চায়ে স্বপ্ন বুনছে ঠাকুরগাঁওয়ের চাষিরা

অন্য ফসলের তুলনায় লাভ বেশি হওয়ায় ক্ষুদ্র চাষিরা চা চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। নিটোলডোবা গ্রামে ‘গ্রিনফিল্ড টি এস্টেট’ নামের একটি চা–বাগানে কাজ করছেন শ্রমিকেরা, বালিয়াডাঙ্গী, ঠাকুরগাঁও, ৩ জুন
ছবি: প্রথম আলো

কোথাও বসতবাড়ির উঠানঘেঁষা জমি। কোথাও আনাচকানাচে। কোথাও বাড়ির পাশে পড়ে থাকা উঁচু-নিচু একচিলতে জমি সবই এখন সবুজে সবুজ। এ যেন প্রকৃতিতে কেউ সবুজের গালিচা বিছিয়ে দিয়েছে। সবুজের এ গালিচা আর অন্য কিছু নয়, দিগন্তবিস্তৃত চায়ের বাগান। গত কয়েক বছরে ঠাকুরগাঁওয়ে এমন ছোট ছোট চায়ের বাগান গড়ে উঠেছে।

জেলার সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোর দিগন্তবিস্তৃত চা-বাগান ছাড়াও যেখানে সুযোগ পেয়েছেন, সেখানেই চায়ের গাছ লাগিয়েছেন এলাকার চাষি। অন্য ফসলের তুলনায় লাভ বেশি হওয়ায় ঠাকুরগাঁওয়ের ক্ষুদ্র চাষিরা চা চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। এতে চা-বাগানে কর্মসংস্থানের সুযোগও হচ্ছে অনেকের।

জেলার প্রতিটি উপজেলার ইউনিয়ন পর্যায়ের প্রধান সড়কগুলো পাকা। কোনো কোনো সড়ক সীমান্ত পর্যন্ত ঠেকেছে। সড়কের উভয় কিনারা দিয়ে গাছপালার সারি। ডানে-বাঁয়ে ফসলি জমি, ঝোপঝাড়, পাড়া–মহল্লা, বাজার, স্কুল, মসজিদ, চায়ের দোকান, পুকুর—এসব রেখে এঁকেবেঁকে এগিয়ে গেছে দূরদূরান্তে। সেই পথ দিয়ে যেতে এখন চোখে পড়ে ছোট-বড় চা–বাগান।

যেভাবে শুরু
১৯৯৯ সালে পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁওয়ে জরিপ চালায় বাংলাদেশ চা বোর্ড এবং চা গবেষণা ইনস্টিটিউট। ২০০০ সালের দিকে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলায় প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হয়। পরে ২০০৭ সালে ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায় প্রথম চা চাষ শুরু হয়। কৃষকের বসতবাড়ির আশপাশসহ পতিত জমিতেও এখন ছোট ছোট চা-বাগান চোখে পড়ছে। ঠাকুরগাঁওয়ে বাংলাদেশ চা বোর্ডের নিবন্ধিত এখন চাষি ৩৮৬ জন। বালিয়াডাঙ্গীর বড় দুটি বাগান বাদ দিয়ে সদর উপজেলায় ১৯৪ একর, বালিয়াডাঙ্গীতে ১ হাজার ৮১, রানীশংকৈলে ৯, পীরগঞ্জে ৬ ও হরিপুরে ৩ একর জমিতে চা আবাদ হচ্ছে। চা চাষের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন ৬৫৭ জন চাষি।
চা–চাষিরা বলেন, কয়েক বছরের মধ্যে এ চা চাষ বদলে দিয়েছে জেলার সীমান্ত এলাকার অর্থনীতির চিত্র। একসময় যে পতিত জমি ব্যবহৃত হতো গোচারণের কাজে, এখন তা চায়ের সবুজ পাতায় ভরে গেছে। এসব চা-বাগানে তিন হাজার নারী-পুরুষ কৃষিশ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন।

