, কমিউ​িনকেশন্স ও এক্সটারনাল রিলেশন্স, ক্যাটালিস্ট

সঞ্চালক

আব্দুল কাইয়ুম              :  সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো