গ্রামীণ ব্যাংকে সরকারের শেয়ার এখন বাড়ছে না
গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে সরকারের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্যগুলো তাঁর (ইউনূসের) ‘মস্তিষ্কপ্রসূত’ বলে মন্তব্য করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি বলেন, ‘ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে প্রায়ই দুটি কথা বলেন। সরকার গ্রামীণ ব্যাংককে জোর করে নিয়ে যাচ্ছে। সরকার এটা করছে, ওটা করছে। এই কথাগুলো তাঁর (ইউনূসের) মস্তিষ্কপ্রসূত। এটা আটারলি ননসেন্স।’
গতকাল বুধবার সকালে শেরেবাংলা নগরের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) অনুষ্ঠিত ‘গ্লোবাল পার্টনারশিপ ফর ইফেকটিভ ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক কর্মশালার প্রস্তুতিমূলক সভা শেষে অর্থমন্ত্রী এসব কথা বলেন। তিনি জানান, গ্রামীণ ব্যাংকে সরকারের ২৫ শতাংশ শেয়ারই থাকবে।
অর্থমন্ত্রী আরও জানান, গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানা কিংবা ব্যবস্থাপনাশৈলীতে কোনো পরিবর্তন করার ইচ্ছা সরকারের নেই। তবে পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক নির্বাচনের বিধিমালায় শিগগিরই পরিবর্তন আনা হচ্ছে। কেননা, এ বিষয়ে নির্দেশনা আছে, বর্তমান নির্বাচনপদ্ধতি অবৈধ।
গ্রামীণ ব্যাংকের শেয়ার সম্পর্কে জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী জানান, যখন গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা হয়, তখন ৬০ শতাংশ ছিল সরকারের হাতে, আর শেয়ারধারীদের কাছে ছিল ৪০ শতাংশ। তখন বলা হয়েছিল, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শেয়ারধারীদের (ঋণগ্রহীতা সদস্য) শেয়ারের পরিমাণ বাড়ানো হবে। বর্তমানে ৫৩ লাখ শেয়ার রয়েছে, এই সংখ্যা ৮৩ লাখে উন্নীত করা হবে। তিনি জানান, আইনানুযায়ী, গ্রামীণ ব্যাংকে সরকারের শেয়ারের হার ২৫ শতাংশ থাকার কথা থাকলেও এত দিন সরকার বিনিয়োগ করেনি। এতে কিছু অসুবিধা হয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংকে সরকারের শেয়ার ২৫ শতাংশই থাকবে।
প্রসঙ্গত গ্রামীণ ব্যাংকে সরকারের শেয়ারের পরিমাণ ৫১ শতাংশে উন্নীত করার সুপারিশ করেছে গ্রামীণ ব্যাংক অনুসন্ধান কমিশন।
গ্রামীণ ব্যাংক আইন, ২০১৩-এর খসড়ার ওপর ১৪ আগস্ট অনুষ্ঠেয় আন্তমন্ত্রণালয়ের বৈঠকের কার্যপত্রেও গ্রামীণ ব্যাংকে সরকারের ২৫ শতাংশ শেয়ার থাকবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব আসলাম আলম বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন।
গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ, ১৯৮৩-এর পরিবর্তে গ্রামীণ ব্যাংক আইন, ২০১৩ প্রণয়ন করতে যাচ্ছে সরকার। এ ক্ষেত্রে বর্তমানে চালু অধ্যাদেশের ধারাগুলোকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আদালতের নির্দেশে সামরিক শাসনামলে জারি হওয়া সব অধ্যাদেশই বাতিলের কাজ চলছে। তার অংশ হিসেবে এটিও করা হচ্ছে বলে প্রথম আলোকে বলেন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব আসলাম আলম।
কার্যপত্রে বলা হয়েছে, গ্রামীণ ব্যাংকের অনুমোদিত মূলধন হবে ৩৫০ কোটি টাকা, যা প্রতিটি ১০০ টাকার তিন কোটি ৫০ লাখ শেয়ারে ভাগ করা থাকবে। এ ছাড়া ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন করা হবে ৩০০ কোটি টাকা। এতে সরকারের অংশ থাকবে ২৫ শতাংশ। আইনে আরও বলা হয়েছে, সরকার কর্তৃক স্থাপিত, পরিচালিত বা নিয়ন্ত্রিত এমন কোনো সংস্থা বা সংগঠন কর্তৃক সরকার যে পরিমাণ স্থির করবে, সেটি হবে অনুমোদিত মূলধন।
