কাওসার আহ্মেদ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। একই সঙ্গে তিনি বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থায় আইনবিষয়ক পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক আইন পড়ান। ২৮ জানুয়ারি তথ্য সুরক্ষা দিবসে ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার আইনি দিকগুলো নিয়ে তিনি কথা বলেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক শেখ সাবিহা আলম।
প্রথম আলো : ব্যক্তিগত তথ্যের আওতা কী? সংবিধান বা দেশের প্রচলিত আইন কী বলে?
কাওসার আহ্মেদ: দেশের সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা রক্ষার (সংবিধান অনুসারে শব্দটি ‘গোপনতা রক্ষার’) অধিকার মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। অর্থাৎ গোপনীয়তা রক্ষায় রাষ্ট্র ওয়াদাবদ্ধ। ‘ব্যক্তিগত তথ্য’ এবং ‘গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার’ আপাতদৃষ্টে একই মনে হলেও এ দুটি বিষয় আদতে এক নয়। সব ব্যক্তিগত তথ্য গোপনীয়তা রক্ষার অধিকারের আওতায় না–ও পড়তে পারে। এমনকি দেশের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, জননৈতিকতা ও জনস্বাস্থ্য প্রভৃতি কারণে গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার ক্ষেত্রবিশেষে বলবৎযোগ্য না–ও হতে পারে।
বাংলাদেশের সংবিধান সরাসরি ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। তবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন–২০১৮; বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন–২০০১; পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন–২০১২ প্রভৃতি আইনের কয়েকটি ধারায় কিছু সুরক্ষামূলক বিধান যুক্ত করা আছে, যা ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত বলে মনে করা যেতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা ও নিয়ন্ত্রণবিষয়ক কোনো আইন প্রণীত হয়নি। ফলে দেশের আইনে ব্যক্তিগত তথ্যের কোনো সংজ্ঞা পাওয়া যায় না।
ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন সবচেয়ে এগিয়ে আছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের জেনারেল ডেটা প্রটেকশন রেগুলেশন–২০১৬–এর ৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ব্যক্তিগত তথ্য হলো একজন চিহ্নিত বা শনাক্তযোগ্য ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত যেকোনো তথ্য।
প্রথম আলো: আপনি ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলোর কথা বলছিলেন। এ ব্যাপারে ইইউভুক্ত দেশগুলোকে সবচেয়ে সংবেদনশীল বলে মনে হয়। তারা ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা দিতে বেশ কিছু আইনকানুন ও নীতিমালাও করেছে। এই আইনকানুন ও নীতিমালা কীভাবে ব্যক্তিকে সুরক্ষা দেয়?
কাওসার আহ্মেদ: ইইউভুক্ত দেশগুলোতে গোপনীয়তা রক্ষার অধিকারের পাশাপাশি ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার অধিকারও মৌলিক অধিকারের মর্যাদা লাভ করেছে। সেখানে রাষ্ট্রীয় আইন ছাড়াও চার্টার অব ফান্ডামেন্টাল রাইটস অব দ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনুচ্ছেদ–৮, দ্য জেনারেল ডেটা প্রটেকশন রেগুলেশন (জিডিপিআর) ২০১৬ এবং দ্য ডেটা প্রটেকশন ল এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টিভ (ইইউ) ২০১৬/৬৮০—এই তিনটি দলিলের মাধ্যমে মূলত ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। এই দলিলগুলোর মূল উদ্দেশ্য হলো, ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার মাধ্যমে ইউরোপকে ডিজিটাল যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য যথোপযুক্ত করে গড়ে তোলা।
এগুলো কীভাবে ব্যক্তিগত তথ্যকে সুরক্ষা দেয়, তার উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ধরুন, আপনি যে সুপারশপ থেকে কোনো দিন কিছু কেনেননি, সে–ও আপনার মুঠোফোন নম্বর বা ই–মেইল ঠিকানা জানে। আবার, আপনাকে জমি বা ফ্ল্যাট কিনতে পীড়াপীড়ি করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, যাদের সঙ্গে কস্মিনকালেও কথা হয়নি আপনার।
পাঁচতারকা হোটেল থেকে বিভিন্ন অফার জানিয়ে খুদে বার্তা পাঠায়। কেউ কেউ আবার সরাসরি ফোন করেই ব্যক্তিগত তথ্য নেন। কিন্তু এসব তথ্য আমার-আপনার ব্যক্তিগত তথ্য, এটা কারও জানার কথা নয়। শুধু যে সেবাদানকারী এই প্রতিষ্ঠানগুলো আপনার ব্যক্তিগত তথ্য জানে, তা কিন্তু নয়। বেশির ভাগ টেকজায়ান্টরাও কিন্তু আপনার ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে নাড়াচাড়া করে। আর ফোনালাপ ফাঁসের ব্যাপার তো আছেই। ইউরোপে এসব থেকে সুরক্ষা পাওয়া যায় ওই আইনগুলোর মাধ্যমে।
প্রথম আলো: মানবাধিকার কর্মীরা বলে আসছেন, সাংঘর্ষিক আইন মানুষের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার খর্ব করছে, ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা থাকছে না।
কাওসার আহ্মেদ: টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন–২০০১–এর ৯৭–এর ক ও খ ধারার অবিবেচনাপ্রসূত ব্যবহার গোপনীয়তা রক্ষার মৌলিক অধিকারকে খর্ব করতে পারে।
এই আইনে যুদ্ধ, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিদেশি শক্তির যুদ্ধাবস্থা, অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ বা নৈরাজ্য এবং অন্যান্য জরুরি রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনের সময় সরকারকে বেতার যন্ত্রপাতি বা টেলিযোগাযোগব্যবস্থা ব্যবহারকারীর ওপর অধিকার দেওয়া হয়েছে। এ ধারাগুলোর অপপ্রয়োগের সুযোগ আছে। এটি যেন না হয়, সেজন্য সুরক্ষামূলক বিধান যুক্ত করতে হবে। অন্যান্য জরুরি রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনের সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা প্রয়োজন।
তবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন–২০১৮; পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন–২০১২ এবং বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন–২০০১–এর বেশ কয়েকটি বিধান সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হলে ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা এবং গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার পুরোপুরি না হলেও বহুলাংশে নিশ্চিত করা যায়। তারপরও আমি মনে করি, বাংলাদেশে প্রচলিত আইনগুলো ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা এবং গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার নিশ্চিত করার জন্য মোটেও যথেষ্ট নয়। এ জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন।
প্রথম আলো: জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক দলিলগুলোতে ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার অধিকার কতটা গুরুত্ব পায়? এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমাদের অবস্থান কী?
কাওসার আহ্মেদ: ব্যাপক নজরদারির এই যুগে গোপনীয়তার অধিকার নিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কিন্তু সেই ২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর প্রস্তাব পাস করেছে। এর শিরোনাম, ডিজিটাল যুগে গোপনীয়তার অধিকার। ডিজিটাল মাধ্যমে গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়টি সম্মান দিয়ে গোপনীয়তা রক্ষার নিশ্চয়তা দেওয়ার ব্যাপারে সব দেশ একমত হয়েছে। বাংলাদেশও জাতিসংঘের ওই রেজল্যুশনে স্বাক্ষর করেছে।
এখানেই শেষ নয়। যেমন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের ১২ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, একজন ব্যক্তি কখনোই অন্য এক ব্যক্তির গোপনীয়তা, পারিবারিক বিষয়, বাসস্থান বা যোগাযোগে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। এমনকি আত্মসম্মান নষ্ট হয়, এমন কোনো পদক্ষেপও নিতে পারবেন না। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদের ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদ, জাতিসংঘের কনভেনশন অন মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কাসে৴র ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদ এবং জাতিসংঘের শিশু সুরক্ষা সনদের ১৬ নম্বর অনুচ্ছেদে গোপনীয়তা রক্ষার অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষাবিষয়ক কোনো আন্তর্জাতিক কনভেনশন বা চুক্তি জাতিসংঘে এখনো গৃহীত হয়নি। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদের ওপর প্রাথমিক প্রতিবেদনে ‘বাংলাদেশ গোপনতা রক্ষার’ অধিকারের কথা লিখেছে। হিউম্যান রাইটস কমিটি তার পর্যবেক্ষণে এ সম্পর্কে কোনো সুপারিশ করেনি। আমার মতে, ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা এবং গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়ে বাংলাদেশের আইনি কাঠামোর দুর্বলতা অনস্বীকার্য।
প্রথম আলো: দেশের ভেতর ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার অধিকার কারও খর্ব হলে প্রতিকারের উপায় কী?
কাওসার আহ্মেদ: বাংলাদেশ সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ব্যক্তির গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে বিবেচিত। সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদ লঙ্ঘিত হলে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের কাছে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি সাংবিধানিক প্রতিকার চাইতে পারেন।
কারও ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার অধিকার খর্ব হলে ফৌজদারি শাস্তির বিধান আছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনসহ বিভিন্ন আইনে। যেমন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে হ্যাকিং এবং বেআইনি প্রবেশের জন্য শাস্তির বিধান করা হয়েছে। আবার বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনে টেলিফোন আলাপে ইচ্ছাকৃতভাবে আড়িপাতার জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে।
তবে এসব আইনের কয়েকটি সীমাবদ্ধতা আছে। এখানে ফৌজদারি দণ্ডের বিধান দিয়ে ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। ভুক্তভোগীর জন্য ক্ষতিপূরণের বিধান নেই। আবার প্রতিরোধেরও কোনো ব্যবস্থা নেই। আপনি বিপদে পড়লেই কেবল আদালতে যেতে পারবেন, বিপদে যেন না পড়েন, তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার কথা আইনে বলা নেই।
আমি মনে করি, এই সীমাবদ্ধতাগুলোর কথা মাথায় রেখে ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে একটি পূর্ণাঙ্গ আইন করা দরকার।