চাকরির শেষ সময়ে 'মুক্তিযোদ্ধা সনদ' নেওয়ার হিড়িক

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়

৩০ থেকে ৩৫ বছর চাকরি করার পর এখন অবসর নেওয়ার পালা। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেখাতে পারলেই আরও এক বছর বেশি চাকরি করা যায়। আর এই সুযোগ কাজে লাগাতে মুক্তিযোদ্ধা সনদ সংগ্রহের হিড়িক পড়েছে জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যে।
চাকরির মেয়াদ বাড়াতে বা অন্যান্য সুযোগ নিতে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছেন, এমন কর্মকর্তাদের মধ্যে অন্তত চারজন সচিব, একজন যুগ্ম সচিব ও একজন সাবেক সচিব রয়েছেন। আর গত পাঁচ বছরে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছেন সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন পেশার মোট ১১ হাজার ১৫০ জন। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
জনপ্রশাসনের পদস্থ কর্মকর্তারা বলছেন, অবসরের মুহূর্তে এ ধরনের সনদ নেওয়া অনৈতিক। এসব সনদ ভুয়া কি না, সে প্রশ্নও উঠেছে। তাঁরা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একটি প্রজ্ঞাপনে স্পষ্টই বলা হয়েছে, কেউ মুক্তিযোদ্ধা হলে চাকরিতে যোগদানের সময়ই তাঁকে ঘোষণা দিতে হবে। পরে বললে তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য করা হবে না।

চাকরি জীবনের শেষ সময়ে এভাবে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেওয়া সন্দেহজনক বললেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান। গত রাতে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, চাকরির শেষ সময়ে এসে কেন তাঁদের মনে পড়ল তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এটা নৈতিক অবক্ষয় ছাড়া কিছুই নয়। তিনি বলেন, প্রতিটি সরকার এলেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নতুন নতুন হিসাব হয়। কিন্তু কারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা, তা সবাই জানেন। সরকারের উচিত বিষয়টি পর্যালোচনা করা, তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া। কেউ সুপারিশ করে দিলেন, আর সনদ পেয়ে গেল, এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকজন সচিবের নাম অন্তর্ভুক্ত করে মুক্তিযোদ্ধা গেজেট প্রকাশিত হয়েছে, তাঁরা হলেন স্বাস্থ্যসচিব নিয়াজ উদ্দিন মিঞা, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সচিব কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসচিব এ কে এম আমির হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক সচিব মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত সচিব খোন্দকার শওকত হোসেন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আবুল কাসেম তালুকদার। এভাবে সনদ নিয়েছেন চিকিৎসক, শিক্ষক, প্রকৌশলী ও ব্যাংকারসহ বিভিন্ন শ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তারা।
যোগাযোগ করা হলে সচিব খোন্দকার শওকত হোসেন বলেন, আগেও তাঁর নামে গেজেট প্রকাশ হয়েছিল। কিন্তু নামের বানান ভুল হওয়ায় গত ২৪ নভেম্বর পুনরায় গেজেটে নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। লাল মুক্তিবার্তায় তাঁর নাম রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
২০১০ সালের ৭ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিবের দায়িত্ব পালনকালে মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামানই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক প্রজ্ঞাপনে জানিয়েছিলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের বয়সসীমা দুই বছর বাড়ানোর আদেশ জারি করার পর এ সুবিধা নেওয়ার জন্য অনেকেই নানা ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে সনদ নেওয়ার চেষ্টা করছেন। তাই যেকোনো একটি মানদণ্ডের ভিত্তিতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে মুক্তিযোদ্ধা গণকর্মচারী হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
চার মানদণ্ড হচ্ছে: যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সময় নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন অথবা যাঁদের নাম মুক্তিবার্তা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল অথবা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যাঁদের নাম গেজেটে প্রকাশিত হয়েছিল অথবা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যাঁরা প্রধানমন্ত্রীর সই করা সনদ গ্রহণ করেছেন। কিন্তু বর্তমানে সনদ দেওয়ার ক্ষেত্রে এসব মানদণ্ডের কোনোটিই মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।

সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এ বি তাজুল ইসলাম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ কমান্ডার বা সাংসদের সুপারিশ নিয়ে অনেকে আবেদন করেছেন। আমার জানামতে চার মানদণ্ডের কোনোটাই তাঁদের নেই। তবে এ ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম হয়ে থাকলে অবশ্যই সনদ বাতিল করা উচিত।’
মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মিজানুর রহমান বলেন, এত দিন মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় না দিলেও স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর এসে সনদ নেওয়ার হিড়িক পড়ে গেছে। তাঁর দাবি, তিনি সচিব থাকার সময় অনেক কর্মকর্তা সনদ নেওয়ার চেষ্টা করলেও তিনি দেননি। তিনি বলেন, তাঁর দায়িত্ব পালনকালে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল সুপারিশ করলেও তিনি মাঠপর্যায় থেকে তদন্ত প্রতিবেদন এনে সত্যতা যাচাই না করা পর্যন্ত একটি সনদও দেননি। আর এখন প্রভাব খাটিয়ে অনেকেই মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়ে যাচ্ছেন।
জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের মহাপরিচালক সৈয়দ মাহবুব হোসেন এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ ছাড়া আমি কোনো মন্তব্য করতে পারব না।’
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যেসব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সম্প্রতি সনদ নিয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই চার মানদণ্ডের আওতায় পড়েননি। তাঁরা চাকরিতে প্রবেশের সময় নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা করেননি।
মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের সূত্রে জানা গেছে, গত ১৭ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্যসচিব নিয়াজ উদ্দিন মিঞাকে মুক্তিযোদ্ধা উল্লেখ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। তিনি এ বছরের ৩০ ডিসেম্বর অবসরোত্তর ছুটিতে যাবেন। চাকরিতে যোগদানের সময় না বললেও মেয়াদের শেষ সময়ে এসে জানিয়েছেন, তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, নিয়াজ উদ্দিন মিঞা সচিব পরিচয় না দিয়ে আবেদন করেছিলেন। গাজীপুরের সাংসদ ও বর্তমান মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এতে সুপারিশ করেছিলেন।
এত বছর চাকরি করার সময় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজেকে ঘোষণা না দিয়ে চাকরির শেষ বছরে কেন মুক্তিযোদ্ধা সনদ সংগ্রহ করেছেন? চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর জন্যই কি এটা করেছেন? গতকাল টেলিফোনে এ প্রশ্ন করা হলে সচিব নিয়াজ উদ্দিন মিঞা কোনো মন্তব্য করেননি। শুধু বলেছেন, পরে ফোন করবেন।
মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান তিন বছর আগেই অবসরে গেছেন। এরপর তিন বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগও পেয়েছেন। ১১ জানুয়ারি তাঁর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ শেষ হয়েছে। চুক্তির মেয়াদ আবার বাড়িয়ে এবার তাঁকে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় বেসরকারীকরণ কমিশনের চেয়ারম্যান করা হয়েছে। তিনি মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছেন গত বছরের সেপ্টেম্বরে, চাকরিতে থাকাকালে নেননি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওয়াহিদুজ্জামান প্রতিবেদকের পরিচয় জানতে চান এবং পরে টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

রক্ষক হয়ে ভক্ষকের কাজ করেছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সচিব কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকী। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, অতীতে মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো তালিকায় তাঁর নাম ছিল না। তাঁর ক্ষেত্রে চার মানদণ্ডের একটিও অনুসরণ করা হয়নি—এ কথা তিনি স্বীকার করে বলেছেন, ২০০৫ সালে ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে তিনি মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছিলেন। অন্য সব প্রত্যয়নপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেওয়া হয়েছে বলে তাঁর দাবি।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসচিব আমির হোসেন বলেন, সম্প্রতি তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তাঁর চাকরির মেয়াদ শেষ হবে আগামী বছর। কেন এত দিন পর গেজেট প্রকাশ হচ্ছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি এত দিন সনদ পেতে চেষ্টা করিনি।’
তবে সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সচিব মিজানুর রহমান বলেন, তাঁর সময়ে আমির হোসেন সনদ পেতে অনেক তদবির করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আবুল কাসেম ও স্বাস্থ্যসচিব নিয়াজ উদ্দিন মিঞার প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে একই দিনে, ১৭ নভেম্বর। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, আবুল কাসেম যে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তাঁরা এই প্রথম শুনলেন। অভিযোগ আছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় আবুল কাসেমের বয়স ছিল মাত্র সাড়ে নয় বছর। এই অভিযোগের ব্যাপারে মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তদন্ত চলছে বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগের চেষ্টা করে আবুল কাসেমের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, কিছু অসাধু ব্যক্তি মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিচ্ছেন। অনেক অমুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তা প্রত্যয়নপত্র নিয়ে অতিরিক্ত সময় চাকরি করছেন বলে অভিযোগ আছে। এঁদের বেশির ভাগই নিজের পরিচয় গোপন রেখে আবেদন করেছেন।