গরিবের বাজারটিতে এখন আর ১০ টাকায় তেল নেই
ঢাকার বিজয় সরণি থেকে তেজগাঁওয়ের দিকে যেতে উড়ালসড়কের নিচে বাজারটি। রেললাইনের পাশে গড়ে উঠেছে বলে নাম রেলওয়ে মার্কেট কাঁচাবাজার।
বাজারটির ক্রেতারা মূলত নিম্ন আয়ের। কেউ রিকশাচালক, কেউ দোকানের কর্মী, কেউ তেজগাঁও শিল্প এলাকার কারখানার শ্রমিক। তাই স্থানীয়ভাবে বাজারটি পরিচিত গরিবের বাজার বলে। এই বাজারের ক্রেতাদের ফর্দে সাধারণত আধা কেজি বা এক কেজি চাল, ১০ টাকার ভোজ্যতেল, ১০ টাকার ডাল, ৫ টাকার পেঁয়াজ—এসবই থাকে। ক্রেতার সামর্থ্য বুঝে দোকানিরা ছোট ছোট পুঁটলিতে সেই অনুযায়ী তেল, ডাল মোড়কজাত করে রাখেন।
রেলওয়ে বাজারের দোকানিরা তেলের ন্যূনতম পরিমাণের দাম ১০ টাকা থেকে ২০ টাকায় উন্নীত করার আগে অনেক দিন অপেক্ষায় ছিলেন। তাঁরা আশায় ছিলেন, দাম কমবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, দাম কমছে না; বরং বাড়ছে।
মাস দুই-তিন হলো এই বাজারে ন্যূনতম দামে বড় একটি পরিবর্তন এসে গেছে। এখন আর ১০ টাকায় সয়াবিন তেল বিক্রি হয় না। নিতে হয় কমপক্ষে ২০ টাকার। পরিমাণ বেড়েছে, তা নয়; বেড়েছে দাম।
তেজগাঁওয়ের একটি কারখানার শ্রমিক সুহেলী আক্তার মঙ্গলবার দুপুরের খাবারের বিরতির ফাঁকে গিয়েছিলেন রেলওয়ে মার্কেট কাঁচাবাজারে। উদ্দেশ্য, রাতের রান্নার জন্য কিছু কিনে রাখা। রাতে ফিরতে ফিরতে সাড়ে ৯টা বেজে যায়। তখন বাজার করে রান্নার সময় থাকে না। রাতে তাড়াতাড়ি না ঘুমালে সকালে ৮টার মধ্যে আবার কারখানায় যাওয়া যায় না।
তাড়াহুড়ার মধ্যে সুহেলী ১৬০ টাকার বাজার করলেন। সবজি ৩০ টাকার—১০ টাকার শিম, ১০ টাকার মুলা ও ১০ টাকার টমেটো। চাল কিনলেন দুই কেজি, দাম ১০০ টাকা। মোটা দানার মসুর কিনলেন এক পুঁটলি, পরিমাণ ১০০ গ্রাম, দাম ১০ টাকা। আর খোলা সয়াবিন তেল কিনলেন ২০ টাকা দিয়ে।
দেশে গত দুই বছরে অনেকটা লাফিয়ে লাফিয়ে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। ভোজ্যতেল ছাড়িয়ে গেছে সবকিছুকেই। ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাবে, ২০১৯ সালে খোলা সয়াবিন তেলের গড় দাম ছিল প্রতি লিটার ৮৮ টাকা। সেই দাম ৬৩ শতাংশ বেড়েছে। গত সোমবারই কোম্পানিগুলো খোলা সয়াবিনের দাম লিটারে ৭ টাকা বাড়িয়ে ১৪৩ টাকা নির্ধারণ করেছে।
তেল কেনার সময়ই সুহেলীর সঙ্গে দেখা। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে ১০ টাকা দিয়া যে তেল পাওয়া যাইত, সে তেল এহন ২০ টাকা দিয়া কেনা লাগছে।’
শুধু তেলের দাম নয়, সুহেলী বাজার পরিস্থিতিও তুলে ধরলেন। বললেন, ‘দুই বেলা খাওনে যা যা লাগে, সবকিছুরই দাম বেশি। করোনার চেয়েও এহন আরও বেশি কষ্টে আছি।’
করোনাকালের দুই বছর
দেশে গত দুই বছরে অনেকটা লাফিয়ে লাফিয়ে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। ভোজ্যতেল ছাড়িয়ে গেছে সবকিছুকেই। ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাবে, ২০১৯ সালে খোলা সয়াবিন তেলের গড় দাম ছিল প্রতি লিটার ৮৮ টাকা। সেই দাম ৬৩ শতাংশ বেড়েছে। গত সোমবারই কোম্পানিগুলো খোলা সয়াবিনের দাম লিটারে ৭ টাকা বাড়িয়ে ১৪৩ টাকা নির্ধারণ করেছে।