বাড়ির সামনে–পেছনে, আনাচকানাচে বাগান
বালিয়াডাঙ্গীর ভান্ডারদহ গ্রামের পাকা রাস্তার পাশে পড়ে থাকা ১৬ শতক জমিতে চা চাষ করছেন শিক্ষক শহিদুল ইসলাম (৫২)। বছর তিনেক ধরে এ বাগানে শ্রম দিচ্ছেন তিনি। বাগানটি থেকে প্রতি ৪০ দিন পরপর ২০০ কেজির বেশি চা–পাতা সংগ্রহ হয়। এখন চা চাষ করে বছরের সাত মাসেই তাঁর আয় প্রায় ২৮ হাজার টাকা।

মরিচপাড়ার বাঁশঝাড়ের নিচে ১০ শতক জমিতে চা চাষ করছেন জগদীশ রায়। সেই জমি পড়েই থাকত। এখন তিনি ওই বাগানের চা–পাতা বিক্রি করে আয় করছেন।
চা-চাষি শহিদুল ইসলাম বলেন, চা চাষের শুরুতে চা কারখানার মালিকেরা ইচ্ছামতো চা-পাতার দাম বেঁধে দিতেন। এখন সেই দিন পাল্টেছে। এ কারণে চাষিরা চা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।

কর্মসংস্থান
বালিয়াডাঙ্গী সীমান্তের নিটোলডোবা গ্রামে ৯৫ একরের ‘গ্রিনফিল্ড টি এস্টেট’ নামের একটি চা–বাগান রয়েছে। এ বাগানের ব্যবস্থাপক তাজমুল হক বলেন, গত বছর তাঁরা নিজস্ব বাগান থেকে প্রায় ৪০ লাখ কেজি কাঁচা চা-পাতা তুলেছেন। এ বাগানে নারী–পুরুষ মিলিয়ে ১৩০ শ্রমিক কাজ করেন।

এ বাগানে কাজ করেন নাজেরা বেগম (৪৭), দিনোবালা (৪৫) ও ফাতেমা বেগম (৩৮)। নাজেরা বেগম বলেন, আগে এলাকায় কাজ ছিল না। এখন দৈনিক ১৮০ থেকে ২০০ টাকা আয় করেন তিনি।

বাগানে আগাছা তুলতে তুলতে একটি কুঁড়ি ও দুটি পাতা দেখিয়ে দিনোবালা বলেন, ‘চা-বাগান হামার মতো অনেক মানুষের কামাইয়ের রাস্তা দেখাইছে।’

উপজেলার রণবাগে ইসলাম টি এস্টেট নামের সাংসদ দবিরুল ইসলামের ৪৫ একরের একটি চা–বাগান রয়েছে। ওই বাগানে কর্মসংস্থান হয়েছে ৭০ শ্রমিকের। গত বছর ইসলাম টি এস্টেট থেকে প্রতি রাউন্ডে এক লাখ কেজির বেশি কাঁচা চা-পাতা তোলা হয়েছে।

চাষিরা চা চাষে ঝুঁকছেন। এতে চা-বাগানে কর্মসংস্থানের সুযোগও হচ্ছে অনেকের। নিটোলডোবা গ্রামে ‘গ্রিনফিল্ড টি এস্টেট’ চা–বাগান, বালিয়াডাঙ্গী, ঠাকুরগাঁও, ৩ জুন
ছবি: প্রথম আলো

চায়ের মান নিয়ে প্রশ্ন
বাংলাদেশ চা বোর্ড পঞ্চগড় কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ঠাকুরগাঁওয়ে সাধারণত ভারতের টোকনাই ভ্যারাইটি (টিবি) চা চাষ হচ্ছে। এ জাতের চা রোপণের দেড় থেকে দুই বছরের মধ্যে পাতা তোলা যায়। প্রতি একর জমির চা-বাগান থেকে টিবি জাতের চা পাওয়া যায় প্রায় ৮ হাজার কেজি। এ কারণে চাষিরা টিবি জাতের চা চাষের প্রতিই আগ্রহী। অন্যদিকে রং ও গন্ধ ভালো হওয়ায় চা গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত বিটি-২ জাতের চায়ের চাহিদা এখন শীর্ষে। এ জাতের চায়ের দামও অনেক বেশি। টিবি জাতের চা-গাছের পাতা উৎপাদন বেশি হওয়ায় চাষিরা অন্য জাতের চা চাষে আগ্রহ দেখান না। ফলে চা-চাষিরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