নির্বাচনপদ্ধতির বিধিমালার খসড়ায় যা আছে: পরিচালক নির্বাচনপদ্ধতির খসড়া বিধিমালায় বলা হয়েছে, শেয়ারধারী নয়জন নারী পরিচালক একযোগে নির্বাচিত হবেন না। আবার একটানা তিন বছরও থাকতে পারবেন না। প্রতিবছর পরিচালনা পর্ষদের এক-তৃতীয়াংশ বা তিনজন করে পরিচালক নির্বাচিত হবেন। আর প্রতিবছর তিনজন করে পরিচালক পর্ষদ ছেড়ে যাবেন, যাঁরা পরের দুই বছর নির্বাচন করতে পারবেন না। প্রত্যেক পরিচালকের মেয়াদ হবে তিন বছর।
কখনোই গ্রামীণফোনের শেয়ার ছিল না: এদিকে গণমাধ্যমে প্রকাশিত গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান খন্দকার মোজাম্মেল হকের বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়েছে গ্রামীণফোন। গতকাল পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তালিকাভুক্ত কোম্পানি গ্রামীণফোন কোম্পানির নীতি ও স্টক এক্সচেঞ্জের বিধিমালা অনুযায়ী লভ্যাংশ দেয়, গ্রামীণফোনের শেয়ারধারীদেরই লভ্যাংশ দেওয়া হয়। গ্রামীণফোনের ৫৫ দশমিক ৮ শতাংশ শেয়ারধারী টেলিনর। ৩৪ দশমিক ২ শতাংশ শেয়ার গ্রামীণ টেলিকমের। আর ১০ শতাংশ শেয়ার শেয়ারবাজারে লেনদেন হয়। গ্রামীণ ব্যাংকের কাছে কখনোই গ্রামীণফোনের শেয়ার ছিল না, এখনো নেই।
প্রসঙ্গত, ৫ আগস্ট গ্রামীণ ব্যাংক চেয়ারম্যান সাংবাদিকদের বলেছেন, গ্রামীণফোনের ১০ হাজার কোটি টাকার লভ্যাংশ গ্রামীণ ব্যাংক পায়নি। নিউইয়র্ক টাইমস-এর সম্পাদকীয়: গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে ৬ আগস্ট সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস। এতে বলা হয়েছে, দুই বছর ধরে গ্রামীণ ব্যাংক ও এর প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে ধ্বংসাত্মক প্রচারণা চালাচ্ছে শেখ হাসিনার সরকার। ২০০৭ সালে রাজনীতিতে নামার ঘোষণা এবং জনমত যাচাইয়ের উদ্যোগ নিয়েছিলেন মুহাম্মদ ইউনূস। যদিও তিনি তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পরে আর মনোযোগী হননি। তবুও শেখ হাসিনা সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ দেখে মনে হয়, ওই সময় মুহাম্মদ ইউনূসের রাজনীতিতে নামার ইচ্ছারই বর্তমানে পাল্টা জবাব দেওয়া হচ্ছে তাঁকে।
এতে বলা হয়, ২০১১ সালে ৬০ বছর বয়স হয়ে গেছে বলে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে জোরপূর্বক সরিয়ে দেওয়া হয় মুহাম্মদ ইউনূসকে। যদিও এর আগে নির্দিষ্ট সময় পার হওয়ার পরই কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাঁকে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি থাকতে অনুমোদন দেয়। তারপর গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে সরকার তদন্ত করে এবং সম্প্রতি একে ১৯ টুকরা করতে চাচ্ছে।
সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, গ্রামীণ ব্যাংক কমিশনের প্রতিবেদন সরকার আগামী সপ্তাহে পাবে। এতে গ্রামীণ ব্যাংক ভাঙা বা একে জাতীয়করণ করার সুপারিশ রয়েছে। স্থানীয় পত্রিকার বরাত দিয়ে এতে আরও বলা হয়েছে, প্রতিবেদনে যে সুপারিশই হোক না কেন, রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন আগামী নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা সেগুলো বাস্তবায়ন করতে যাবেন না। কারণ, এ বছরের শেষ নাগাদই অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা সংসদ নির্বাচন। আর গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য ও ঋণগ্রহীতা সবাই একেকজন ভোটার।