গাঁজা সোসাইটির শত কোটি টাকার সম্পদ বেহাতের আশঙ্কা

নওগাঁর গাঁজা উৎপাদনকারী পুনর্বাসন সমবায় সমিতির (গাঁজা সোসাইটি) কয়েক শ কোটি টাকার সম্পদের সঠিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে উৎকণ্ঠায় আছেন সমিতির সদস্যরা। সমিতির সাবেক নেতারা এর সম্পদ ব্যবস্থাপনা নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন দায়িত্বে থাকা সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। আর সমিতির সাবেক নেতাদের প্রতি ইঙ্গিত করে এর সম্পদ বেহাত হওয়ার ঝুঁকি দেখছেন জেলা প্রশাসক।
সমিতির সদস্যদের অভিযোগ, আট বছর ধরে সমিতিতে কোনো নির্বাচিত প্রতিনিধি নেই। এর ফলে সদস্যরা ভাতাসহ প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অ্যাডহক (অস্থায়ী) কমিটির দু-একজন সদস্য এবং নির্বাহী দায়িত্ব পাওয়া কোনো কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এসব তদন্তে কমিটি গঠিত হলেও দীর্ঘ পাঁচ মাসেও তারা কাজ শুরু করেনি।
লেখক ও গবেষক মো. খোসবর আলী লিখিত নওগাঁ জেলার ইতিহাস এবং অধ্যাপক মোহাম্মদ শাসসুল আলমের এক প্রবন্ধ (রবীন্দ্র জার্নাল, সংখ্যা-১৫, ২০১৩) থেকে জানা গেছে, প্রধান দপ্তর ভবনসহ এই সমিতির নিজস্ব সম্পত্তির মধ্যে আছে ৪০ একর জমি। আছে ৪০টি দালানকোঠা, একটি হিমাগার, চারটি গোডাউন, একটি সরাইখানা, একটি মিটিং গ্রাউন্ড, তিনটি দাতব্য চিকিৎসালয়, ১১টি উচ্চবিদ্যালয়, তিনটি মসজিদ, একটি মন্দির, সাতটি বড় পুকুর ও একটি লেক। নওগাঁ সদরের বিভিন্ন জায়গায় এসব সম্পদ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। তবে সমিতি বা সরকারি অন্য কোনো সূত্র থেকে সম্পদের পূর্ণ হিসাব পাওয়া যায়নি।
আগের কমিটির নেতারা এবং সমিতির সদস্যরা জানান, সমিতির নির্বাচিত প্রতিনিধি না থাকায় প্রয়াত সদস্যদের উত্তরাধিকারীরা অংশীদারত্বের দাবি প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন সমস্যায় পড়ছেন। এ অবস্থায় সদস্যদের যথাযথ প্রাপ্য নিশ্চিত করতে গাঁজা সোসাইটি সম্পদ রক্ষা কমিটি গঠন করে আন্দোলনে নেমেছে।
গাঁজা সোসাইটি কী: সংগঠনটির জন্ম ব্রিটিশ আমলে। তখন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় নওগাঁয় বাণিজ্যিকভাবে গাঁজার চাষ হতো। প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমি ছিল গাঁজা চাষের আওতায়। এতে যুক্ত ছিলেন প্রায় সাত হাজার চাষি। জেলার কীর্তিপুর, বক্তারপুর, বর্ষাইল, হাঁপানিয়া ও তিলকপুর ইউনিয়নে এ মাদকের চাষ হতো। নওগাঁর এই গাঁজাচাষিদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ১৯১৭ সালে গড়ে তোলা হয় গাঁজা উৎপাদনকারী পুনর্বাসন সমবায় সমিতি লিমিটেড। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৪ সালে সরকার গাঁজা উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিপণন বন্ধ করার একটি আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৮৭ সালে নওগাঁয় গাঁজার চাষ বন্ধ করে দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন ধরে এই চাষের ওপর নির্ভরশীল কৃষক পরিবারগুলোর একমাত্র অবলম্বন হয়ে দাঁড়ায় তাদের সমবায় সমিতি। সেখান থেকে তারা সামান্য ভাতাও পেত।
