গৌরবের ১৮০ বছর

বাতিঘর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের এই লাল দালান l ফাইল ছবি
বাতিঘর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের এই লাল দালান l ফাইল ছবি

এটি এক দীর্ঘ পরম্পরা। প্রায় দুই শতাব্দী ধরে চলতে থাকা এক আলোকময় রথের যাত্রা। এর সঙ্গে যুক্ত আছেন ১৯ শতকের বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল কবি নবীন চন্দ্র সেন, দেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস, বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম, আবদুল্লাহ আলমুতী শরফুদ্দীন, অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, কথাসাহিত্যিক হুওমায়ূন আহমেদ, লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, নাট্যকার আবুল হায়াত।
এই নামের তালিকা যেমন সুদীর্ঘ, তেমনি উজ্জ্বল। নিজের কালকে ছাড়িয়ে মহাকালে ছড়িয়ে পড়া, দেশ ছাড়িয়ে ভুবন জয় করা এসব নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে চট্টগ্রামের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ১৮৩৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০১৬ পর্যন্ত এ রকম অগুনতি নাম যুক্ত হতে হতে চট্টগ্রামের শহীদ রফিকউদ্দিন সড়কে (সাবেক আইস ফ্যাক্টরি রোড) বাতিঘর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের লাল দালানটি।
রাজনীতি, বিজ্ঞান, সাহিত্য, অর্থনীতি, খেলাধুলা, প্রশাসন, চিকিৎসাবিদ্যাসহ নানা ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে এ রকম অসংখ্য মানুষ এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়ে এসেছেন। আর এসব কীর্তিমান মানুষের স্কুলের স্মৃতি নিয়ে যদি একটি মালা গাঁথা হয়, তবে তা থেকেই উঠে আসতে পারে একটি জাতির পুরো ইতিহাস। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত বহু মনীষীর শৈশবের স্মৃতি এই বিদ্যালয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে।
ভারতীয় কংগ্রেসের সাবেক সভাপতি জ্যোতিন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত, পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক গভর্নর জাকির হোসেন, গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, সাংসদ মইন উদ্দীন খান বাদল, সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী জামাল উদ্দীন আহমেদ, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খান, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলেরই ছাত্র।
ক্রীড়াঙ্গনেও কলেজিয়েটসদের বিচরণ রয়েছে। আন্তর্জাতিক গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোরশেদ, জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক আশীষ ভদ্র, জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মিনহাজুল আবেদীন নান্নু এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্র।

চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের মূল ফটক l ছবি: প্রথম আলো
চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের মূল ফটক l ছবি: প্রথম আলো

চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের ১৮০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আজ শুক্রবার থেকে তিন দিনব্যাপী উৎসব শুরু হচ্ছে। চট্টগ্রাম কলেজিয়েটসের (চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল প্রাক্তন ছাত্র সমিতি) সভাপতি দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বলেন, শুক্রবার শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে উৎসব শুরু হবে। তবে উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হবে শনিবার। কলেজিয়েট স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষার্থী নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর উদ্বোধন করবেন। রোববার সমাপনী অনুষ্ঠানে থাকবেন আরেক প্রাক্তন শিক্ষার্থী গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন।
অনেকেই জেনে অবাক হবেন চট্টগ্রামে ব্রিটিশ সরকারের প্রতিষ্ঠিত প্রথম ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল ছিল এটি। তখন অর্থাৎ প্রতিষ্ঠার সময় এই বিদ্যালয়ের নাম ছিল ‘চট্টগ্রাম গভর্নমেন্ট স্কুল’। তবে বিদ্যালয়টি এখনকার জায়গায় ছিল না। এর অবস্থান ছিল চকবাজার প্যারেড ময়দানের দক্ষিণে ও বর্তমান মহসিন কলেজের পূর্ব দিকে। ১৮৬৯ সালে সেখানে সরকারি এফ এ কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলে বিদ্যালয়টি মার্কট সাহেবের পাহাড়ের দক্ষিণ প্রান্তে বর্তমান সরকারি মুসলিম হাইস্কুলের দক্ষিণ পাশে একটি পাকা ভবনে স্থানান্তর করা হয়। পরে ১৮৮৬ সালে বিদ্যালয়টি আইস ফ্যাক্টরি রোডের বর্তমান স্থানে স্থানান্তরিত হয়। স্থান বদলের সঙ্গে সঙ্গে নাম বদলে গিয়ে হয়েছে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল।
এ তো গেল ইতিহাসের কথা। স্থানান্তরিত হওয়ার পর ১৩০ বছর ধরে আইস ফ্যাক্টরি রোডের বিদ্যালয়টির চেহারায় তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। যাঁরা ব্রিটিশ আমলে বিদ্যালয়ের মাঠে দাঁড়িয়ে ব্রিটিশ পতাকা ইউনিয়ন জ্যাককে সালাম ঠুকেছেন আর যাঁরা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে গৌরবের সঙ্গে প্রিয় জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি...’ গেয়েছেন, তাঁদের সবার স্মৃতিতে বিদ্যালয়ের চেহারাটা মোটামুটি অভিন্ন। পরিবর্তন বলতে এখন নতুন দেয়াল উঠেছে। বিদ্যালয়ের একতলা ভবন দোতলা হয়েছে। কিন্তু সেই সুবিশাল খেলার মাঠ, ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্টসের কারখানা এখনো কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।
একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে বড় সম্পদ শিক্ষকেরা। কলেজিয়েটের শিক্ষকেরা যুগ যুগ ধরে শিক্ষার্থীদের সামনে অনুসরণীয় হয়ে থেকেছেন। ডি এল সাহা, জহুরুল হক, আবদুল হাই, মোখলেসুর রহমান, বিমল বড়ুয়ার মতো শিক্ষকদের নিয়ে প্রত্যেক প্রজন্মেরই কোনো না কোনো গল্প আছে।
তবে এই বিদ্যালয়ের আরও যে একটি দিক হলো শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতা ভোগ করার অলিখিত ঐতিহ্য। পড়ার বইয়ের বাইরের বই পড়া, খেলাধুলা, লুকিয়ে সিনেমা দেখাসহ নানা কাণ্ডকীর্তির মধ্য দিয়ে বাইরের জগৎটাকে চেনার সুযোগ হতো। এতে লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ কিছু মাত্র কমত না কারও। বছর শেষে ফলাফলই ছিল তার প্রমাণ।
কলেজিয়েট স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র কবি-প্রাবন্ধিক আবুল মোমেন বলেন, ‘ব্রিটিশ আমলে জেলা শহরগুলোতে আধুনিক শিক্ষার প্রসারের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা শুরু করে। কলেজিয়েট স্কুল সেই প্রক্রিয়ারই অংশ। আমরা যে সময় এই স্কুলে পড়েছি তখন শিক্ষকদের মান, অঙ্গীকার ও আন্তরিকতা ছিল খুব উঁচু পর্যায়ের। এ জন্য অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভিড়ে এটি আলাদা মর্যাদা লাভ করেছে এবং এখানকার শিক্ষার্থীরা কীর্তিমান হতে পেরেছেন।’
১৮০ বছরের মহাযাত্রায় ইতিহাসের নানা বাঁকে, মানচিত্র ও রাজনীতির বহু পালাবদলেও কখনো ম্রিয়মাণ হয়নি চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল। নিজের ঔজ্জ্বল্যে সব সময় শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ রেখে চলেছে। মুস্তাফা নূর-উল ইসলাম এক স্মৃতিচারণা অনুষ্ঠানে বলেন, ‘ক্লাস শুরুর আগে ময়দানে আমরা লাইন করে দাঁড়াতাম। সমবেত কণ্ঠে “গড সেভ দ্য কিং” গাইতাম এবং সামনের উঁচু স্ট্যান্ডে উড়তে থাকা ইউনিয়ন জ্যাককে মাথা ঝুঁকিয়ে স্যালুট করতাম।’
এ কে এম সামসুদ্দিন চৌধুরীর লেখায় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের দিনগুলোর কথা উঠে এসেছে। একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’-এর কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী তাঁর লেখা কবিতাটি প্রথম পড়েছিলেন ২২ ফেব্রুয়ারি কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্রদের কমনরুমে। কারও কারও স্কুলজীবনের স্মৃতির সঙ্গে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে।