চিনি নয়, লাভ দেয় আখের উপজাত

.
.

আখের কচি চারাগুলো কী স্বপ্ন নিয়ে বেড়ে ওঠে, পরিণত হয়ে তারা কী হতে চায়—এসব প্রশ্ন অবান্তর। তবে এদের যে প্রাণ আছে, তা তো বলে গেছেন বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু। সে আখ তার পুরো অস্তিত্ব খাক করে কীভাবে নানা পণ্যে রূপ নেয়, তার সাক্ষী কেরু অ্যান্ড কোম্পানি।
চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার মূল সড়কের দুধারে মাঠের পর মাঠ আখের খেত। কৃষকের সব দরদ শুষে আখগুলো বড় হচ্ছে। পরিপক্ব হয়ে তারা যাবে দর্শনার ঐতিহ্য কেরু অ্যান্ড কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডে। আর সেখানে ঘটবে তার রূপান্তর।
সম্প্রতি প্রথম আলোর চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি শাহ আলমের সঙ্গে কেরু অ্যান্ড কোম্পানিতে গিয়ে আখের আত্মত্যাগের কাহিনি জানলাম। প্রতিষ্ঠানটি সেখানে যে আয়োজন সাজিয়েছে তাতে চিনি, লিকার বা মদ, ভিনেগার এবং সবশেষে জৈব সারে রূপ পায় আখ। সুযোগ আছে আখের উপজাত বা বাইপ্রোডাক্ট থেকে বিয়ার ও বায়োগ্যাস বানানোরও। হালকা চালে বললে, আখের জীবন নিয়ে আখের গোছাচ্ছে কেরু নামের কোম্পানিটি!
৩ হাজার ৫৭২ একর ভূমি নিয়ে ১৯৩৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কেরু অ্যান্ড কোম্পানি। এর মধ্যে কৃষিজমি ২ হাজার ৪৫০ একর, যার পুরোটায় কৃষকদের দিয়ে আখ চাষ করানো হয়। সেই আখ থেকে প্রথমে তৈরি হয় চিনি। তা বাজারজাত করে চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন। কেরু গত বছর ৪ হাজার ৩২ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন করেছে। কিন্তু ২ হাজার মেট্রিক টন চিনি এখনো বিক্রি হয়নি। এখানকার কর্মকর্তারা একে বলছেন ‘সরকারের আপৎকালীন মজুত’। এই মজুত না থাকলে নাকি বেসরকারি চিনি কোম্পানিগুলোর দাম বাড়ানোর সিন্ডিকেটকে মোকাবিলা করা যায় না। এই ‘মিঠা অস্ত্রের’ উৎপাদন কেবল বিক্রির জন্য নয়, চিনির বাজার স্থিতিশীল রাখার জন্যও—গর্ব করে বললেন কর্মকর্তারা। ফলে লাভ-লোকসানের সমীকরণ, বাজারের বেসরকারি প্রতিযোগীদের অবস্থা-সামর্থ্য নিয়ে জানা-বোঝার বিষয়ে তাঁদের উদাসীনতা অনুমেয়।
কেরুর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ বি এম আরশাদ হোসেন জানালেন, তাঁদের জমিতে এবার ৩০ হাজার টন আখ উৎপাদিত হবে, যা থেকে ২ হাজার টন চিনি তৈরি হবে। তবে কেরু তার সমিতির বাইরের কৃষকদের কাছ থেকেও আখ কেনে চিনি উৎপাদনের জন্য।

কেরু অ্যান্ড কোম্পানি সম্পর্কে যাঁরা মোটামুটি জানেন, তাঁরা এতক্ষণে কিছুটা অধৈর্য হয়েছেন নিশ্চয়! সাধারণ্যে কেরুর বড় পরিচয় এর ডিস্টিলারির জন্য, যেখানে দেশি মদের পাশাপাশি নয়টি ব্র্যান্ডের বিদেশি মদ বা ‘ফরেন লিকার’ তৈরি হয়। এসবের কাঁচামালও কিন্তু আখ। আখ থেকে চিনি বের করে নেওয়ার পর তিনটি উপজাত থাকে। মোলাসেস বা চিটাগুড়, ব্যাগাস বা ছোবড়া, প্রেসমাড বা গাদ। মোলাসেসই লিকার উৎপাদনের মূল উপকরণ। কেরুর প্রাঙ্গণে ঢুকলে মোলাসেসের উৎকট গন্ধ নাকে নিদারুণ অস্বস্তি তৈরি করে।