অচলাবস্থার শুরু: গাঁজা উৎপাদনকারী পুনর্বাসন সমবায় সমিতি ও জেলা সমবায় দপ্তর সূত্রে জানা যায়, বতর্মানে সমিতির সদস্য প্রায় সাড়ে ছয় হাজার। ২০০৬ সালে সমিতির নির্বাচন নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। সমিতির শেয়ারহোল্ডারদের তালিকা হালনাগাদ এবং ডেলিগেট-ব্যবস্থা (৫০ জন সদস্যের একজন প্রতিনিধি) বাতিল করে সদস্যদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচন চেয়ে মোফাখখারুল ইসলাম নামের এক সদস্য হাইকোর্টে রিট করেন। হাইকোর্টের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সমবায় মন্ত্রণালয় অ্যাডহক (অস্থায়ী) কমিটি গঠন করে। কমিটিকে তিন মাসের মধ্যে সমিতির অংশীদারদের তালিকা হালনাগাদ করে নির্বাচন করা এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে সমিতির সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের ভার দিতে বলা হয়। কিন্তু তা করা হয়নি।
বর্তমানে তিন সদস্যের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মেহেদী উল সহিদ। কমিটির বাকি দুই সদস্য হলেন পুলিশ সুপারের প্রতিনিধি সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মোহসিন উদ্দিন ও জেলা সমবায় কর্মকর্তার প্রতিনিধি আতোয়ার রহমান।
নির্বাচন স্থগিত হয়ে যাওয়ার পর নওগাঁ সদরের সমবায় কর্মকর্তা কে এম সরওয়ার্দ্দীকে অতিরিক্ত জেলা অডিটর (রাজস্ব কর্মকর্তা) হিসেবে দায়িত্ব দিয়ে সমিতির ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা করা হয়। তাঁর সময়ে সমিতির সম্পদ নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গাঁজা সোসাইটি সম্পদ রক্ষা কমিটি সমবায় অধিদপ্তরে অভিযোগ করে। সমবায় মন্ত্রণালয় গত ১৮ জানুয়ারি তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত কমিটিকে পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে সুপারিশসহ তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও কমিটি কাজ শুরু করেনি।
জেলা সমবায় কর্মকর্তা মো. মোখলেছার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার জানামতে, সেই কমিটি এখনো তদন্তকাজ শুরু করেনি। তদন্ত শুরু হলে আমি স্থানীয় কর্মকর্তা হিসেবে সেই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকতাম।’
গত বৃহস্পতিবার থেকে সমিতির নির্বাহী পদে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন নওগাঁ সদর উপজেলার সমবায় কর্মকর্তা সালাহ উদ্দিন সিদ্দিক। এর আগে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মেহেদী উল সহিদ এই পদে ছিলেন। নির্বাহী কর্মকর্তা তাঁর কাজের জন্য অ্যাডহক কমিটির কাছে দায়বদ্ধ থাকবেন। তিনি কোনো নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না।
সদস্যদের দাবি: সমিতির নির্বাচিত সাবেক পরিচালক ইমদাদুল হক বলেন, নির্বাচিত কমিটি থাকা অবস্থায় প্রত্যেক সদস্য প্রতিবছর দু-তিন হাজার টাকা করে ভাতা পেতেন। সমিতির তহবিল থেকে প্রতিবছর বিভিন্ন স্কুল-কলেজে অনুদান দেওয়া হতো। ছাত্রবৃত্তি দেওয়া হতো। তিনটি দাতব্য চিকিৎসালয় ছিল। একটি পশু চিকিৎসাকেন্দ্র ছিল। এমনকি সমিতির টাকা থেকে রাস্তাঘাট, ব্রিজ পর্যন্ত করা হতো। বর্তমানে শহরের ছোট যমুনা নদীর ওপর নির্মিত লিটন ব্রিজ এই সমিতির টাকায় নির্মিত। কিন্তু এখন এর কোনো কিছুই হচ্ছে না।