এই বাজারে তো বেশি (পরিমাণে) কেনার লোক নাই। কিন্তু তেল আর ১০ টাকায় বেচা যায় না।আয়েশা বেগম, মুদি দোকানি, রেলওয়ে মার্কেট কাঁচাবাজার
ক্যাবের হিসাবে, ২০১৯ সালে মোটা দানার মসুর ডালের গড় দাম ছিল প্রতি কেজি ৯০ টাকা। এখন সেটা ১০০ টাকা দরে বিকাচ্ছে বাজারে। দোকানিদের এক কথা, ‘নিলে নেন, না নিলে না নেন, দাম কমানো সম্ভব নয়।’ আর মোটা চাল ছিল ৪০ টাকা কেজি। এখন ছোট বাজারে তা ৫০ টাকা দিয়ে কিনতে হয়।
অর্থনীতিবিদেরা সব সময় বলেন, গরিব মানুষের খাদ্য ব্যয়ের বড় অংশজুড়ে থাকে চাল, ডাল ও ভোজ্যতেল। এগুলোর দাম বাড়লে তাদের কষ্ট বাড়ে। কারখানার শ্রমিক সুহেলী যেন সেই কষ্টের কথাই বলছিলেন। সপ্তাহে ছয় দিন সকাল ৮টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত কারখানায় কাজ করেও তাঁর সংসার চলছে কষ্টে।
‘দাম তো কমছেই না’
রেলওয়ে বাজারের দোকানিরা তেলের ন্যূনতম পরিমাণের দাম ১০ টাকা থেকে ২০ টাকায় উন্নীত করার আগে অনেক দিন অপেক্ষায় ছিলেন। তাঁরা আশায় ছিলেন, দাম কমবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, দাম কমছে না; বরং বাড়ছে।
এই বাজারে ছোট্ট একটি মুদিদোকান আয়েশা বেগমের। স্বামীহারা আয়েশার দোকানে বিভিন্ন ধরনের ডাল, ছোলা, চিনি, মসলা ও লবণ—সবকিছুর পুঁটলি ১০ টাকা। শুধু সয়াবিন তেলের পুঁটলি ২০ টাকা।
আয়েশা প্রথম আলোকে বলেন, কারওয়ান বাজার থেকে খোলা সয়াবিন তেল ১৬৫ টাকা কেজি দরে কিনে নিয়ে ১৭০ টাকা হিসাব ধরে বিক্রি করেন। এ দরে ১০০ মিলিলিটার তেলের দাম হয় ১৭ টাকা। পরিমাণে কিছুটা বাড়িয়ে দিয়ে ছোট এক পুঁটলি তেল ২০ টাকায় বিক্রি করেন তিনি।
জানতে চাইলে আয়েশা বলেন, ‘এই বাজারে তো বেশি (পরিমাণে) কেনার লোক নাই। কিন্তু তেল আর ১০ টাকায় বেচা যায় না।’
কৃচ্ছ্রসাধনে তাঁরা
বিভিন্ন জরিপে উঠে এসেছে, করোনাকালে মানুষের আয় কমেছে। বিপরীতে বেড়েছে ব্যয়। তাই আয় কাঠামোর নিচের শ্রেণিতে থাকা মানুষ কৃচ্ছ্রসাধনে ব্যস্ত। সহজ ভাষায় যাকে খরচ কমানো বলা যায়।
যেমন তেজগাঁওয়ের তেজতুরী বাজারের বাসিন্দা মো. আকাশ দুই সন্তানকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। স্ত্রী ও নিজে ঢাকায় থেকে কাজ করেন। নিজের একটি চুল কাটার সেলুন আছে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে তাঁর ব্যবসাটি ভালো চলছে না।
তাঁর ভাষ্য, করোনার মধ্যে মানুষের আয় কমে যাওয়ায় ঘন ঘন চুল-দাড়ি কাটাচ্ছেন না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিশুদের নিয়মিত চুল কাটানোর তাগিদ নেই। বয়স্করা করোনার ভয়ে ঘর থেকে বের হন না।
নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় নিম্ন আয়ের মানুষের ব্যয় নানাভাবে বেড়েছে। রিকশাচালক কালাম হোসেন বলছিলেন, মালিক রিকশার দৈনিক জমা ২০ টাকা বাড়িয়ে ১২০ টাকা করেছেন।
এদিকে সরকারি সংস্থাগুলো পানি, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে।