মধ্যপ্রাচ্যগামী ফ্লাইট: চক্রের কারসাজিতে টিকিট–সংকট

অসাধু চক্র গ্রুপ টিকিট বুকিংয়ের মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে পুরো অভিবাসন খাতে সংকট তৈরি করেছে।

ফাইল ছবি

মধ্যপ্রাচ্যগামী বিমানের টিকিটের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার পেছনে অসাধু চক্রের কারসাজি রয়েছে বলে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা পড়েছে। তাতে বলা হয়েছে, বিভিন্ন এয়ারলাইনসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ট্রাভেল এজেন্সির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এই চক্র ‘গ্রুপ টিকিট বুকিং’-এর মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে। ফলে অনেক প্রবাসী শ্রমিক কয়েক গুণ বেশি দামে টিকিট কিনতে বাধ্য হচ্ছেন।

করোনা পরিস্থিতির কারণে মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে অনেক দিন বিমান যোগাযোগ বন্ধ ছিল। সেটা আবার চালু হওয়ার পর ছুটিতে আসা প্রবাসী কর্মীরা কর্মস্থলে ফিরতে শুরু করেছেন। একই সঙ্গে নতুন কর্মীও যাওয়া শুরু হয়েছে। ফলে মধ্যপ্রাচ্যগামী ফ্লাইটে যাত্রীর চাপ ব্যাপক বেড়ে যায়। সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা থেকে মধ্যপ্রাচ্যগামী বিভিন্ন এয়ারলাইনসের প্রতিদিন মোট যাত্রী পরিবহনক্ষমতা রয়েছে প্রায় ৬ হাজার। প্রতিদিন প্রায় ৮ হাজার টিকিটের চাহিদা রয়েছে। ফলে প্রতিদিনই চাহিদা বাড়ছে। একই সঙ্গে বেড়ে গেছে টিকিটের দামও। এয়ারলাইনসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও একশ্রেণির ট্রাভেল এজেন্টের মধ্যে যোগসাজশে টিকিটি বিক্রির সার্ভারে নির্দিষ্ট কিছু সময়ে ধাপে ধাপে টিকিট উন্মুক্ত করা হয়। ফলে এসব টিকিট সাধারণ যাত্রীদের নাগালের বাইরে থেকে যায়। এরই মধ্যে অসাধু চক্রগুলো কালোবাজারে টিকিটের দাম তিন-চার গুণ বাড়িয়ে এই খাতে সংকট তৈরি করেছে। ফলে প্রবাসী কর্মীদের অভিবাসন ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে।

সিন্ডিকেট শনাক্ত করা গেলে তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ব্যাপারে সরকার কাজ করছে।
মাহবুব আলী, প্রতিমন্ত্রী, বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়

এ বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস বাংলাদেশের (আটাব) মহাসচিব মো. মাজহারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, অন্যায়, অনৈতিক কিছু হোক, সেটা আটাব চায় না। কোনো ট্রাভেল এজেন্সি যদি সিন্ডিকেট করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে, সেটার দায় সংশ্লিষ্ট এজেন্সির। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আছে।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, বিভিন্ন এয়ারলাইনস অসাধু ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর কাছে ভুয়া ডকুমেন্টসের বিপরীতে গ্রুপ টিকিট বুকিং দিয়ে রাখে। কোনো এয়ারলাইনস যখন কোনো গ্রুপ টিকিট বিক্রি করে, তখন তার সিস্টেমে ওই টিকিট বিক্রীত বলে দেখানো হয়। গ্রুপ টিকিট সাধারণত নিম্ন ধাপের বা সর্বনিম্ন দামের টিকিট বিক্রি করা হয়। ফলে সাধারণ যাত্রীরা সিস্টেমে যখন টিকিট কিনতে সার্ভারে প্রবেশ করেন, তখন অল্পসংখ্যক উচ্চ মূল্যের টিকিট প্রদর্শিত হয়। উচ্চ মূল্যের টিকিট বিক্রি শেষ হলে অসাধু ট্রাভেল এজেন্টরা তাদের গ্রুপ টিকিট উচ্চ দামের টিকিটে সমদামে বা আরও বেশি দামে বিক্রি করেন।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রবলেম তো আছে, এটা আপনি বুঝছেন, সবাই বুঝতেছে। ঘটনা যেটা বলেছেন, সেটাও ঠিক। তবে সিন্ডিকেট শনাক্ত করা গেলে তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ব্যাপারে সরকার কাজ করছে।’ তিনি বলেন, ভাড়া কমানোর বিষয়ে বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোর সঙ্গে তিনি একাধিকবার বসেছেন। বাংলাদেশ বিমানকে বলে দেওয়া হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে ভাড়া ৬৫ হাজারের বেশি নেওয়া যাবে না।

চারটি প্রস্তাব দেয় আটাব। তারা বলেছে, মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশ বিমানসহ অন্য এয়ারলাইনসের মধ্যপ্রাচ্যে ফ্লাইট বাড়ালে এবং যাত্রী পরিবহনক্ষমতা বাড়লে টিকিটের দাম স্বাভাবিক হয়ে আসবে।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, পাশের বিভিন্ন দেশের তুলনায় বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যগামী ফ্লাইটের টিকিটের মূল্য অস্বাভাবিক বেশি। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন গন্তব্যে মোট যাত্রীর প্রায় ২৫ শতাংশ পরিবহন করে থাকে। বাকি যাত্রীরা দেশি-বিদেশি অন্যান্য এয়ারলাইনসে যাতায়াত করেন। সাম্প্রতিককালে প্রবাসী কর্মীদের চাপ বাড়লেও বিমান কর্তৃপক্ষ মধ্যপ্রাচ্যে ফ্লাইটের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পারেনি।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গত ৭ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে চারটি প্রস্তাব দেয় আটাব। তারা বলেছে, মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশ বিমানসহ অন্য এয়ারলাইনসের মধ্যপ্রাচ্যে ফ্লাইট বাড়ালে এবং যাত্রী পরিবহনক্ষমতা বাড়লে টিকিটের দাম স্বাভাবিক হয়ে আসবে। এ ছাড়া এয়ারলাইনসগুলোর চাহিদা অনুযায়ী স্লট বৃদ্ধির (ফ্লাইটসংখ্যা বৃদ্ধির অনুমতি) প্রক্রিয়া দ্রুত করা, প্রবাসী কর্মীদের সুবিধার্থে বিশেষ ভাড়া নির্ধারণ এবং টিকিটের অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে একটি রেগুলেটরি বোর্ড গঠনের প্রস্তাব দেয় আটাব।