নওগাঁ পৌরসভার কীর্তিপুর গ্রামের ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ সালাহ উদ্দিন বলেন, ‘আমার মতো চাষিদের কষ্টের টাকায় তিল তিল করে জমানো সম্পদ আমার কোনো কাজে লাগে না। ভাতা তো দূরে থাক, নওগাঁ শহরে গেলে দাঁড়ানোর জায়গা পর্যন্ত পাই না। একসময় প্রতিবছর সমিতির সাধারণ সদস্যদের নিয়ে মিটিং গ্রাউন্ড (বর্তমানে নওগাঁ টেনিস গ্রাউন্ড) সভা ডাকা হতো। খাওয়া-দাওয়া হতো। তারপর সদস্যদের অংশীদার হিসেবে ভাতা দেওয়া হতো।’
দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ: গাঁজা সোসাইটি সম্পদ রক্ষা কমিটি অভিযোগ করেছে, সমিতির নির্বাহী পদে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পাওয়া রাজস্ব কর্মকর্তা কে এম সরওয়ার্দ্দী যেসব কাজ করেছেন, তা করার এখতিয়ার একমাত্র জেলা প্রশাসকের। পদাধিকারবলে ডিসিই সমিতির সভাপতি।
জানতে চাইলে কে এম সরওয়ার্দ্দী বলেন, ‘আমি অন্যায় কিছুই করিনি। ডিসি সাহেব যদি আমাকে কোনো কাগজে সই করতে বলেন, তাহলে আমি করব না? একসময় গাঁজা সোসাইটি সম্পদ রক্ষা কমিটির লোকজন ডিসির কাছে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে গিয়েছিলেন। ডিসি সাহেব তাঁদের বলেছেন, আমি তাঁকে সই করতে বলছি।’
প্রথম আলোকে কে এম সরওয়ার্দ্দী বলেন, ‘একটি মহল সোসাইটির সম্পদ কুক্ষিগত করার চেষ্টা করছে। তারাই আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তুলছে। আমি দায়িত্বে থাকা অবস্থায় অত্যন্ত কষ্ট করে সমিতির ২৬ একর জায়গা ধরে রেখেছিলাম।’
কে এম সরওয়ার্দ্দী বর্তমানে জয়পুরহাট জেলার কালাই উপজেলার সমবায় কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন।
সম্পদ রক্ষা কমিটির উপদেষ্টা ময়নুল হক অভিযোগ করেন, একসময়ের বিভাগীয় সমবায় কর্মকর্তা অমিয় চন্দ্রের সময়ে সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের নির্বাহী ক্ষমতা পরিবর্তন করা হয়। এরপর কিছু অসৎ পরিচালকের যোগসাজশে সমিতির ১০টি বাড়ি নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে দেওয়া হয়।
উপদেষ্টা ময়নুল হক বলেন, ‘কেবল গত বছরই গাঁজা সোসাইটির সম্পদ থেকে আয় হয়েছে প্রায় ৭০ লাখ টাকা। এই টাকা সমিতির তহবিলে জমা হওয়ার কথা। এই টাকাগুলো এখন কীভাবে খরচ হচ্ছে, তা স্পষ্ট নয়।’
স্থানীয়ভাবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গাঁজা সোসাইটির যেসব বাড়ি ভাড়া দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর ভাড়া বর্তমানে নওগাঁ শহরে পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা করে হবে। অথচ সোসাইটির একটি বিল্ডিং স্কুলকে এবং একটি বিল্ডিং কলেজকে ভাড়া দেওয়া আছে প্রায় চার হাজার টাকা করে। বাকি ভবনগুলোর ভাড়াও তিন হাজার টাকার নিচে বলে জানা গেছে।
সম্পদ রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক আবদুল কাদের সিদ্দিক বলেন, ‘প্রয়োজনে নতুন অ্যাডহক কমিটি করে অথবা সোসাইটির সদস্যদের তালিকা হালনাগাদ করে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হোক। আমরা মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করেছি। কিন্তু কোনো প্রতিকার নেই। এতে সদস্যরা সমিতির সম্পদ বেহাত হওয়ার আতঙ্কে আছেন।’
জেলা প্রশাসক এনামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘তদন্তের জন্য আমাকে মন্ত্রণালয় থেকে এখনো জানানো হয়নি। গাঁজা সোসাইটি সম্পদ রক্ষা কমিটি কিছুদিন আগে একটি অনুলিপি দিয়েছে। তবে সোসাইটির এসব নেতার কাছে ক্ষমতা গেলে সোসাইটির সম্পদ ঠিক থাকবে কি না, এ বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে।’