চট্টগ্রামে প্লাবিত নতুন নতুন এলাকা

পানিনিষ্কাশনে নানা প্রতিবন্ধকতা। ৫ বছরের ব্যবধানে ১৮ শতাংশ বেশি এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে।

এখনো পানিতে ডুবে আছে চট্টগ্রাম নগরের পূর্ব বাকলিয়ার পুলিশ বিট এলাকার রাস্তাঘাট। গতকাল দুপুরে তোলা
ছবি: সুজন ঘোষ

চট্টগ্রাম নগরের পূর্ব বাকলিয়ার ওয়াজেরপাড়া। বসবাস কমপক্ষে ১০ হাজার মানুষের। কর্ণফুলী নদীর পাশের এই এলাকায় আগে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হতো না। এবারের বর্ষার ভারী বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে এলাকাটি। গত শুক্রবার থেকে গতকাল মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত রাস্তাঘাট, অলিগলি, দোকানপাট ও ঘরবাড়িতে পানি জমে আছে। পানি নামছে না।

শুধু ওয়াজেরপাড়ায় নয়, আরও অন্তত ছয়টি এলাকা—পূর্ব বাকলিয়ার পুলিশ বিট; দক্ষিণ মধ্যম হালিশহরের পুরাতন ডাকঘর, মাইজপাড়া ও ফকিরহাট; দক্ষিণ হালিশহরের মকবুল মিস্ত্রি সড়ক এবং বায়েজিদ বোস্তামী রুবি সিমেন্ট এলাকায় এবার জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এসব এলাকায় আগে কখনো পানি ওঠেনি।

এ ছাড়া চার বছর ধরে বর্ষা এলে প্লাবিত হচ্ছে আরও ১৫টি এলাকা—পূর্ব বাকলিয়ার বজ্রঘোনা, ফিরিঙ্গীবাজারের টেকপাড়া, এয়াকুব নগর, আর সি চার্চ রোড, আলকরণ ১, ২ ও ৩ নম্বর গলি, বংশাল রোড, ডা. মান্নান গলি, জামালখানের রহমতগঞ্জ ও বাংলা কলেজ এলাকা, দক্ষিণ মধ্যম হালিশহরের কলসিরদিঘি পাড় ও ওমর শাহ পাড়া, দক্ষিণ হালিশহরের আকমল আলী সড়ক ও উত্তর পতেঙ্গার ধুমপাড়ায়। এসব এলাকায়ও আগে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হতো না।

যথাযথভাবে পরিকল্পনার মাধ্যমে কাজ না করলে আরও নতুন এলাকা প্লাবিত হবে। তাই সিটি করপোরেশন, সিডিএ ও ওয়াসাকে যৌথভাবে কাজ করতে হবে।
মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান

বিশেষজ্ঞ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ভুক্তভোগী বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত তিনটি কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এগুলো হচ্ছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতায় নির্মাণকাজের জন্য বিভিন্ন খালে অস্থায়ী বাঁধ দেওয়া, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও সিডিএর টানাটানির কারণে খাল-নালা ঠিকভাবে পরিষ্কার না করা এবং নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে কর্ণফুলী নদীর তীরে নির্মাণাধীন সড়কসহ বাঁধে জলকপাটের অবকাঠামো নির্মাণের কারণে সংযোগ খালের মুখ সংকুচিত হয়ে যাওয়া।

ওয়াজের পাড়ার দোকানি মোহাম্মদ আইয়ুব, চাকরিজীবী মোহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ ও কেব্‌ল অপারেটর মোহাম্মদ সালাউদ্দিন জানান, আগে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি না হওয়ায় তাঁদের প্রস্তুতি ছিল না। ফলে এবার জিনিসপত্রের ক্ষতি ও ভোগান্তি বেশি ছিল।

ওই ব্যক্তিরা আরও বলেন, কর্ণফুলী নদীর তীরে একটি নতুন সড়কের নির্মাণকাজ চলছে। এ জন্য পানিনিষ্কাশনের খাল-নালা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মূলত এই কারণেই পানি নামছে না।

২০১৭ সালে করা চুয়েটের একটি গবেষণায় দেখা যায়, জলাবদ্ধতায় চট্টগ্রাম নগরের ৪২ শতাংশ এলাকা তলিয়ে যায়। সিটি করপোরেশন বলছে, এবারের বৃষ্টিতে নগরের ৬০ শতাংশ এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। সেই হিসাবে জলাবদ্ধ এলাকা বেড়েছে ১৮ শতাংশ।

শুধু সিডিএ কাজ করলে তো হবে না। কাজ শেষ হওয়া ১১টি খাল বুঝে নিচ্ছে না সিটি করপোরেশন। আবার তাদের আওতায় থাকা নালা-নর্দমাগুলোও ঠিকভাবে পরিষ্কার করছে না। বর্জ্য পরিষ্কার করতে পারছে না। তাই খাল ও নালা-নর্দমা ভরাট হয়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে।
কাজী হাসান বিন শামস, সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী

আগের চেয়ে জলাবদ্ধতা পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি সোমবার দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজের কারণে সিডিএ বিভিন্ন খালে বাঁধ দিয়েছে। এখনো প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে। এসব কারণে পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে।

চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য ২০১৭ সালে সিডিএর দুটি প্রকল্পের অনুমোদন দেয় সরকার। ২০২০ সালের জুনে প্রকল্প দুটির কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও অগ্রগতি এখনো ৫৭ থেকে ৭০ শতাংশ। একটি কর্ণফুলীর তীরে ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে বাঁধসহ সড়ক নির্মাণ ও অপরটি ৫ হাজার ৬১৫ কোটি টাকার মূল প্রকল্প। প্রকল্পের আওতায় নগরের ৫৭টি খালের মধ্যে কাজ চলছে ৩৬টিতে।

জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজের চার বছর যাওয়ার পরও কেন জলাবদ্ধতা জানতে চাইলে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস প্রথম আলোকে বলেন, শুধু সিডিএ কাজ করলে তো হবে না। কাজ শেষ হওয়া ১১টি খাল বুঝে নিচ্ছে না সিটি করপোরেশন। আবার তাদের আওতায় থাকা নালা-নর্দমাগুলোও ঠিকভাবে পরিষ্কার করছে না। বর্জ্য পরিষ্কার করতে পারছে না। তাই খাল ও নালা-নর্দমা ভরাট হয়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে।

সিটি করপোরেশনের দাবি, সাড়ে ৬ কোটি টাকায় ২২০ কিলোমিটার নালা তারা পরিষ্কার করেছে। তবে নগরে নালা রয়েছে ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার।

দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর নগর চট্টগ্রামের টানা পাঁচ দিন পানিতে তলিয়ে যাওয়ার বিষয়টি দুর্ভাগ্যজনক বলে মন্তব্য করেছেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যথাযথভাবে পরিকল্পনার মাধ্যমে কাজ না করলে আরও নতুন এলাকা প্লাবিত হবে। তাই সিটি করপোরেশন, সিডিএ ও ওয়াসাকে যৌথভাবে কাজ করতে হবে।