ঘুমানোর সময়ও নেই চালকদের!

ট্রেনচালক (লোকো মাস্টার) মো. মিজানুর রহমান গত সোমবার দিবাগত রাত দুইটায় জ্বালানি তেলবাহী ২৪টি ওয়াগন নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আখাউড়ার উদ্দেশে রওনা হন। একটানা পৌনে ১৭ ঘণ্টা ট্রেন চালিয়ে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যা পৌনে সাতটায় তিনি আখাউড়া জংশনে পৌঁছান।
পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের আরেক ট্রেনচালক আহমেদ আবদুল্লাহ তমিজী গত বুধবার ভোর পৌনে পাঁচটায় আখাউড়া জংশনে কনটেইনারবাহী ট্রেনের ইঞ্জিনে ওঠেন। ওই দিন রাত ১২টা ২৫ মিনিটে তিনি ঢাকার কমলাপুরে পৌঁছান। তাঁকেও একটানা প্রায় ২০ ঘণ্টা ট্রেন চালাতে হয়েছে।
রেলওয়ের প্রকৌশলীরা বলছেন, একজন ট্রেনচালককে কোনো অবস্থাতেই একটানা সর্বোচ্চ ১২ ঘণ্টার বেশি ট্রেন চালাতে দেওয়া উচিত নয়। এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ে। কিন্তু গুডস ট্রেনের (পণ্যবাহী) চালকদের এখন ১৩ থেকে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত ট্রেন চালাতে হয়।
গত বছরের ১০ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম স্টেশনে মহানগর প্রভাতী এক্সপ্রেস ট্রেনের ইঞ্জিনসহ একটি বগি প্ল্যাটফর্মে উঠে যায়। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চালক তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।
জানতে চাইলে ট্রেনচালক আহমেদ আবদুল্লাহ তমিজী মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, যাত্রীবাহী ট্রেন দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। সে কারণে পণ্যবাহী ট্রেন থেমে থেমে ঢাকায় যায়। ভৈরব থেকে টঙ্গী পর্যন্ত ডবল লাইন (যাওয়া এবং আসার জন্য পৃথক লাইন) চালু হয়ে গেলে গন্তব্য পৌঁছানোর সময় অনেক কমে যাবে। তখন চালকদের কষ্টও কমে আসবে।
রেলের প্রকৌশলীরা জানান, পূর্বাঞ্চলে এখন ২১ জোড়া আন্তনগর ট্রেন, ৩৮ জোড়া মেইল ও এক্সপ্রেস ট্রেন, ৪০ জোড়া লোকাল ট্রেন এবং ১২ জোড়া পণ্য ও জ্বালানি তেলবাহী ট্রেন চলাচল করছে। অথচ সে অনুযায়ী লোকো মাস্টার বাড়েনি। এতে একদিকে যেমন ট্রেনের পরিচালন সময় বেড়েছে, অন্যদিকে চালকদেরও একটানা ১২ ঘণ্টার বেশি দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, বর্তমানে পূর্বাঞ্চল রেলওয়েতে লোকো মাস্টার পদে ১৭১টি, সাব-লোকো মাস্টার পদে ৫৩ ও সহকারী লোকো মাস্টার পদে ৮৮টি পদ শূন্য রয়েছে। তবে পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম বিভাগের চেয়ে ঢাকা বিভাগে ট্রেনচালক-সংকট প্রকট। সেখানে ২১০টি পদের মধ্যে ১০৩টিই শূন্য রয়েছে। আর চট্টগ্রাম বিভাগে ১৫৯টি পদের বিপরীতে ৬৮টি শূন্য রয়েছে। চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে কয়েকজন ট্রেনচালক ধার করে ঢাকা বিভাগে ট্রেন চালানো হচ্ছে।
ট্রেনচালক-সংকটের কারণে রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলে পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল ব্যাহত হচ্ছে বলে জানান পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী মো. শামসুজ্জামান।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ ডাবল লাইন না করে গত কয়েক বছরে রাজনৈতিক বিবেচনায় আন্তনগর ও মেইল ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানো এবং টানা ১৫ বছর সহকারী ট্রেনচালক নিয়োগ বন্ধ রাখার কারণে ট্রেনের পরিচালন সময় বেড়েছে। আর এই চাপ নিতে হচ্ছে ট্রেনচালকদের। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে এক যুগ আগেও আন্তনগর ট্রেনে সর্বোচ্চ সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা লাগত। এখন একই গন্তব্যে পৌঁছাতে সাত ঘণ্টা লাগছে। আর পণ্যবাহী ট্রেনের পরিচালন সময় ১৪-১৫ ঘণ্টা বেড়ে ২৫-৩০ ঘণ্টা হয়েছে।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, পণ্যবাহী ট্রেনগুলো চালানোর সময় ট্রেনচালকদের পালাবদল হয়। যেমন চট্টগ্রাম থেকে আখাউড়া পর্যন্ত একটি ধাপে সহকারী চালককে সঙ্গে নিয়ে একজন চালক পণ্য পরিবহন করেন। দ্বিতীয় ধাপে আখাউড়া থেকে ঢাকার কমলাপুর কিংবা জয়দেবপুর পর্যন্ত অন্য চালক দায়িত্ব নেন।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় যান্ত্রিক প্রকৌশলী মো. সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পণ্যবাহী ট্রেনের পরিচালন সময় বেশি। একজন চালক গড়ে ১৩ ঘণ্টা একটানা ট্রেন চালান। কিন্তু যাত্রীবাহী ট্রেন চালানোর সূচি এমনভাবে বিন্যস্ত করা হয়েছে, যাতে একজন চালক গন্তব্যে পৌঁছে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে পারেন। তবে রেলপথ ডবল ট্র্যাক হয়ে গেলে পণ্য ও যাত্রীবাহী ট্রেনের পরিচালন সময় অনেক কমে যাবে।
রেলের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, সহকারী ট্রেনচালক থেকে উপ-ট্রেনচালক পদে পদোন্নতি পেতে কমপক্ষে ছয় বছর সময় লাগে। উপ-ট্রেনচালক হিসেবে দুই বছর কাজ করার পর তাঁরা দ্বিতীয় গ্রেডের ট্রেনচালক হন। তখন তাঁদের পণ্য ও তেলবাহী ট্রেন চালাতে দেওয়া হয়। এরপর তাঁরা দক্ষতার পরিচয় দিলে যাত্রীবাহী ট্রেন চালানোর যোগ্যতা অর্জন করেন।