‘চাকরির বাজারে যোগ্যতা নয়, সবার আগে চোখে পড়ে আমার দুই হাত নেই’

মুখে কলম আটকে কনুইয়ের সাহায্যে লেখেন বাহার উদ্দিন, কম্পিউটারও চালান এভাবেই
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

‘আমার দুই হাত নেই। আমি প্রতিবন্ধী। কাজ করতে বাধা থাকবেই। তবে আমার যোগ্যতা আছে। কম্পিউটারে দ্রুত কাজ করতে পারি। প্রশিক্ষণদক্ষতা আছে। চাকরির বাজারে যোগ্যতা নয়, সবার আগে চোখে পড়ে আমার দুই হাত নেই। তাই চাকরির জন্য আবেদন করলে একেক প্রতিষ্ঠান ডাকে, তারপর ৮, ৯, খুব বেশি হলে ১১ হাজার টাকা দিতে চায়।’

গতকাল বুধবার মুঠোফোনে কথাগুলো বলছিলেন বাহার উদ্দিন রায়হান। তাঁর এক হাত নেই, আরেক হাত আছে কনুই পর্যন্ত। শ্রুতলেখকের সহায়তায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে স্নাতক পাস (সিজিপিএ ২ দশমিক ৭৫) করেছেন। গতকালই তিনি ফলাফল জানতে পেরেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ফলাফল জানিয়ে বাহার চার বছরের পথ চলায় শিক্ষকসহ সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। ফেসবুকেই লিখেছেন, সামনে তাঁর জন্য আরও কঠিন যুদ্ধ অপেক্ষা করছে। এবার একটা চাকরি করে মায়ের দুঃখ কমানোর ইচ্ছার কথাও লিখেছেন।

বাসসেবাবিষয়ক পরামর্শদাতা ওয়েবসাইট ‘কেমনে যাব ডট কম’ তৈরি করেছেন বাহার। এখানে বিজ্ঞাপন থেকে মাসে তিন থেকে চার হাজার টাকা আয় হয় তাঁর। এই টাকা দিয়ে চট্টগ্রাম শহরে টেনেটুনে নিজের খরচ চালাতে হয়। আর মা থাকেন কক্সবাজারের চকরিয়ায়। অন্যের জমিতে কৃষিকাজ করে মা তাঁর বাবার বাড়ির পাশে ছোট একখণ্ড জায়গা কিনেছেন, সেখানেই ঘর তুলে থাকছেন। এর আগে তিনি বাবার বাড়িতেই ছিলেন। বাহার যখন মায়ের পেটে ছিলেন, তখন বাবা তাঁর মাকে মারধর করে চলে গিয়েছিলেন। বাহার তাঁর বাবাকে কখনো দেখেননি। কিছু দিন ধরে তাঁর বাবা আবার মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছেন।

বাহার বললেন, ‘আমি অন্য স্বাভাবিক মানুষের অর্থাৎ যাদের হাত, পা সবই আছে, তাদের চেয়েও দ্রুতগতিতে কাজ করতে পারি, বিশেষ করে কম্পিউটার চালনা বা এ ধরনের কাজ। এ যোগ্যতাগুলো বিবেচনায় নিয়ে কেউ আমাকে চাকরি দেবেন সে প্রত্যাশা করি। এনজিও বা যে কোনো প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ বিভাগ বা প্রশাসনিক বিভাগে অথবা প্রশিক্ষণ খাতেও কাজ করতে পারব। তবে সবার তো আগে চোখে পড়ে আমার দুই হাত নেই, আমি মনে হয় কাজ করতে পারব না, তা আগেই ভেবে নেন। এ মানসিকতার পরিবর্তন না হলে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ পাওয়া কঠিন।’

নিজের লেখাপড়া চালিয়ে নেওয়া এবং মাকে সহযোগিতা করার জন্য একটা চাকরি খুব দরকার বলে জানান বাহার। তিনি বলেন, ‘১০ হাজার টাকা বেতন হলে মাকে দেব, নাকি নিজে চলব? আমি যতটুকু সক্ষম, আমার যোগ্যতা অনুযায়ী কেউ যদি আমাকে একটা চাকরি দেন, আমার খুব উপকার হবে।’

গোসল, খাওয়া ও চলাফেরার মতো দৈনন্দিন কাজ বাহার একাই করতে পারেন, এসব কাজের জন্য অন্য কারও সহায়তা লাগে না। ছোট থেকে এ পর্যন্ত পাড়ি দেওয়ার পেছনে নানাবাড়ি ও মামাদের যে অবদান, তা বারবার তিনি বলছিলেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় নানা বাড়ির সূত্রেই কিছু আত্মীয়স্বজনও এগিয়ে এসেছেন।

