চট্টগ্রামের ডেইরি ফার্মগুলোর মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা

চট্টগ্রামের মোহরায় অবস্থিত একটি খামার
ছবি: প্রথম আলো

গোখাদ্য, ওষুধপথ্যের মূল্যবৃদ্ধি, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবসহ নানা কারণে একসময়ের বিকাশমান চট্টগ্রামের ডেইরি ফার্মগুলো এখন সংকটের মধ্যে আছে। এর আগে করোনার অতিমারিতে প্রায় দুই বছর গেছে স্থবিরতা। সবকিছু মিলিয়ে একটা অচলায়তনের সৃষ্টি হয়েছে। সেই অচলায়তন ভেঙে এখন চট্টগ্রামের ডেইরি ফার্মগুলো মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।

চট্টগ্রামে মূলত শহরের দুধের চাহিদাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বাণিজ্যিক ডেইরি ফার্মগুলো। এসব ফার্ম পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে ভুসিজাতীয় পণ্য। উন্নত দেশের ফার্মগুলো পশুখাদ্যের জন্য নির্ভর করে চারণভূমির ওপর। তৃণভূমির ঘাস, লতাপাতাও ও শিমজাতীয় সবজি হলো সেখানকার পশুর প্রধান খাদ্য। তবে বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে, বিশেষ করে শহরে, সে রকম তৃণভূমি বা ঘাসের প্রান্তর নেই। কাঁচা ঘাসের অভাব; তাই ভুসিজাতীয় খাদ্যের ওপরই নির্ভর করতে হয় বেশি। এসব খাদ্যের মূল্য এখন খুব চড়া। দুই বছর আগে এক বস্তা গমের ভুসির দাম ছিল এক হাজার টাকা। এখন সেই ভুসির দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। রাইস পলিসের ৫০ কেজির বস্তার দাম ছিল ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা। বর্তমানে সেটির দাম হয়েছে প্রায় দুই হাজার টাকা। দুই বছর আগে সয়াবিন খৈলের দাম ছিল প্রতি কেজি ৪৫ টাকা। এখন ৬৫ টাকা।

পশুখাদ্যের দাম বাড়ার পাশাপাশি টিকা ও ওষুধেরও দাম বেড়েছে। তার ওপর এগুলোর দুষ্প্রাপ্যতা ভোগান্তির অন্যতম কারণ। ভেটেরিনারি চিকিৎসকও পর্যাপ্ত নেই। চিকিৎসাব্যবস্থাও অপ্রতুল। চট্টগ্রামের ডেইরি ফার্মগুলো ঘুরে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে এমন অবস্থার কথা জানা গেল।

ডেইরি ফার্মের মালিকেরা জানান, দুধের বিক্রয়মূল্য উৎপাদন খরচের তুলনায় অনেক কম। এমন অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই তাঁরা গুটিয়ে যাবেন। সমস্যা শুধু এটাই নয়, দুধের বাজার-ব্যবস্থার মধ্যেও রয়েছে অনেক দুর্বলতা। দুধের দামের স্থানে স্থানে, জনে জনে অনেক হেরফের হয়। কোথাও কোথাও ৪০ টাকা লিটারও পাওয়া যায়। আবার কোথাও কোথাও ৮০ থেকে ৯০ টাকা প্রতি লিটার।

ডেইরি ফার্মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা বলেন, উন্নত ও বেশি উৎপাদনশীল গাভির ব্রিড তৈরি হয়নি বলে এখানে বেশি দুধ পাওয়া যায় না। ডেইরি ফার্মের উদ্যোক্তারা সহজ শর্তে ঋণ পান না। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো বাজারে খুব নিম্নমানের ক্ষতিকর গুঁড়া দুধ পাওয়া যায়। এসব গুঁড়া দুধ আমদানির জন্য খুব কম শুল্ক দিতে হয়। তাই দামও খুব সস্তা। এ কারণে তরল খাঁটি দুধের দাম গুঁড়া দুধের তুলনায় বেশি। গুঁড়া দুধের সঙ্গে খাঁটি দুধের এ অসম প্রতিযোগিতা দূর করতে হবে বলে তাঁরা অভিমত দেন। এ অবস্থায় নিজেদের ফার্মকে উন্নততর করতে উদ্যোক্তারা সহজ শর্তে ঋণও পান না।

