শনিবার বেলা ১১টা। টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর রোহিঙ্গা ক্যাম্প ইনচার্জের কার্যালয়ের সামনে (সড়কে) দাঁড়ানো পাঁচটি বাস। এরই মধ্যে হুড়োহুড়ি করে পাঁচ শতাধিক রোহিঙ্গা সড়কের ওপর এসে হাজির। সবার মধ্যে বাসে ওঠার প্রতিযোগিতা। কয়েকজন বাসে ওঠার আগে বিদায় জানাতে আসা স্বজনদের কোলাকুলি করে বিদায় নিচ্ছে। আগত নারী–পুরুষদের অনেকের চোখে জল। বাহারছড়ার এই ক্যাম্পে রয়েছে ১০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা।
স্থানীয় বাহারছড়া ইউপি চেয়ারম্যান আজিজ উদ্দিন বলেন, ভাসানচরে স্থানান্তরের জন্য এই ক্যাম্প থেকে গতকাল পাঁচ শতাধিক রোহিঙ্গাকে উখিয়ায় পাঠানো হয়েছে। এর আগে একই ক্যাম্প থেকে আরও অন্তত দুই হাজার রোহিঙ্গাকে স্থানান্তর করা হয়েছিল।
কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের আশ্রয়শিবির থেকে চতুর্থ দফায় নোয়াখালীর ভাসানচর যাচ্ছে আরও অন্তত ৩ হাজার ৬০০ জন রোহিঙ্গা। রোববার (১৪ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে উখিয়া ডিগ্রি কলেজ মাঠ থেকে প্রথমে প্রায় ২ হাজার এবং পরের দিন সোমবার আরও ১ হাজার ৬০০ জন রোহিঙ্গাকে বিভিন্ন পরিবহনে চট্টগ্রাম পাঠানো হবে। সেখান থেকে তাদের (রোহিঙ্গাদের) নৌবাহিনীর জাহাজে করে ভাসানচর আশ্রয়ণ প্রকল্পে নেওয়া হবে।
স্থানান্তর প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত সরকারি একটি সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যেতে ইচ্ছুক এমন প্রায় ২৩ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা পাওয়া গেছে। তাদের মধ্য থেকে চতুর্থ দফায় স্থানান্তরের জন্য প্রায় ৪ হাজার জনকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এখন তাদের ক্যাম্প থেকে ট্রাকে তুলে উখিয়া ডিগ্রি কলেজ মাঠে জড়ো করা হচ্ছে।
অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি কার্লয়) উপসচিব মোহাম্মদ সামছুদ-দ্দৌজা প্রথম আলোকে বলেন, ১৪ ও ১৫ জানুয়ারি চতুর্থ দফায় কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে সাড়ে তিন হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তরের জন্য চট্টগ্রাম পাঠানো হবে। ইতিমধ্যে টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে ভাসানচরে যেতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গাদের উখিয়া ডিগ্রি কলেজ মাঠে জড়ো করা হচ্ছে।
ভাসানচরের উন্নত পরিবেশ ও থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থার কথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখ থেকে শোনার পর দলে দলে রোহিঙ্গারা ভাসানচর যেতে নাম তালিকাভুক্ত করছে।
আরআরআরসি কার্যালয় সূত্র জানায়, এর আগে তিন দফায় কক্সবাজারের ক্যাম্প থেকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়েছে ৬ হাজার ৬৮৮ জন রোহিঙ্গাকে। এর মধ্যে গত ৪ ডিসেম্বর প্রথম দফায় স্থানান্তর করা হয় ১ হাজার ৬৪২ জন, ২৯ ডিসেম্বর দ্বিতীয় দফায় ১ হাজার ৮০৪ জন, চলতি বছরের ২৯ ও ৩০ জানুয়ারি তৃতীয় দফার স্থানান্তর করা হয়েছে ৩ হাজার ২৪২ জনকে। ভাসানচরের আশ্রয়শিবিরে মোট ১ লাখ রোহিঙ্গাকে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা আছে সরকারের।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতা শুরু হলে পরের কয়েক মাসে অন্তত ৮ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এর আগে আসে আরও কয়েক লাখ। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১১ লাখ।
ভাসানচর যাওয়ার আগে
বাসে ওঠার আগে রোহিঙ্গা মো. শফিক (৪৫) প্রথম আলোকে বলেন, ভাসানচরে আগে যারা (রোহিঙ্গা) গেছে তারা সবাই ভালো আছে, নিরাপদে আছে—এমন খবর জানার পর তাঁরাও ভাসানচরে যেতে রাজি হয়েছেন। মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার পরিবেশ না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা ভাসানচরে থাকবেন।
উখিয়ার মধুরছড়া ক্যাম্পের রোহিঙ্গা সিরাজুল ইসলাম (৪৮) বলেন, গত ১৯ জানুয়ারি উখিয়ার কুতুপালং শিবির পরিদর্শন করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। এ সময় মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পের ৭০ জন রোহিঙ্গা নেতা। ভাসানচরের উন্নত পরিবেশ ও থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থার কথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখ থেকে শোনার পর দলে দলে রোহিঙ্গারা ভাসানচর যেতে নাম তালিকাভুক্ত করছে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে রোহিঙ্গা স্থানান্তরের জন্য নিজস্ব তহবিল থেকে ৩ হাজার ৯৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ভাসানচর আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ১৩ হাজার একর আয়তনের ওই চরে ১ লাখ রোহিঙ্গা বসবাসের উপযোগী ১২০টি গুচ্ছগ্রামের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে।
কুতুপালং ক্যাম্পের রোহিঙ্গা জালাল আহমদ বলেন, কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরগুলো বেশির ভাগ পাহাড়ের ঢালুতে তৈরি। বর্ষার সময় পাহাড়ধসে ঘরবাড়ি বিলীন হয়, হতাহতের ঘটনা ঘটে। আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ী ও বখাটের উৎপাত বেড়েছে। খুনখারাবি, মুক্তিপণের জন্য অপহরণ, ধর্ষণ হচ্ছে। ইয়াবার টাকা ভাগাভাগি নিয়ে প্রায়ই মারামারির ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি দুটি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী দলের মধ্যে গোলাগুলিতে দুই রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। সাধারণ রোহিঙ্গারা অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। তাই ঝুঁকি এড়াতে রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যেতে আগ্রহ দেখাচ্ছে।