লিকার তৈরির জন্য এই মোলাসেসকে বিশাল বিশাল ট্যাংকে ভরা হয়। তাতে দেওয়া হয় নির্দিষ্ট পরিমাণ ইস্ট। এই ইস্ট একধরনের অণুজীব, যা অ্যালকোহল তৈরির উপযোগী। ইস্ট মেশানোর পর মোলাসেসকে ৭২ ঘণ্টা ফারমেন্টেশনের জন্য রাখা হয়। এই প্রক্রিয়ায় এতে অ্যালকোহল তৈরি হতে থাকে। এরপর সেটাকে তাপ দিয়ে ভেপার বা বাষ্প তৈরি করা হয়। সে বাষ্পকে ঠান্ডা করে তরলে রূপ দেওয়া হয়। এই তরলটাই পরিশুদ্ধ বা পিউরিফায়েড অ্যালকোহল। সেখান থেকে যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কান্ট্রি স্পিরিট, রেক্টিফায়েড স্পিরিট, এক্সট্রা নিউট্রাল অ্যালকোহল (ইএনএ), ডিনেচার্ড স্পিরিট, অ্যাবসলিউট অ্যালকোহল তৈরি হয়। এর গ্যাসীয় রূপ ইথানল।

এক্সট্রা নিউট্রাল অ্যালকোহল উচ্চমানসম্পন্ন। এ থেকেই তৈরি হয় কেরুর ইয়েলো লেভেল মল্টেড হুইস্কি ও গোল্ড রিবন জিন। আর রেক্টিফায়েড স্পিরিট থেকে তৈরি হয় ফাইন ব্র্যান্ডি, চেরি ব্র্যান্ডি, ইমপেরিয়াল হুইস্কি, অরেঞ্জ ক্রেকাউট আর জরিনা ভদকা। কেরুর রোজা রাম ও ওল্ড রাম তৈরি হয় কান্ট্রি স্পিরিট দিয়ে। এ নয়টি ব্র্যান্ড কেরুর ‘ফরেন লিকার’ হিসেবে পরিচিত।
১৮০, ৩৭৫ ও ৭৫০ মিলিলিটারের বোতলে এগুলো বাজারজাত করা হয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও দর্শনায় কেরুর নিজস্ব দোকান থেকে লাইসেন্সধারীরা তা কিনতে পারেন। বছরে আনুমানিক ৩৯ লাখ ২০ হাজার বোতল (১ লাখ ৪০ হাজার কেইস) ফরেন লিকার উৎপাদন করে কেরু। আর বছরজুড়ে বাংলা মদ উৎপাদন করা হয় ২৬ লাখ লিটার। সারা দেশের ১৩টি সেন্টার থেকে তা বিক্রি হয়।
চিটাগুড় থেকে তৈরি অবসলিউট অ্যালকোহল উড়োজাহাজ পরিষ্কার এবং বিজ্ঞানাগারে ব্যবহৃত হয়। রেক্টিফায়েড থেকে হয় হোমিও-গ্রেন্ড স্পিরিট, যা হোমিও ওষুধের অন্যতম উপাদান। আর তৈরি করা হয় ডিনেচার্ড স্পিরিট। এটা আসবাব বার্নিশের কাজে ব্যবহার করা হয়। মানে কাঠের শ্রীবর্ধনেও আখের অবদান আছে।
চিটাগুড় থেকে স্পিরিট তৈরির পর যে উচ্ছিষ্ট পানি থেকে যায়, তাকে বলে স্পেন্ট ওয়াশ। এর সঙ্গে প্রেসমার্ড বা আখের গাদ আর কিছু অণুজীব মিলিয়ে তৈরি করা হয় জৈব সার। ২০১৪ সাল থেকে আকন্দবাড়িয়া কৃষি খামারে কেরুজ জৈব সার নামে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হয়েছে। ৭ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদন সক্ষমতা নিয়ে অচিরেই এটা আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করবে। দুই বছর ধরে কেরু তার জৈব সার নিজেদের আখখেতে ব্যবহার করছে। এতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। পূর্ণ উৎপাদন শুরু হলে এ সারের বাণিজ্যিক বিপণন করা হবে। ইতিমধ্যে তারা বাণিজ্যিক বিপণনের অনুমতিও পেয়েছে। প্রতি কেজি সারের দাম হবে ১০ টাকা।
আখের উপজাত থেকে দুই ধরনের ভিনেগারও উৎপাদন করে কেরু। মল্টেড ভিনেগার ও সাদা ভিনেগার। মল্টেড ভিনেগারে অন্য উপকরণের সঙ্গে চিটাগুড় ব্যবহৃত হয় সামান্য। তবে সাদা ভিনেগারে চিটাগুড় দেওয়া হয় না।

