
গাইবান্ধা শহরের ডিবি রোড লাগোয়া নবারুণ বাণিজ্য সংস্থা। চাল, ডাল, ময়দা, চিনি—এসবের বড় আড়ত। একটি পিকআপ ভ্যান এসে থামল সংস্থার সামনে, দুপুর ১২টা নাগাদ। চালকের আসন থেকে নেমে শুকনো মুখ মলিন চেহারার এক যুবক এসে মহাজনের গদির সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ভাই, মাল নিয়া যাওয়া নাগবে?’
গাইবান্ধা শহরের ব্যবসা-বাণিজ্যের হালহকিকত নিয়েই বুধবার কথা হচ্ছিল এই প্রতিষ্ঠানের মালিক দেওয়ান মশিউর রহমানের সঙ্গে। তিনি ওই যুবকের দিকে নির্দেশ করে বললেন, ‘নিজেই দেখেন অবস্থাটা কেমন। মালামাল আনা-নেওয়ার জন্য আগে আমরাই ওদের ডেকে আনতাম। এখন ওরাই আড়তে আড়তে ঘুরছে কাজের জন্য।’
পিকআপচালক মাহফুজার রহমান। শহরের কঞ্চিপাড়ায় বাড়ি। বুড়ো বাবা-মাসহ লোক পাঁচজন। আগের দিন মঙ্গলবার কোনো ভাড়া হয়নি। বুধবারও তখন পর্যন্ত একই অবস্থা। বাধ্য হয়ে ভাড়ার খোঁজে বের হয়েছেন। মাহফুজারদের মতো পিকআপচালকেরা গাড়ি চালান চুক্তিতে। যা ভাড়া হয়, তার ২০ শতাংশ টাকা পান। এর সঙ্গে ভাড়া পাওয়া গেলে দুপুরের খাবারের জন্য অতিরিক্ত ৭০ টাকা প্রতিদিন।
গত ৬ জানুয়ারি থেকে বিএনপি-জামায়াতের টানা হরতাল-অবরোধে মুখ থুবড়ে পড়েছে গাইবান্ধা শহরের ব্যবসা-বাণিজ্য। ফেব্রুয়ারির মাঝ পর্যন্ত দোকানপাট একরকম বন্ধই ছিল। এরপর যা-ও বা একটি-দুটি করে দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খুলতে শুরু করেছে, তবে লেনদেন তলানিতে। শহরের ব্যবসা বলতে সিংহভাগই ক্ষুদ্র ও মাঝারি দোকান। পুঁজি ভেঙে খেতে হচ্ছে তাঁদের। বড় ব্যবসায়ীদের অবস্থাও তথৈবচ। শ্রমজীবী আর স্বল্প বেতনের দোকান কর্মচারীরা ধারদেনা করে চলছেন।
যে মহাজনের কাছে কাজের খোঁজে এসেছিলেন মাহফুজার, সেই দেওয়ান মশিউর বললেন, তাঁর অবস্থা আরও খারাপ। বড় কারবার, দায়দেনাও বড়। এই মহাজনি কারবার ছাড়াও তাঁর নিজের একটি সেমি অটো চালকল আছে। প্রতিদিন তাতে প্রায় ৩০ মেট্রিক টন ধান ভানা যায়। হরতাল শুরুর পর থেকে কল বন্ধ। ঠিকা শ্রমিক ৪০ জন। তাঁরা বেকার। স্থায়ী শ্রমিক-কর্মচারী নয়জন। তাঁদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিতে হচ্ছে। তাঁর দুটি ট্রাক আছে, চলছে না। গত ৭০ দিনে প্রায় ১৪ লাখ টাকার লোকসান। ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, চকরিয়া, চাকতাই, উখিয়া—এসব এলাকায় তাঁরা চাল পাঠান। ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঠানো চালের দাম পাননি।
