ঘণ্টায় তিন লাখ হাজি শয়তানকে পাথর মারবেন

প বি ত্র হ জ
প বি ত্র হ জ

মিনা এখন যেন তাঁবুর শহর। যেদিকে চোখ যায়, তাঁবু আর তাঁবু। পবিত্র হজের অংশ হিসেবে হজযাত্রীরা মিনায় এসে পৌঁছেছেন। চৌচালা ঘরের মতো এসব তাঁবুতে থাকবেন তাঁরা।
হাজিরা মিনায় বড় শয়তানকে পাথর মারবেন, কোরবানি দেবেন, মাথা মুণ্ডন বা চুল ছেঁটে মক্কায় গিয়ে কাবা শরিফ তাওয়াফ করবেন। তাওয়াফ, সাঈ শেষে আবার মিনায় ফিরে ১১ ও ১২ জিলহজ অবস্থান করবেন। সেখানে প্রতিদিন তিনটি শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করবেন তাঁরা। প্রত্যেক শয়তানকে সাতটি করে পাথর মারতে হয়।
মসজিদে খায়েফের দিক থেকে মক্কার দিকে আসার সময় প্রথমে জামারায় সগির বা ছোট শয়তান, তারপর জামারায় ওস্তা বা মেজ শয়তান এরপর জামারায় আকাবা বা বড় শয়তান।
জনশ্রুতি আছে, হজরত ইব্রাহিম (আ.) নিজ সন্তান ইসমাঈলকে (আ.) কোরবানি করার জন্য মিনায় নিয়ে যাচ্ছিলেন। জামারায় পৌঁছালে শয়তান তাঁকে ধোঁকা দেয়। তখন শয়তানকে লক্ষ্য করে তিনি পাথর নিক্ষেপ করেন।
তিন শয়তানকে তাকবিরসহ পাথর নিক্ষেপ করা হজের অপরিহার্য অংশ। শয়তানের প্রতি ঘৃণা প্রকাশের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে এই পাথর নিক্ষেপ করা হয়।

হাজিরা যাতে নির্বিঘ্নে শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করতে পারেন, সে জন্য কয়েক বছর ধরে ওই জায়গা সম্প্রসারণের কাজ চলছে। সৌদি গ্রাম ও পৌরবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব হাবিব জয়নাল আবেদিন জানান, জামারাকে পর্যায়ক্রমে ১২ তলা করা হবে। প্রতি তলার দৈর্ঘ্য হবে ৯৫০ মিটার আর প্রস্থ ৮০ মিটার। এবার এখানে প্রতি ঘণ্টায় তিন লাখ হাজি পাথর নিক্ষেপ করতে পারবেন বলে জানান মন্ত্রী।

জামারা কেন্দ্রীয়ভাবে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত, এখানে তাপমাত্রা থাকে ২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের জন্য জামারার ভেতরে একাধিক ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা বসানো আছে। রয়েছে পর্যাপ্ত টয়লেট, খাবারের দোকান ও সেলুন। জরুরি প্রয়োজনে হেলিকপ্টার অবতরণের জন্য রয়েছে হেলিপ্যাডও।

পাথর নিক্ষেপের সুবিধার্থে মিনার পূর্ব দিক থেকে আসা হাজিরা আসবেন নিচতলা ও দোতলায়, মক্কা থেকে আসা হাজিরা তৃতীয় তলায়, উত্তর দিক ও মোয়াইসিম থেকে আসা হাজিরা চতুর্থ তলায় এবং আজিজিয়া থেকে আসা হাজিরা পঞ্চম তলায় ওঠে পাথর নিক্ষেপ করবেন। দুর্ঘটনা এড়াতে ১২টি করে ঢোকার ও বের হওয়ার পথ আছে এখানে।

সৌদি কর্তৃপক্ষের দাবি, মিনায় পুরো কমপ্লেক্স চালু হলে একসঙ্গে ৫০ লাখ হাজি পাথর নিক্ষেপ করতে পারবেন। এখন হাজিদের পাথর মারার নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। মোয়াল্লেম নম্বর অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে পাথর মারতে হবে।