এই আখ নিয়ে এত যে যজ্ঞ, এত যে মেশিনপত্র—এগুলো চলে কীভাবে? সেখানেও আছে আখের অবদান। চিনি উৎপাদনের পর যে ছোবড়া থেকে যায়, তা-ই কেরুর বয়লারের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ছোবড়ার সংকট হলে কিছুমাত্রায় ফার্নেস অয়েলও ব্যবহার করা হয়।

কেরু অ্যান্ড কোম্পানির আরও সম্ভাবনা দেখেন কর্মকর্তারা। এখন এর চিনি উৎপাদন ক্ষমতা আছে ১১ হাজার মেট্রিক টন, গত বছর উৎপাদিত হয়েছে ৪ হাজার মেট্রিক টন। গত বছর ভিনেগার উৎপাদিত হয়েছে ২০ হাজার মেট্রিক টন, এবার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৪০ হাজার মেট্রিক টন। কেরুর লিকার উৎপাদনের যে ক্ষমতা আছে, তার মাত্র ৩৩ শতাংশ সক্ষমতা এখন ব্যবহৃত হয়।

দেশে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ১৫টি চিনিকল আছে। এর মধ্যে ১৪টি লোকসান গুনছে। একমাত্র কেরু অ্যান্ড কোম্পানি লাভজনক। কারণ সহজ; একমাত্র ডিস্টিলারি ইউনিটই একে বছরের পর বছর লাভের মুখ দেখিয়ে যাচ্ছে। পাঁচ বছর ধরে টানা ৬০ কোটি টাকা করে লাভ করছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রায় সমপরিমাণ অর্থ শুল্ক হিসেবে দিচ্ছে।

কেরুর গল্প বলছে, চিনির উৎপাদনের পর আখের উপজাতকে কাজে লাগাতে পারলে কারখানা লাভজনক হতে পারে। অর্থাৎ পণ্যের বহুমুখীকরণেরই (ডাইভারসিফিকেশন) মুক্তি। এই উদাহরণ সামনে থাকার পরও অন্য চিনিকলগুলোর লোকসানি অবস্থার পরিবর্তন করা যাচ্ছে না কেন?

জবাবে চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এ কে এম দেলোয়ার হোসেন বললেন, সে চেষ্টা তাঁরা করছেন। ইতিমধ্যে নর্থ বেঙ্গল চিনিকল আর ঠাকুরগাঁও চিনিকলে ডিস্টিলারি স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে তা করা হচ্ছে। তবে বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকেও প্রস্তাব আছে, তারা এই ডিস্টিলারিতে যুক্ত হতে চায় এবং উৎপাদিত সব লিকার কিনে নিজ দেশে নিয়ে যেতে চায়।

দেলোয়ার হোসেন জানান, চিনিকলগুলোর চিটাগুড় দিয়ে তাঁরা আরও জৈব সার এবং ভবিষ্যতে বায়োগ্যাসও উৎপাদনের কথা ভাবছেন।

এই পুরো গল্পের মর্মার্থ বোধ হয় এমন—ভাবনার সময় কমিয়ে দ্রুত কাজে নামতে পারলেই আরও দু-একটি চিনিকল হয়তো ‘লাভের গুড়’ দেখতে পাবে। না হলে লোকসানের তেতো গিলতে হবে বাকি জীবন।

পরের সংখ্যায় পড়ুন: চুয়াডাঙ্গায় মাশরাফি, তাসকিন