গাছ থেকে ছাগল নামছে, ওড়নার বদলে ওজন

ব্যাপক সমালোচনার মুখে প্রাথমিকের পাঠ্যবই থেকে গাছে ওঠানো ছাগলের ছবি নামানো হচ্ছে। ‘ও-তে ওড়নার’ বদলে ‘ওজন’ শব্দ ও ছবি অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এ রকম আরও কিছু বিষয় পরিমার্জন করে আগামী বছরের পাঠ্যবই ছাপানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।

অন্যদিকে মাধ্যমিকের ১২টি বই নির্ভুল ও সহজ করা হচ্ছে, যার মধ্যে নবম-দশম শ্রেণির বাংলা বই থেকে হেফাজতে ইসলামের দাবি অনুযায়ী বাদ দেওয়া বিষয়গুলো ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব করছে সরকারের গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি। ইতিমধ্যে ওই কমিটি প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে।

চলতি বছর প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পাঠ্যবইয়ে বিশেষ করে বাংলা ও আনন্দপাঠে হেফাজতে ইসলামের দাবি মেনে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়। প্রাথমিকের পাঠ্যবইয়ে ভুলত্রুটি ও অসংগতি কম থাকলেও কয়েকটি বিষয় স্পর্শকাতর হওয়ায় সমালোচনা হয় বেশি। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণিতে ‘ও’ বর্ণ দিয়ে ওড়না শব্দ শেখানোর চেষ্টা নিয়ে সমালোচনা হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং এনসিটিবি এ ধরনের বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে বিব্রত হয়। হেফাজতে ইসলাম পাঠ্যবই থেকে যেসব বিষয় বাদ দেওয়ার দাবি করেছিল, চলতি বছরের পাঠ্যবইয়ে আনা পরিবর্তনের সঙ্গে সেসব দাবি প্রায় হুবহু মিলে যায়। সংগঠনটি ২৯টি বিষয় সংযোজন ও বিয়োজনের কথা বলেছিল, যার প্রায় সব কটিই মানা হয়।

গত এপ্রিলে নবম-দশম শ্রেণির ১২টি বই সুখপাঠ্য করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিশেষজ্ঞদের দিয়ে ১২টি কমিটি গঠন করে। এর মধ্যে বাংলা বিষয়ের কমিটি গত বছর পর্যন্ত বইটিতে যেসব গল্প-কবিতা ছিল, সেগুলো পুনঃস্থাপন করার প্রস্তাব তৈরি করেছে। হেফাজতের দাবির সঙ্গে মিল রেখে এ বছর ওই বই থেকে পাঁচটি পদ্য ও একটি গদ্য বাদ দেওয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ প্রথম আলোকে বলেন, বইগুলো সুখপাঠ্য করার জন্য শিক্ষাবিদদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাঁদের সুপারিশ পেয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

এনসিটিবির একটি সূত্র জানায়, আগামী বছরের বই ছাপার বিষয়ে গত মার্চে কর্মশালার আয়োজন করেছিল এনসিটিবি। সেখানে বই থেকে বিতর্কিত বিষয়গুলো বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। চলতি বছরের প্রাথমিকের প্রথম শ্রেণির আমার বাংলা বইয়ে বর্ণ পরিচয়ে (পাঠ-৭) ‘অ’ শেখাতে গিয়ে অজ হিসেবে ছাগলের ছবি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু একটি ছবিতে দেখা যায়, ছাগল গাছে উঠছে, যা নিয়ে তীব্র সমালোচনা হয়। কারণ, স্বাভাবিকভাবে ছাগল গাছে উঠতে পারে না। এখন সেটি পরিমার্জন করে ছাগল গাছের নিচ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে এমন ছবি দেওয়া হবে।

একই বইয়ের পাঠ-১২ তে ‘ও-তে ওড়না চাই’ বলা আছে। এখানে ছবি হিসেবে একটি মেয়েশিশুর গায়ে ওড়না দেওয়া হয়। সমালোচকেরা বলছেন, প্রথম শ্রেণির একজন শিশুর শারীরিক ও মানসিক অবস্থার সঙ্গে ‘ও’তে ওড়না শেখানোর বিষয়টি সংগতিপূর্ণ নয়। তা ছাড়া ছেলেশিশুরাও বইটি পড়ে। এখন সেটি পরিমার্জন করে ‘ও-তে ওজন’ শব্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এতে ওজন পরিমাপক যন্ত্রের ছবি দেওয়া হচ্ছে। পরিমার্জিত ছবিতে দেখা যাচ্ছে, একটি মেয়েশিশু ওজন পরিমাপক যন্ত্রের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ছবির নিচে লেখা ‘ওজন নাও’।



এ ছাড়া তৃতীয় শ্রেণির আমার বাংলা বইয়ে কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল্‌ চল্‌ চল্‌’ কবিতার ভিত্তিতে যুক্তবর্ণ দিয়ে নতুন শব্দ তৈরি করা ও পড়ার অংশটুকু পরিমার্জন করে বাদ দেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে এনসিটিবির একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, জটিল ও কঠিন হওয়ায় এই অংশটুকু বাদ দেওয়া হচ্ছে। তবে অন্য বিষয়গুলো আগের মতো থাকছে। কয়েকটি কবিতায় কিছু লাইন বাদ দেওয়া হয়েছিল, আগামী বছরের বইয়ে সেগুলো ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ছাড়া শুদ্ধিপত্র অনুযায়ী তৃতীয় শ্রেণির ‘আমার বাংলা বই’-এ কুসুমকুমারী দাশের ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতাটি আগামী বছরের বইয়ে শুদ্ধভাবে ছাপা হবে। ভুল হওয়ার পর কিছুদিন আগে এটি আলাদা শুদ্ধিপত্র দিয়ে সংশোধন করা হয়। ইতিমধ্যে পরিমার্জিত এসব বইয়ের পাণ্ডুলিপি চূড়ান্ত হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম ও প্রাথমিকের অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান আগামী বছরের প্রাথমিকের পাঠ্যবইয়ের কিছু বিষয় পরিমার্জনের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তবে নবম-দশম শ্রেণির বই নিয়ে বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রস্তাবের বিষয়ে তিনি কিছু বলতে রাজি হননি।

বাদ দেওয়া বিষয়গুলো সংযোজনের প্রস্তাব
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, নবম ও দশম শ্রেণির ১২টি পাঠ্যবই পরিমার্জন করে সহজ করা হচ্ছে। ১২টি বইয়ের মধ্যে বাংলা সাহিত্য বইটি পরিমার্জনের নেতৃত্বে আছেন শহীদজায়া শ্যামলী নাসরীন চৌধুরী, ইংলিশ ফর টুডে বইয়ের নেতৃত্বে অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ের নেতৃত্বে অধ্যাপক আখতারুজ্জামান, বাংলাদেশ ও বিশ্বসভ্যতা বইয়ের নেতৃত্বে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান তাসলিমা বেগম এবং গণিত, উচ্চতর গণিত, সাধারণ বিজ্ঞান, পদার্থ, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান—এই ছয় বিষয় পরিমার্জনে নেতৃত্বে আছেন অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও মোহাম্মদ কায়কোবাদ। হিসাববিজ্ঞানে অধ্যাপক মীজানুর রহমান ও অর্থনীতি বিষয়ে পরিমার্জনের নেতৃত্বে আছেন অধ্যাপক এম এম আকাশ।

কমিটি সূত্রে জানা যায়, শিক্ষাবিদেরা ইতিমধ্যে তাঁদের কাজ প্রায় শেষ করেছেন। জানতে চাইলে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পাঠ্যবইয়ে যে পরিবর্তন আনা হয়েছিল তা অনাবশ্যক। পাঠ্যবইয়ে কোনোভাবেই সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি প্রবেশ করানো উচিত নয়। তিনি ইংরেজির বইটি নির্ভুল করে জমা দিয়েছেন বলে জানান।

কমিটির দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, নবম-দশম শ্রেণির বাংলা বইয়ে হেফাজতে ইসলামের দাবি অনুযায়ী যেসব গল্প ও কবিতা বাদ দেওয়া হয়েছে, আগামী বছরের বইয়ে সেগুলো সংযোজন করার প্রস্তাব করতে যাচ্ছে বিশেষজ্ঞ কমিটি। এই শ্রেণিতে হেফাজতে ইসলামের দাবি অনুযায়ী পাঁচটি পদ্য বাদ দেওয়া হয়। সেগুলো হলো জ্ঞানদাসের ‘সুখের লাগিয়া’, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের ‘আমার সন্তান’, লালন শাহর ‘সময় গেলে সাধন হবে না’, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘স্বাধীনতা’ ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সাঁকোটা দুলছে’। বাদ দেওয়া গদ্যটি হলো ভ্রমণকাহিনি ‘পালামৌ’। এসবের পরিবর্তে শাহ মুহম্মদ সগীরের ‘বন্দনা’, আলাওলের ‘হামদ’, আবদুল হাকিমের ‘বঙ্গবাণী’, গোলাম মোস্তফার ‘জীবন বিনিময়’ ও কাজী নজরুল ইসলামের ‘উমর ফারুক’ কবিতা অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

অন্যান্য বই পরিমার্জনের দায়িত্বে থাকা শিক্ষাবিদদের প্রায় সবাই বাংলা বইয়ের আগের বিষয়গুলো ফিরিয়ে আনার এই প্রস্তাবের পক্ষে। জানতে চাইলে অর্থনীতির বই পরিমার্জনের দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক এম এম আকাশ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরাও আশা করছেন হেফাজতের দাবি অনুযায়ী বাদ দেওয়া বিষয়গুলো পুনঃস্থাপনের প্রস্তাব করবে বিশেষজ্ঞ কমিটি। এর আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় একই প্রত্যাশার কথা জানিয়ে বক্তব্য দিয়েছিলেন অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল।

 কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক আবুল মোমেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘হেফাজতে ইসলামের বিবেচনা কেবল ধর্মীয় দৃষ্টিতে। কিন্তু পাঠ্যবই হতে হবে আমাদের সংস্কৃতি, ভাষামূল্য ও সাহিত্যমূল্য আছে কি না তার ভিত্তিতে। আর এটি কেবল একটি-দুটি বইয়ের বেলায় করলেই হবে না, সব বই হতে হবে এই বিবেচনায়।’