ঘরে ঘরে রোগব্যাধি

গরমে অতিষ্ঠ এক রোহিঙ্গা নারী তাঁর সন্তানকে গাছের ছায়ায় আদর করছেন। ছবিটি গতকাল সকালে টেকনাফের তাজনিমারঘোনার অস্থায়ী আশ্রয় শিবির থেকে তোলা l সাবিনা ইয়াসমিন
গরমে অতিষ্ঠ এক রোহিঙ্গা নারী তাঁর সন্তানকে গাছের ছায়ায় আদর করছেন। ছবিটি গতকাল সকালে টেকনাফের তাজনিমারঘোনার অস্থায়ী আশ্রয় শিবির থেকে তোলা l সাবিনা ইয়াসমিন

সব রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রায় একই দৃশ্য। পলিথিনের ছাউনির ভেতরটা ফাঁকা। শিশুরা যে যার মত ঘুরে বেড়াচ্ছে আর পরিবারের জ্যেষ্ঠরা মন খারাপ করে ছাউনির দরজায় বসা। কিন্তু হাকিমপাড়া থাইংখালী ক্যাম্পের পাহাড়চূড়ার আমেনা খাতুনের পরিবারে ভিন্ন চিত্র। আমেনার দুই ছেলে ও এক মেয়ে দুই দিন ধরে অসুস্থ।

 থাইংখালী ক্যাম্পে প্রবেশের মুখে মেডিকেল ক্যাম্প। ওই ক্যাম্প থেকে প্রথম আলোর এ দুই প্রতিনিধিকে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের বেশির ভাগই ক্যাম্পে এসে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। কারও জ্বর, কারও ডায়রিয়া, কারও শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা। নিউমোনিয়ায় ভুগছে অনেকে। পাশাপাশি আছে আঘাতজনিত সমস্যা, চর্মরোগ ও তীব্র পুষ্টিহীনতা। শিশু ও স্তন্যদায়ী মায়েরা অসুস্থ হচ্ছেন বেশি। প্রায় প্রতি ঘরেই এক বা একাধিক রোগী।

কক্সবাজার জেলা সিভিল সার্জনের নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, ২৫ আগস্টের পর থেকে সোমবার পর্যন্ত ৬৮ হাজার ৭৬১ জন রোহিঙ্গাকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে ডায়রিয়ায় ৮ হাজার ৬৪৫ জন, আমাশয়ে ২ হাজার, নিউমোনিয়া ও শ্বাসতন্ত্রের সমস্যায় ১৫ হাজার ৩৯১, রুবেলায় আক্রান্ত হয়েছে ২৬, জন্ডিসে ১১৯, যক্ষ্মায় ১০, চর্মরোগে ৫ হাজার ৬৩০, তীব্র অপুষ্টির শিকার ২ হাজার, ম্যালেরিয়ায় ২ ও সাধারণ জ্বর হয়েছে ৩০ হাজার জনের। ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি আছে ৪০ জন। ক্যাম্পে ৩৫৬টি শিশুর জন্ম হয়েছে।

চিকিৎসকেরা বলেন, ক্যাম্পে মাত্রাতিরিক্ত গরম। সবাই মাটিতে পাটি বিছিয়ে ঘুমায়। এতে অসুস্থ হচ্ছে শিশুরা। ক্যাম্পগুলোতে শৌচাগার ও বিশুদ্ধ পানীয়জলের তীব্র সংকট। রোহিঙ্গাদের জন্য মিয়ানমারে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা নেই। তাই ছোঁয়াচে রোগ তাদের মধ্যে বেশি। ক্যাম্প পরিদর্শনে আসা রোগতত্ত্ব বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, সংক্রামক ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে। কক্সবাজারের সিভিল সার্জন আবদুস সালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্যাম্পের পরিবেশে অসুস্থ না হয়ে উপায় নেই।’

গত চার দিনে ছয়টি ক্যাম্পে গিয়ে চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিপুলসংখ্যক লোকের স্বাস্থ্যসেবা দিতে গিয়ে তারা হিমশিম খাচ্ছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও দেশি-বিদেশি ১১টি সংস্থা মিলে ৪৩টি মেডিকেল ক্যাম্প চালু করেছে। চাহিদার তুলনায় এই সংখ্যা অনেক কম।

বালুখালী-২ ক্যাম্পে কথা হয় ব্র্যাকের কর্মসূচি সমন্বয়ক আফরোজা বুলবুলের সঙ্গে। তিনি বলেন, তাঁদের কাছে যেসব রোগী আসছে, তাদের জ্বর ও ডায়রিয়া বেশি। বাহারছড়া গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রকল্প ব্যবস্থাপক সরওয়ার হোসেন বলেন, ক্যাম্পের প্রায় সবাই কোনো না কোনো রোগে আক্রান্ত।

নাইক্ষ্যংছড়ির বড় শনখোলা ক্যাম্পে দায়িত্বরত বিজিবির এক সদস্য বলেন, এই ক্যাম্পে অনেক মানুষ অসুস্থ। দুর্গম এই এলাকায় চিকিৎসাসেবা জোড়াতালি দিয়ে করা হচ্ছে। এখানে কোনো মেডিকেল ক্যাম্পই নেই।

কুতুপালং ক্যাম্পের বাসিন্দা আবদুর রহমান বলেন, সব ক্যাম্পেই গর্ভবতী নারী আছেন। কিন্তু তাঁদের জন্য আলাদা সেবার ব্যবস্থা নেই। হালিম আলী নামের এক ব্যক্তি বলেন, মিয়ানমার থেকে আসার সময় দুই দিন তাঁরা জঙ্গলে ছিলেন। সেই পরিবেশ এর চেয়েও ভালো ছিল। এখানে আসার পর গরমে তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

কয়েকটি ক্যাম্পে কথা বলে জানা গেছে, সীমান্ত অতিক্রম করার সময় সাধারণ মানুষের ওপর দফায় দফায় গুলি চালিয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। গুলিবিদ্ধ রোহিঙ্গাদের কক্সবাজার সদর হাসপাতাল ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, ভয়ে আক্রান্ত ১৩১টি শিশু শনাক্ত করেছেন তাঁরা। এসব শিশুর ভালো ঘুম হয় না। বেপরোয়া গুলির দৃশ্য তাদের মাথা থেকে সরছে না। ঘুমের জন্য চোখ বন্ধ হলেই শিশুরা ‘গুলি গুলি’ বলে চিৎকার করে উঠছে।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) ও তাদের সহযোগী সংস্থাগুলো বলছে, ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীর জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। কলেরার মতো পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছে আইওএম।

রোহিঙ্গাদের জরুরি সহায়তার কাজে সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপ (আইএসসিজি) জানিয়েছে, রোহিঙ্গাদের প্রাথমিক চাহিদা মেটাতেই এখন প্রতিদিন অন্তত ৫ কোটি ৯০ লাখ লিটার নিরাপদ সুপেয় পানি এবং ১৮ হাজার ল্যাট্রিন প্রয়োজন। সাহায্য সংস্থাগুলো এ পর্যন্ত ১ লাখ ৪১ হাজার শরণার্থীর জন্য সুপেয় পানি ও ৬ হাজার ল্যাট্রিনের ব্যবস্থা করতে পেরেছে।