দেওয়ান মশিউরের কাছে চালের কারবারের যে তথ্য পাওয়া গেল, তা বিপর্যয়কর। গাইবান্ধায় অটো, সেমি-অটো চালকল প্রায় ৩০টি। সব কটি বন্ধ। ছোট চাতাল ও কলের সংখ্যা প্রায় ৭০০। এগুলোও বন্ধ। তাঁর হিসাবে চালকল ব্যবায়ীদের প্রায় ১৫ কোটি টাকা নিট লোকসান হয়েছে। এর চেয়েও বড় ক্ষতি হয়েছে মাঝারি কৃষকদের। কল বন্ধ বলে বাজারে ধানের চাহিদা কম। আমনের দাম ছিল ৭৫০ টাকা মণ। তা নেমে এসেছে ৬৩০ টাকা থেকে ৬৫০ টাকায়।
গাইবান্ধার অর্থনীতি মূলত ধাননির্ভর। ইরি ওঠার আগ পর্যন্ত আমন দিয়ে কৃষকেরা খোরাকির খরচ মেটান। ইরির ফলন বেশি। এর ওপর দিয়েই চলে তাঁদের সংসারের অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর কেনাকাটা, বিয়ে ইত্যাদি বড় খরচ। মাঠে ইরির চারা বিঘত খানেক লম্বা। ধান উঠবে মে মাস নাগাদ। মাঝের এই দিনগুলো কৃষকেদের যেমন অর্থকষ্টে পড়তে হয়েছে, তেমনি জেলার পুরো ব্যবসা-বাণিজ্যেও ঘোরাতর মন্দার সৃষ্টি করেছে।
শহরের স্টেশন রোডে তিনতলা সামিয়া সুপার মার্কেট। এটিই শহরের সবচেয়ে বড় ও চালু মার্কেট। মোট ১৩০টি দোকান। টানা বন্ধ থাকায় লোকসান সামাল দিতে না পেরে আদি ফ্যাশন, ইয়োর চয়েজ, প্রজ্ঞা ফ্যাশন, মিম ফ্যাশন ও ধানসিড়ি নামের পাঁচটি পোশাকের দোকানমালিকেরা ব্যবসাই গুটিয়ে ফেলেছেন। জানালেন মার্কেটের দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক বাপ্পা সাহা। পোশাকের দোকান সুকন্যার মালিক হাসান ইকবাল ও বাপ্পার কাছ থেকে একটি এক ইউনিটের দোকানে মাসে নিম্নতম কত খরচ হয়, তার একটি হিসাব পাওয়া গেল। দোকানের পজিশনটি যদি মালিকের নিজের হয়, তাহলে তাঁর মাসে অনিবার্য খরচ হবে বিদ্যুৎ বিল ন্যূনতম ১ হাজার টাকা, ভ্যাট ৪৬৬ টাকা, আয়কর (টিআইএন) ৩০০ টাকা, ট্রেড লাইসেন্স ফি ৪০ টাকা, জেলা প্রশাসনের ডিলিং ফি ২০ টাকা, মার্কেটের সার্ভিস চার্জ ৩০০ টাকা, জমির মালিকের মাসিক নজরানা ৫৫০ টাকা, একজন কর্মচারীর (ন্যূনতম) বেতন ৫ হাজার টাকা, চা ইত্যাদি ৩০০ টাকা। একুনে সর্বনিম্ন ৭ হাজার ৬৭৬ টাকা। আসলে বিদ্যুৎ বিল, চা-আপ্যায়ন, কর্মচারীর বেতন ও সংখ্যা বাড়ে। খরচ মূলত ১০ হাজার টাকা ছাড়িয়ে যায়। আর দোকান ভাড়া নিলে এর সঙ্গে আরও বাড়তি যোগ হবে ছয় হাজার টাকা। যাঁদের ব্যাংক ঋণ আছে, তাঁদের সুদ যোগ হয়। এসব খরচ ওঠার পরে যা লাভ থাকে, তা-ই দিয়ে সংসার চলে। ওই দুই ব্যবসায়ী জানালেন, দোকান এখন যদিও বা খুলছেন, তবে কোনো দিন এক টাকাও বিক্রি হয় না। তাঁদের ভাষায় ‘সাঁইত’ই হয় না। এসব দোকানে দিনে গড়পড়তা ৮-১০ হাজার টাকার বেচাবিক্রি হতো। সর্বোচ্চ এখন বিক্রি হয় হাজার খানেক টাকার। গ্রামীণ জুয়েলার্সের স্বর্ণালংকার ব্যবসায়ী শরিফুল ইসলাম বললেন, কোনো কোনো দিন দেড় শ-দুই শ টাকার একটি নাকফুল বিক্রিই সর্বোচ্চ। তাঁর বক্তব্য, ‘তা প্রায় ২৫ বছর ব্যবসা করি। জীবনে এত বড় সংকটে আর পড়িনি।’