সৌদি মোয়াচ্ছাসা ১০ জিলহজ সকাল ছয়টা থেকে ১০টা পর্যন্ত এবং ১১ থেকে ১৩ জিলহজ সকাল ১০টা থেকে বিকেল সাড়ে তিনটা পর্যন্ত পাথর মারতে না যেতে হাজিদের অনুরোধ করেছেন।

তাঁবুর শহর: মিনার তাঁবুগুলোতে আগুন ধরার ঝুঁকি নেই। কারণ মিনা এলাকায় আগুন জ্বালানো নিষেধ। তাহলে এত লোকের খাবার কোথা থেকে আসে? জবাব সোজা, মিনার বাইরে থেকে রান্না করে আনা হয়।

শীতাতপনিয়ন্ত্রিত এসব তাঁবুতে বাতি আছে। আছে পর্যাপ্ত বাথরুম। কিছুদূর পর পর আছে খাবারের দোকান। এই দোকানগুলো বছরে পাঁচ দিনের জন্য খোলা থাকে। মোয়াল্লেমের কাছ থেকে দরপত্রের মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা দোকান নেন। অল্প সময়ের দোকান বলে জিনিসপত্রের দামও বাইরের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি।

রয়েছে দমকল বাহিনীর কার্যালয়, ক্লিনিক ও হাসপাতাল। হজের এই পাঁচ দিন ছাড়া মিনার পুরো এলাকা খালি পড়ে থাকে। চারপাশের প্রবেশদ্বারও তখন বন্ধ করে দেওয়া হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় বৈদ্যুতিক সংযোগ, পানির লাইন, টেলিফোন সংযোগ।

হজের দুই দিন আগে মিনা এলাকার ফটক খোলা হয়। হজের দুই দিন পর আবার সব বন্ধ করে দেওয়া হয়। এখন দিন-রাত হেলিকাপ্টারে টহল দেওয়া হয়, কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না আল্লাহর মেহমানদের।

তাঁবুগুলো দেখতে একই রকম হওয়ায় অনেক হাজির পক্ষে পথঘাট ঠিক রেখে নিজের তাঁবুতে যাতায়াত কঠিন হয়। এর জন্য এখানে আছে স্কাউট, হজগাইড। বাংলাদেশ হজ কার্যালয়ের পক্ষ থেকেও হজযাত্রীদের সহায়ক মিনার তাঁবু নম্বরসংবলিত মানচিত্র বিতরণ করা হয়েছে।

মিনায় অবস্থান করা হজের অংশ। হজযাত্রীরা মিনার বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখছেন। ১০ জিলহজের পর জামারায় খুব ভিড় থাকে। তখন ভালো করে দেখা যায় না।

মিনার কাছেই সৌদি বাদশাহ্র বাড়ি, রাজকীয় অতিথি ভবন। হজযাত্রীরা মোয়াচ্ছাসা (হজের সার্বিক বিষয় দেখাশোনার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ) কার্যালয়, নতুন চালু হওয়া রেলস্টেশনসহ বিভিন্ন স্থান ঘুরে ঘুরে দেখছেন। ঢাকার ফ্রিস্কুল স্ট্রিট থেকে মাকে নিয়ে হজ করতে এসেছেন রাফিউজ্জামান (৩৫)। দুজনে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান দেখছেন।

 মিনার একমাত্র মসজিদ মসজিদে খায়েফের সামনে গিয়ে বেশ ভালো লাগল। কারণ সেখানে বাংলায় লেখা মসজিদে খায়েফ। আরও কয়েকটি ভাষায়ও মসজিদের নাম লেখা আছে।

মসজিদে খায়েফ ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন হজযাত্রী মো.আশরাফুজ্জামান। বললেন, ‘স্ত্রীকে ছেড়ে ঈদ করব, একটু খারাপ লাগছে। তবে পবিত্র হজ পালন করতে এসেছি, এটা ভেবে ভালো লাগছে।’

প্রথমবার হজে আসা খায়রুল ইসলাম বললেন, ‘হজে আসতে পেরেছি। এর জন্য আল্লাহ্র দরবারে শুকরিয়া জানাই।’

সামান্য এই ঘোরাফেরার বাইরে হাজিরা সারা দিন নিজ নিজ তাঁবুতে নামাজ আদায়সহ ইবাদত-বন্দিগি করছেন।