চারপাশে ঝাঁজালো গন্ধ, ডিপো এলাকা যেন ধ্বংসস্তূপ

কনটেইনার ডিপোর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা মরদেহ উদ্ধার করে নিয়ে আসছেন রেড ক্রিসেন্টসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে
ছবি: জুয়েল শীল

প্রথমে আগুন, এর দেড় ঘণ্টা পর বিকট শব্দে বিস্ফোরণ। কিছুক্ষণ পর আবারও বিস্ফোরণ। গত শনিবার রাতে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোর ভেতরে আগুন লাগার পর বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছিল আশপাশের প্রায় আড়াই বর্গকিলোমিটার এলাকা। তখনই অনুমান করা হচ্ছিল, ডিপোর ভেতরে ভয়াবহ কিছু ঘটে চলেছে।

ওই বিস্ফোরণ ও আগুন পুড়ে মারা গেছেন ৪৯ জন। তাঁদের মধ্যে ৯ জনই ফায়ার সার্ভিসের সদস্য, যাঁরা আগুন নেভাতে ও অন্য মানুষের প্রাণ বাঁচাতে ডিপোতে গিয়েছিলেন। মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে আরও রয়েছেন ডিপোর কর্মকর্তা-কর্মচারী ও পরিবহনশ্রমিকেরা। এ ছাড়া আহত হয়েছেন ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের সদস্যসহ দুই শতাধিক শ্রমিক-কর্মচারী। এর মধ্যে পুলিশের একজন সদস্যের পা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

গুরুতর আহত ব্যক্তিদের মধ্যে ১৪ জনকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে করে উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় নেওয়া হয়েছে। তাঁদের ঢাকায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা চলছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

সীতাকুণ্ডের কনটেইনার ডিপোতে আগুন লাগার পর ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে হাইড্রোজেন পার–অক্সাইড থাকা কনটেইনারে, যাতে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৪৯ জন
ছবি: জুয়েল শীল

ভয়াবহ বিস্ফোরণের ১০ ঘণ্টা পর গতকাল রোববার সকাল নয়টায় সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে গিয়ে দেখা যায়, ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে পুড়ে যাওয়া মরদেহ।

কোথাও পড়ে আছে পুড়ে যাওয়া বিচ্ছিন্ন হাত। এদিক-সেদিক ছিটানো লোহার পাত, রাসায়নিক রাখা প্লাস্টিক জারের ভাঙা টুকরা। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের পোড়া হেলমেট, পোশাক। ডিপোর ভেতরে কনটেইনারের ধ্বংসস্তূপ থেকে তখনো বের হচ্ছিল আগুনের ফুলকি। রাসায়নিকের ঝাঁজালো গন্ধ। এর মধ্যেই থেমে থেমে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। পুরো এলাকা যেন ধ্বংসস্তূপ।

শনিবার রাতে বিস্ফোরণের পর আগুন, উত্তাপ ও ধোঁয়া ছড়িয়েছে আশপাশের এলাকায়। বিস্ফোরণের শব্দ ও আগুনের উত্তাপে ভেঙে গেছে আশপাশের এলাকার বাসাবাড়ির জানালার কাচ। এমনকি অনেক ঘরের টেলিভিশন, ফ্রিজসহ বৈদ্যুতিক পাখা নষ্ট হয়ে গেছে।

ডিপোতে আগুন লাগার সময় কতজন কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিক কাজ করছিলেন, তার সঠিক সংখ্যা এখনো জানা যায়নি। তবে পরিবহনশ্রমিক ও ডিপোর কর্মী মিলে কয়েক শ হবে বলে ধারণা করছেন ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের সদস্যরা।

যেভাবে বিস্ফোরণ

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, শনিবার রাত সোয়া নয়টার দিকে ডিপোর রাসায়নিক পণ্য রাখার শেডের পাশে যেখানে কনটেইনার রাখা হয়, সেখান থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। কনটেইনারে ছিল হাইড্রোজেন পার–অক্সাইড নামের রাসায়নিক। পাশের শেডে কনটেইনারে বোঝাই করার জন্য প্লাস্টিকের জারে রাখা ছিল একই রাসায়নিক। কনটেইনারে করে এই রাসায়নিক পণ্য বন্দর দিয়ে রপ্তানির জন্য জাহাজে তুলে দেওয়ার কথা ছিল।

আগুন লাগার পর কনটেইনার ডিপোর শ্রমিক অলিউর রহমান ঘটনাটি ফেসবুকে লাইভ দিচ্ছিলেন। সেখানে দেখা যায়, কনটেইনার ঘিরে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। পানি ছিটিয়ে যাচ্ছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। তবে আগুন না কমে আরও বিস্তৃত হচ্ছিল। এভাবে চলল প্রায় ৪০ মিনিট। এরপর হঠাৎ বিকট শব্দে বিস্ফোরণ। এরপর শুধুই আহাজারি, আর্তনাদ।

বিস্ফোরণের সময় চার স্তরে থাকা কনটেইনারের টুকরা স্প্লিন্টারের মতো ছুটে যায় চারদিকে। অলিউর রহমান ঘটনাস্থলেই মারা যান। থেমে যায় তাঁর লাইভ ভিডিও।

প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা

রাসায়নিকবোঝাই কনটেইনার থেকে মাত্র ২০ গজ দূরে ছিলেন ট্রাকচালক মোহাম্মদ রাব্বি। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন রাব্বি গতকাল দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাসায়নিকের কনটেইনারের পেছনে অন্য পণ্যের কনটেইনার ছিল। সেখানে আগুন লাগার কথা শুনতে পাই। মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে শেড ও রাসায়নিকের কনটেইনারে। পরে আগুন দেখে গাড়ি নিয়ে বের হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মুহূর্তেই বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়। এরপর আর কিছু জানি না।’

ডিপোর আরেক কর্মচারী নুরুল ইসলাম (১৯) জানান, তিনি অগ্নিকাণ্ডের স্থল থেকে ৪০ গজ দূরে ছিলেন। মুঠোফোনে অগ্নিকাণ্ডের দৃশ্য ধারণ করছিলেন। তাঁর সঙ্গে আরও পাঁচজন ছিলেন। বিকট শব্দে বিস্ফোরণের পর তাঁরা সবাই ছিটকে পড়েন। তাঁর পাশেই দুজনের দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে ছিল। তাঁর গায়েও আগুন লেগে যায়। পরে তিনি একটি নালার পাশে থাকা টিউবওয়েল থেকে শরীরে পানি ঢালেন। ওই নালায় একজনের নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখেন নুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, পরে কী ঘটেছে, ঠিক মনে নেই। শুধু বুঝতে পারেন, কয়েকজন লোক তাঁকে ধরে হাসপাতালে নিয়ে আসেন।

ভয়াবহ এ বিস্ফোরণে প্রাণে বেঁচে গেছেন ফরমানুল ইসলামও। বিস্ফোরণের পর তাঁর গায়ে আগুন লেগে যায়। পরে তিনি পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণে বাঁচেন। ফরমানকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন তাঁর বড় ভাই মো. জাহেদুল ইসলাম। জাহেদুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিস্ফোরণের পর দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে যাই। ঘটনাস্থল থেকে আমার বাসার দূরত্ব পাঁচ থেকে সাত মিনিটের। সেখানে দেখি, অসংখ্য মানুষ দগ্ধ অবস্থায় দৌড়ে ডিপোর বাইরে আসছেন। তাঁদের মধ্যে ভাই ফরমানুলও ছিল।’

ধ্বংসস্তূপে কারও দেহাবশেষ আছে কি না, তা খুঁজে দেখছেন দুই ব্যক্তি
ছবি: জুয়েল শীল

হাসপাতালে আর্তনাদ

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শনিবার রাত ১১টার পর থেকে মৃত ও আহত ব্যক্তিদের নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স আসা শুরু হয়। তাঁদের বার্ন ইউনিটসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডে পাঠানো হয়। রাত যত বাড়তে থাকে, আহত ব্যক্তিদের স্রোত ততই বাড়তে থাকে। বার্ন ইউনিট, সার্জারি বিভাগ, অর্থোপেডিক ও মেডিসিন বিভাগে আহত ব্যক্তিদের আর্তচিৎকারে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। চিকিৎসক ও নার্সরা আহত ব্যক্তিদের সেবা দিতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালান। জরুরি ভিত্তিতে প্রতিটি বিভাগের জ্যেষ্ঠ ও অতিরিক্ত চিকিৎসকদের হাসপাতালে ডেকে আনা হয়।

শনিবার রাতেই হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স হাসপাতালে পৌঁছানোর পরই মৃত ও আহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। ওয়ার্ড ঘুরেও অনেকে স্বজনদের খোঁজ পাননি। মৃত ব্যক্তিরা পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়ায় তাৎক্ষণিক পরিচয়ও নিশ্চিত করা যায়নি।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান জানান, বিস্ফোরণের ঘটনায় ২০০ জন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এরপর ১৩০ জনকে এখান থেকে সিএমএইচ, ঢাকা ও বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে পাঠানো হয়। গতকাল দুপুর পর্যন্ত ৭০ জনের মতো চিকিৎসাধীন ছিলেন।

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সীতাকুণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৪৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ২৩ জনের পরিচয় শনাক্ত হয়েছে।

ক্ষতিগ্রস্ত আশপাশের এলাকা

বিএম কনটেইনার ডিপোর আশপাশের অন্তত দুই কিলোমিটার এলাকায় বসবাসকারীরা বেশির ভাগই শ্রমিক। বসতঘরগুলো টিনশেডের। উঁচু দালানের সংখ্যা কম। এর মধ্যে যেসব ঘর বা ভবনের কাচের জানালা আছে, বিস্ফোরণের তীব্র শব্দে সেগুলো ভেঙে গেছে। ঘটনাস্থলের আশপাশের কেশবপুর, মোল্লাপাড়া, লালবেগ গ্রাম ঘুরে এমন চিত্র দেখেছেন প্রথম আলোর প্রতিবেদকেরা।

বিস্ফোরণের পর থেকে কালো ধোঁয়া আর রাসায়নিকের ঝাঁজালো গন্ধে অসুবিধায় পড়ার কথা জানিয়েছেন আশপাশের তিন গ্রামের বাসিন্দারা। সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে শিশু ও বৃদ্ধরা। মুখে মাস্ক পরে থাকতে দেখা গেছে বেশ কয়েকজনকে। কেশবপুর গ্রামের বাসিন্দা ৫৫ বছর বয়সী লাকী আকতার বলেন, কালো ধোঁয়া আর গন্ধে টিকতে পারছেন না তাঁরা। আতঙ্কে শিশুরা কান্না করছে। বাড়ির বৃদ্ধদেরও খুব কষ্ট হচ্ছে।

মোল্লাপাড়া গ্রামের জোহরা বেগম বলেন, তাঁর ঘরের টিভি, ফ্রিজ ও তিনটি বৈদ্যুতিক পাখা নষ্ট হয়ে গেছে। উড়ে গেছে ঘরের টিন।

ডিপোর দক্ষিণ পাশের নিরাপত্তাদেয়াল ঘেঁষে শ্রমিকদের থাকার পাঁচতলা দুটি ভবন। থাকেন প্রায় এক হাজার শ্রমিক। এখান থেকেই পালা করে কাজে যেতেন শ্রমিকেরা। আতঙ্কে কয়েকজন শ্রমিক সেখান থেকে চলে গেছেন।

পুড়ে ছাই আমদানি-রপ্তানি পণ্য

কনটেইনার ডিপো ২৪ ঘণ্টা সচল থাকে। রাত-দিন পণ্যের কনটেইনার বন্দর থেকে এনে রাখা হয়। তারপর কনটেইনার খুলে খালাস করে আবার তা নিয়ে যান আমদানিকারক। আবার কারখানা থেকে রপ্তানি পণ্য কাভার্ড ভ্যানে করে এনে ডিপোর শেডে রাখা হয়। এরপর খালি কনটেইনারে পণ্য বোঝাই করা হয়। তারপর গাড়িতে করে বন্দরে নিয়ে জাহাজে তুলে দেওয়া হয়।