সমবায় মার্কেটের ঘড়ি-চশমার দোকান টাইম হাউসের সাদ্দাম হোসেন বললেন, সংসারে মাসে প্রায় ২০ হাজার টাকা খরচ। দেড় মাসের ওপরে দোকান বন্ধ। এখনো বিক্রি নেই। বাধ্য হয়ে পুঁজি ভেঙে খাচ্ছেন। নিউমার্কেটের ইলেকট্রিক সামগ্রীর দোকান আশা ইলেকট্রিকের মালিক মতিউর রহমান জানালেন, সপ্তাহের দু-তিন দিন হয়তো বিক্রি হয়। ডিবি রোডের আলফাজ সু’জ-এর হাসান আলী বললেন, ঢাকার মহাজনের কাছ থেকে তাঁরা অল্প কিছু টাকা দিয়ে মাল নিয়ে আসেন। বিক্রি করে বকি টাকা দেন। আবার নতুন মাল আনেন। এভাবেই চলে। বেচাকেনা যৎসামান্য যা হচ্ছে, তাতে মহাজনের টাকা দেওয়ার সামর্থ্য নেই। তিনি বললেন, ‘ঢাকাত থাকি ট্যাকার জন্যে মহাজন বারবার ফোন করে। সেই ভয়ত ফোন বন্ধ রাখছি।’ কিন্তু এভাবে যে বেশি দিন চলবে না, তা-ও বুঝতে পারছেন।
অনিয়মিত হয়ে পড়েছে দোকান কর্মচারীদের বেতন। মালিকের সামনেই কর্মচারী বুলবুল আহমেদ বললেন, ‘আমাদের কথাও একটু শোনেন বাহে। মাত্র চাইর হাজার টাকা বেতন। তা-ও ফির বাকি পড়ি গেছে।’ রাজনীতিকদের কাছে তাঁরা জানতে চাইলেন, কেমন করে দিন চলবে তাঁদের।
গাইবান্ধা চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আবুল খায়ের মোরছালিন পারভেজ প্রথম অলোকে বললেন, ‘গাইবান্ধার ছোট-বড় সব ব্যবসায়ীর কোমর ভেঙে গেছে। আমাদের কথা কাকে বলব। অনেকেই পুঁজি ভেঙে খাচ্ছে। ক্যাশ নাই, প্রফিট নাই—আমরা খুব অসহায় অবস্থায় আছি। বিভীষিকাময় সময় যাচ্ছে।’
গাইবান্ধার অর্থনীতি সম্পর্কে তিনি ব্যাখ্যা দিলেন এভাবে—এটি একটি পকেট শহর। অবস্থান মহাসড়ক থেকে প্রায় কুড়ি কিলোমিটার ভেতরে। ব্যবসা-বাণিজ্য মূলত মাঝারি ও ক্ষুদ্র দোকান। অর্থনীতি ধান ও কায়িক শ্রমনির্ভর। প্রতিদিন ৪০টির মতো বাস ঢাকায় যাতায়াত করে। এসব বাসের ছাদে ভর্তি শত শত শ্রমিক ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন এলাকায় যান। বেশির ভাগই নির্মাণশ্রমিক, অনেকে রিকশা চালান। তাঁরা যে টাকা পাঠান, সেই টাকা স্থানীয় দোকানগুলোর কেনাবেচায়ই বড় অংশ খরচ হয়। এ ছাড়া ইরি ধানের মৌসুমে দোকানে কেনাকাটা বাড়ে। একটি ফ্যান কিনতে হলেও লোকে ইরি ধান ওঠার অপেক্ষায় থাকেন। একদিকে এই শ্রমজীবী লোক বাইরে যেতে পারছেন না বা বাইরে গেলেও কাজ তেমন পাচ্ছেন না, অন্যদিকে ইরি উঠতেও দেরি আছে। এদিকে হরতাল-অবরোধ চলছেই। এতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে গাইবান্ধার অর্থনীতি।