বাহার বললেন, ‘আমি অন্য স্বাভাবিক মানুষের অর্থাৎ যাঁদের হাত–পা আছে, তাঁদের চেয়েও দ্রুতগতিতে কাজ করতে পারি, বিশেষ করে কম্পিউটার চালনা বা এমন ধরনের কাজ। এ যোগ্যতাগুলো বিবেচনায় নিয়ে কেউ আমাকে চাকরি দেবেন সে প্রত্যাশা করি। এনজিও বা যে কোনো প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ বা প্রশাসনিক বিভাগে অথবা প্রশিক্ষণ খাতেও কাজ করতে পারব। তবে সবার তো আগে চোখে পড়ে আমার দুই হাত নেই, আমি মনে হয় কাজ করতে পারব না, তা আগেই ভেবে নেন। এ মানসিকতার পরিবর্তন না হলে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ পাওয়া কঠিন।’

বাহার মুখে কলম আটকে কনুইয়ের সাহায্যে লেখেন, কম্পিউটারে টাইপও করেন একইভাবে। মুখ ও কনুই দিয়ে লিখেই তিনি পাস করেছেন উচ্চমাধ্যমিক। ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয়েছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। এবার অবশ্য তিনি শ্রুতলেখকের সহায়তা নেন শিক্ষকদের পরামর্শে। বাহার উদ্দিন বেশি পরিচিত রায়হান নামে।

এক হাত নেই, আরেক হাতের কনুইয়ের নিচের অংশ কাটা। তবে থেমে নেই কক্সবাজারের চকরিয়ার বাহার উদ্দিনের (রায়হান) এগিয়ে চলা। গতকালই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করেছেন তিনি
ছবি: সংগৃহীত

২০০৪ সালের ৩০ অক্টোবর, দিনটিকে ভুলতে পারেননি বাহার। তখন তিনি ছিলেন পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। বাড়ির পাশে বিদ্যুতের খুঁটিতে বসানো ট্রান্সফরমারে একটি ছোট পাখি ঢুকে পড়ে। সেই পাখি দেখতে গিয়ে তারে হাত দিতেই ঘটেছিল দুর্ঘটনা। ঝলসে যায় তাঁর দুই হাত, বুকের কিছু অংশ ও পায়ের তলা। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে পাঁচ দিনের মধ্যে কেটে ফেলা হয়েছিল রায়হানের এক হাত ও আরেক হাতের কনুই পর্যন্ত।

বাহার বললেন, ‘তখন হাসপাতালের খরচই এসেছিল দেড় লাখ টাকা, আমার মামারাই সেই টাকা দিয়েছিলেন। দীর্ঘ সময় পরে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরলে খালাতো বোন মুসলিমা মুখে বা পায়ে লেখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। আর তার ফল হলো, আমি আজ স্নাতক পাস করলাম।’

বাহার সেই অর্থে কখনো বসে থাকেননি। বিভিন্ন সময়ে নিজের জমানো টাকা দিয়ে একটি কম্পিউটার কিনে বাড়িতে প্রশিক্ষণকেন্দ্র খুলেছিলেন। ২০১৫ সালে চকরিয়া কলেজে পড়ার সময় ব্রিটিশ কাউন্সিলের দ্য হাঙ্গার প্রজেক্টের আওতায় ‘অ্যাকটিভ সিটিজেন ইয়ুথ লিডারশিপ’ প্রশিক্ষণ নেন। এরপর বিভিন্ন সময়ে এ দুটি সংস্থার হয়ে নিজে প্রশিক্ষক হিসেবে অন্যদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। ইউটিউবে তাঁর নিজস্ব চ্যানেল রয়েছে ‘বাহার রায়হান’ নামে। এক বন্ধুর সঙ্গে মিলে গড়ে তুলছেন ‘কেমনে যাব ডটকম’ ওয়েবসাইট। এতে দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে যাওয়ার দূরপাল্লার বাসের তথ্য পাচ্ছেন মানুষ। এর বাইরেও নিজেকে বিভিন্ন কাজে যুক্ত রাখেন তিনি। এই মুহূর্তে তিনি একটি ভালো চাকরি চান, যা দিয়ে মাকে নিয়ে তাঁর খরচ মেটানোর পাশাপাশি পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতে পারেন।