ঠাকুরগাঁওয়ের চা–চাষিরা পাতা কাটেন ধান কাটার কাস্তে দিয়ে। আর সিলেট অঞ্চলের চা-বাগানগুলোতে শ্রমিকেরা হাত দিয়েই চায়ের পাতা তোলেন। হাত দিয়ে পাতা তুললে প্রতি মৌসুমে ৩০ থেকে ৩২ দফা পাতা তোলা যায়। আর কাস্তে দিয়ে পাতা কাটার কারণে নতুন কুঁড়ি আসতে সময় লাগে। এতে চাষিরা উৎপাদনের ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

সদর উপজেলার ক্ষুদ্র চা–চাষি আহসান উল্লাহ মেহেদি জানান, সরকারি উদ্যোগে স্থানীয়ভাবে কারখানা স্থাপন এবং চা চাষে ভর্তুকি প্রদানের ব্যবস্থা নিলে এ এলাকায় চা-শিল্প আরও প্রসারিত হবে।

২০১৭ সালে বালিয়াডাঙ্গীর শাহবাজপুর গ্রামে ‘গ্রিন ফিল্ড টি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’ নামের একটি চা প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা গড়ে তোলেন ফয়জুল ইসলাম। ওই কারখানায় গত বছর ৪ লাখ ১৩ হাজার ৩৪০ কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে।

গ্রিন ফিল্ড টি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফয়জুল ইসলাম বলেন, ‘এ অঞ্চলের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট বদলে দিতে পারে চা–শিল্প। সার্বিকভাবে এ অঞ্চলে চা-শিল্পের সম্ভাবনা খুবই উজ্জ্বল। এ মৌসুমে আমরা চা-চাষিদের কাছ থেকে প্রতি কেজি কাঁচা চা–পাতা ২২ টাকায় ক্রয় করছি। পরে আমাদের কারখানায় উৎপাদিত মেড টি চট্টগ্রাম অকশন মার্কেটে মান অনুযায়ী বিভিন্ন দামে বিক্রি হয়। সেখান থেকে বিভিন্ন ব্র্যান্ডিং কোম্পানি তা ক্রয় করে তাদের নিজস্ব নামে সরবরাহ করে থাকে।

বাংলাদেশ চা বোর্ডের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ‘একট্রেনশন অব স্মলহোল্ডিং টি কালটিভেশন ইন নর্দান বাংলাদেশ’ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ শামীম আল মামুন বলেন, ‘ঠাকুরগাঁওয়ের মাটি বেলে দো–আঁশ ও অম্লধর্মী। বৃষ্টির পানি জমে থাকে না। মাটিতে প্রয়োজনীয় উপাদান আছে। সিলেটের চেয়ে এ অঞ্চলের মাটি চা চাষের জন্য বেশি উপযোগী। এ জেলায় চা চাষ সম্প্রসারণের প্রবণতা খুবই আশাব্যঞ্জক। এ বিবেচনায় চা চাষের উন্নয়নে আমরা নানা রকম পদক্ষেপ হাতে নিয়েছি।’

নর্দান বাংলাদেশ প্রকল্পের আওতায় জেলায় চা–চাষিদের উন্নত জাতের দুই লাখ চারা বিতরণ করা হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় ৪১১ দশমিক ২৩ একর জমিতে চা আবাদ সম্প্রসারিত হয়েছে।

জেলা প্রশাসক কে এম কামরুজ্জামান সেলিম বলেন, ঠাকুরগাঁওয়ে চা চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। সম্ভাবনার কথা বিবেচনা করে চা বোর্ডের সহায়তায় এখানে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এখানে চায়ের অকশন সেন্টারের পাশাপাশি সরকারি চা প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপনে যোগাযোগ করা হচ্ছে।