সর্বশেষ শুক্রবার এই ডিপোর আমদানি-রপ্তানির তথ্য পাঠানো হয় বন্দরে। তাতে দেখা যায়, শুক্রবার বিএম ডিপোতে ৮৬৭ একক কনটেইনার রপ্তানি পণ্য এবং ৫৫৭ একক কনটেইনার আমদানি পণ্য ছিল। খালি কনটেইনার ছিল ২ হাজার ৮৯৪টি। এসব কনটেইনারে কী পরিমাণ রাসায়নিক পণ্য রপ্তানির অপেক্ষায় ছিল, তা জানাতে পারেননি বিএম কনটেইনার ডিপোর মহাব্যবস্থাপক নাজমুল আক্তার খান। প্রায় ২৪ একর জায়গার ওপর গড়ে ওঠা এই ডিপোতে ৮ হাজার একক কনটেইনার রাখা যায়।

বিস্ফোরণে শেডে থাকা সব রাসায়নিক ও তৈরি পোশাক পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। অনেক পণ্যবাহী কনটেইনারও পুড়ে গেছে। বিস্ফোরণের ঘটনায় কত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। যেসব কনটেইনার অক্ষত আছে, সেগুলো অন্য ডিপোর মাধ্যমে রপ্তানি করা হবে বলে জানিয়েছেন কনটেইনার ডিপো সমিতির সভাপতি নূরুল কাইয়ূম খান।

বিস্ফোরণের আগের দিন ২৩টি কাভার্ড ভ্যানে করে তারাশিমা অ্যাপারেলস ও রেমি হোল্ডিংসের রপ্তানি পণ্য বিদেশি ক্রেতাদের প্রতিনিধির হাতে তুলে দেওয়া হয়।

কনটেইনার বোঝাই করার জন্য এই রপ্তানি পণ্য শেডে রাখা হয়েছিল। দুটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক (রপ্তানি) কামরুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

বিস্ফোরণে ডিপোর নানা অবকাঠামো উড়ে গিয়ে পড়ে আছে বিভিন্ন জায়গায়
ছবি: জুয়েল শীল

ভয়াবহতা এত বেশি কেন?

ফায়ার সার্ভিস ও বন্দর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ডিপোতে রপ্তানির জন্য রাখা হাইড্রোজেন পার–অক্সাইডের কনটেইনারের আগুন থেকে বিস্ফোরণ ঘটে। এক দশকের বেশি সময় ধরে এই রাসায়নিক রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে। এই রাসায়নিকের রপ্তানিকারক ছিল বিএম কনটেইনার ডিপোর আরেকটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান আল রাজি কেমিক্যাল কমপ্লেক্স। টেক্সটাইল ও ডাইংশিল্পে এই রাসায়নিকের ব্যবহার বেশি।

বিস্ফোরণের পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ডিপোর ২৬টি কনটেইনারে হাইড্রোজেন পার–অক্সাইড ছিল। কনটেইনারে বোঝাইয়ের জন্য শেডেও প্লাস্টিকের জারে এই রাসায়নিক রাখা হয়েছিল। তিনি বলেন, আগুন লাগার পর কনটেইনারে থাকা রাসায়নিকভর্তি জার ফেটে যায়। এতে হাইড্রোজেন পার–অক্সাইড বের হয়ে কনটেইনারের সংস্পর্শে আসে। আগুনের সংস্পর্শে আসায় কনটেইনারের ভেতরে তাপমাত্রা অস্বাভাবিক বেড়ে বিস্ফোরণ ঘটে। কনটেইনার ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে স্প্লিন্টারের মতো তীব্র গতিতে ছড়িয়ে পড়ে।

উল্লেখ্য, হাইড্রোজেন পার–অক্সাইড একটি রাসায়নিক যৌগ। যদি উত্তপ্ত করা হয়, তাহলে তাপীয় বিয়োজনে হাইড্রোজেন পার–অক্সাইড বিস্ফোরক হিসেবে আচরণ করে।

আগুন নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিস

শনিবার রাতে আগুন লাগার খবর পেয়ে প্রথমে ঘটনাস্থলে আসেন ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। চট্টগ্রামের চারটি উপজেলা, ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লা থেকে ফায়ার সার্ভিসের ২৩টি ইউনিটের ১৮৩ জন সদস্য কাজ করেন। গতকাল রাত ১০টার সময়ও উদ্ধার অভিযান অব্যাহত ছিল।

গতকাল দুপুরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি দল ঘটনাস্থলে এসে কাজ শুরু করে। চট্টগ্রাম সেনানিবাসের ইঞ্জিনিয়ারিং কোর-১–এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনিরা সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, রাসায়নিক পদার্থ যাতে ডিপোর আশপাশের নালা দিয়ে সাগরে যেতে না পারে, সে জন্য সেনাবাহিনীর সদস্যরা বাঁধ দিয়ে রেখেছেন। বিকেলে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মো. সাইফুল আবেদীন ঘটনাস্থলে আসেন। এ ছাড়া ঘটনাস্থলে নৌবাহিনীর সদস্যদেরও আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে দেখা গেছে।

শনিবার রাত থেকে ঘটনাস্থলে ছিলেন পুলিশ সদস্যরা। পুলিশের ১০ জন সদস্যও আহত হন। ঘটনাস্থলে আসা চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার এস এম রশিদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার পর কনটেইনার ডিপোতে যাতে অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা না ঘটে, সে জন্য পুলিশ সদস্যরা নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করেছেন।

আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে বেগ পেতে হচ্ছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের। ডিপোর পূর্ব অংশে গতকাল সকালে ক্লান্ত হয়ে বসে ছিলেন চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের ওয়্যারহাউস ইন্সপেক্টর ওয়াসি আজাদ। রাসায়নিকের ধোঁয়ায় তাঁর দুই চোখ লাল হয়ে গেছে। ডান চোখ দিয়ে পানি ঝরছিল।

পাঁচটি তদন্ত কমিটি

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের ঘটনা তদন্তে পাঁচটি পৃথক কমিটি গঠন করেছে বিভিন্ন সংস্থা—বন্দর কর্তৃপক্ষ, বিভাগীয় কমিশনার, ফায়ার সার্ভিস, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া ডিপো কর্তৃপক্ষও পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। গতকাল সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. মমিনুর রহমান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে স্থাপিত নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, প্রতিটি কমিটি নিজেদের মতো ঘটনার তদন্ত করে কারণ অনুসন্ধান ও ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করবে।

বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনায় রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। জাতীয় সংসদের অধিবেশনেও সীতাকুণ্ডের ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে।

সীতাকুণ্ডে এ ডিপো বিস্ফোরণের পর ডিপো কর্তৃপক্ষের ঊর্ধ্বতন কেউ ঘটনাস্থলে ছিলেন না। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশনস, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার সময় সীতাকুণ্ডে কনটেইনার ডিপোতে দায়িত্বরত বা দায়িত্বশীল কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এতে ফায়ার সার্ভিসকে সমস্যায় পড়তে হয়। কারণ, কনটেইনারে কী ছিল, কেমিক্যাল ছিল কি না, তা ফায়ার সার্ভিস শনাক্ত করতে পারেনি। ফলে প্রাথমিকভাবে ক্ষয়ক্ষতি ঘটে এবং ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা হতাহত হন।

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক প্রণব বল, মাসুদ মিলাদ, গাজী ফিরোজ, শিক্ষানবিশ প্রতিবেদক সুজয় চৌধুরী, সীতাকুণ্ড প্রতিনিধি কৃষ্ণচন্দ্র দাস, মিরসরাই প্রতিনিধি ইকবাল হোসেন, আনোয়ারা প্রতিনিধি মোহাম্মদ মোরশেদ হোসেন ও রাউজান প্রতিনিধি এস এম ইউসুফ উদ্দিন]