ডেইরি ফার্মের এ সংকটের মূল কারণ, দেশীয় গাভিগুলোর উৎপাদন অনেক কম। নতুন উন্নত সংকর জাতের ব্রিড তৈরি করতে সময় লাগে। বিষয়টি সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কোথাও তেমন গুরুত্ব পায়নি। এ ছাড়া সরকারি নীতির আনুকূল্যও পাওয়া যায়নি। এ কারণে ডেইরি ফার্মগুলো শক্ত ভিত নিয়ে চট্টগ্রামের দাঁড়াতে পারছে না।

এ সংকট থেকে উত্তরণের জন্য চিটাগাং ডেইরি ফার্ম অ্যাসোসিয়েশনসহ বিভিন্ন ডেইরি ফার্ম দীর্ঘদিন ধরে নানা পদক্ষেপের জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানিয়ে আসছে। গুঁড়া দুধের আমদানি কমাতে এর শুল্ক বাড়ানো এবং ধীরে ধীরে আমদানি শূন্যে নামিয়ে আনার দাবি তাদের দীর্ঘদিনের। কনডেন্সড মিল্ক নিষিদ্ধ ঘোষণা, বেশি পুষ্টির ঘাস এবং বিবিধ অঞ্চলের উপযোগী করা, টিকা, কৃমিনাশক ওষুধ সুলভ করা এবং চিকিৎসার সুযোগ বৃদ্ধিরও দাবি জানিয়ে আসছে তারা। তারা জানায়, বেশি উৎপাদনের সংকর জাত উদ্ভাবন করতে হবে, প্রাণিখাদ্য বা গোখাদ্য আমদানির সহজ ব্যবস্থা করতে হবে।

দৈনিক পূর্বকোণের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ইউসুফ চৌধুরী ও শাহেদ কাদেরীর উদ্যোগে ১৯৯০ সালে এই অ্যাসোসিয়েশন গঠিত হয়। সে সময় এর সদস্যসংখ্যা ছিল প্রায় ৩৫০। তখন এ খাত ছিল খুবই সম্ভাবনাময় ও বিকাশমান। তখনো নানা দুর্বলতা ছিল; তবে সংশ্লিষ্ট পণ্যের এত দাম ছিল না। সেই ১৯৯০ সাল থেকে ডেইরি ফার্মের বিকাশে এসব সমস্যা সমাধানের জন্য দাবি এলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বর্তমানে এই অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যসংখ্যা নেমে হয়েছে ১২০। প্রায় প্রতিটি ফার্ম উল্লেখিত সমস্যায় জর্জরিত। এসব ফার্মের বাইরে সারা জেলায় আছে প্রচুর ফার্ম। বলতে গেলে চট্টগ্রামের পটিয়া ও আনোয়ারায় দুধের এক বিপ্লব ঘটে গেছে। ফার্মের বাইরেও গেরস্তের গরু থেকেও দুধ উৎপাদিত হচ্ছে।

সরকারের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, চট্টগ্রামে ১৮ হাজার ৩১২টি ডেইরি ফার্ম আছে। এর মধ্যে নিবন্ধন আছে মাত্র ১ হাজার ৬০০টির। এসব ফার্মে দৈনিক দুধ উৎপাদিত হয় গড়ে ১০ লাখ লিটার। তার বিপরীতে চাহিদা আছে ১২ লাখ লিটারের।

তবে চিটাগাং ডেইরি ফার্ম অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নাঈম উদ্দিন এ পরিসংখ্যান ঠিক নয় উল্লেখ করে বলেন, আসলে জোগানটা অত বেশি নয়, চাহিদার তুলনায় অনেক কম। বর্তমানে অ্যাসোসিয়েশনের কী ভূমিকা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাত থেকে আট বছর ধরে একটা ক্ষয়িষ্ণু সময় পার করছে ডেইরি শিল্প। হতাশা বিরাজ করছে তাদের মধ্যে। এ হতাশা থেকে বেরিয়ে আসতে আসন্ন বাজেটে গুঁড়া দুধের ওপর ৬০ শতাংশ করারোপ করার দাবি তাঁর। তিনি গরুর জাত উন্নয়নের জন্য নতুন ব্রিড তৈরিতে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া, খামারের বিদ্যুৎ কৃষিমূল্যে দেওয়া এবং দেশীয় গবাদিপশুর জন্য টিকা উৎপাদনের বরাদ্দ দেওয়ার দাবি জানান। প্রতিটি ইউনিয়নে ভেটেরিনারিয়ান ও প্রাণিসম্পদ প্রতিপালনে প্রশিক্ষিত কর্মকর্তা নিয়োগের ব্যবস্থার কথাও বলেন তিনি। নাঈম উদ্দিন আরও বলেন, ‘আমরা কঠিন সময়ের মধ্যেও নিজেদের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি।’
পশুর বাজারে জোগানদাতা খামারগুলো