১৯৭১ সালের ২০ মে। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। ওই দিন সকাল থেকে শস্য খেতে কাজ করছিলেন মালতিয়া গ্রামের চেকন মোড়ল। বেলা ১১টা নাগাদ পাকিস্তানি সেনাদের একটি জিপ গ্রামের দিকে আসে। সেনারা এসে চেকনের সঙ্গে কথা বলতে থাকে।
বাড়ির ভেতর থেকে দৃশ্যটা দেখছিলেন চেকন মোড়লের ছেলে এরশাদ আলী মোড়ল। ৪৬ বছর পর স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘বাবার হাতে কাঁচি (কাস্তে) ছিল। কথা বলার একপর্যায়ে বাবাকে গুলি করে পাকিস্তানি সেনারা। ভয়ে আমিসহ আশপাশের লোকজন দৌড়ে পালিয়ে যাই। দূর থেকে ভীষণ গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাই। ঘণ্টা চারেক পর শব্দ থেমে যায়। কিছুক্ষণ পর বাড়ি ফিরে দেখি, বাবার লাশ নিয়ে বসে আছেন মা।’
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এরশাদ আলী মোড়ল দেখেন, লাশের স্তূপ পড়ে আছে এলাকাজুড়ে।
গত সপ্তাহে চুকনগরে গণহত্যা স্মৃতিস্তম্ভের পাদদেশে বসে সেদিনের কথা বলছিলেন ৭৫ বছর বয়সী এরশাদ আলী। এখানে প্রথম শহীদ হয়েছিলেন তাঁর বাবা।
খুলনা শহর থেকে ৩২ কিলোমিটার পশ্চিমে ভারত সীমান্তবর্তী ভদ্রা নদীর তীরবর্তী একটি অঞ্চল চুকনগর। জায়গাটা পড়েছে ডুমুরিয়া উপজেলার আটলিয়া ইউনিয়নে।
ওই দিনের নরহত্যার বিবরণ দিতে গিয়ে এরশাদ বলেন, ‘মাঠে গিয়ে দেখি, সদ্য বুলেটবিদ্ধ অসংখ্য লাশ থেকে তখন বয়ে চলেছে রক্তের স্রোত। মানুষের রক্তে লাল হয়ে উঠেছে ঘ্যাংরাইল নদের পানি। হঠাৎ চোখ আটকে যায় আট-নয় মাস বয়সী একটি ফুটফুটে শিশুর দিকে। মেয়েশিশু, গায়ে রক্তমাখা। গুলিতে মারা যাওয়া মায়ের দুধ পানের প্রাণপণ চেষ্টা করছিল শিশুটি। বাবার মৃত্যুশোক ভুলে কোলে তুলে নেই মেয়েটিকে।’
পরে মান্দার দাস নামে এলাকার এক নিঃসন্তান নারী ওই শিশুটিকে মানুষ করার দায়িত্ব নেন।
স্থানীয় মানুষ ও অন্তত তিনজন প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচার, নির্যাতন ও লুণ্ঠন সহ্য করতে না পেরে বাগেরহাট, রামপাল, মোরেলগঞ্জ, কচুয়া, শরণখোলা, মোংলা, খুলনার দাকোপ, বটিয়াঘাটা, চালনা, ফরিদপুর, বরিশালসহ বিভিন্ন অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ ভারতের উদ্দেশে রওনা হয়। ১৮ ও ১৯ মে দুই দিনে নৌকায় করে ভদ্রা নদী ও ঘ্যাংরাইল নদ দিয়ে চুকনগর বাজার এবং এর আশপাশ এলাকায় জড়ো হন তাঁরা। উদ্দেশ্য, ভারতে পৌঁছানো। চুকনগর এলাকাকে তখন ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করত লোকজন।
২০ মে সকালে ভারতের পথে রওনা দিয়েছিলেন অনেকে। অনেকে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। বেলা ১১টার দিকে হঠাৎ সাতক্ষীরা-খুলনা সড়ক ধরে ১৪-১৫ জন পাকিস্তানি সেনা একটি ট্রাক ও একটি খোলা জিপে করে এসে থামে চুকনগর বাজারের পশ্চিম পাশে ঝাউতলায়। সামনে পাতখোলা মাঠ তখনো লোকে লোকারণ্য।
আচমকা শুরু হলো গুলিবর্ষণ। রক্তে ভেসে যায় পাতখোলা মাঠ।
অন্য ট্রাকটি চুকনগর বাজারের দিকে যায়। সেখানেও চলে ব্রাশফায়ার। রক্তে ভিজে ওঠে চুকনগর মন্দির প্রাঙ্গণ ও আশপাশ এলাকা। ভদ্রা নদীতে অবস্থান করছিলেন অনেক মানুষ, তাঁরাও রেহাই পাননি তপ্ত বুলেট থেকে। বেলা তিনটা পর্যন্ত চলে এই হত্যাযজ্ঞ।
ফজলুর রহমান মোড়লের বয়স তখন ১৪-১৫ বছর। গোলাগুলির মধ্যে তিনিও পড়েছিলেন। পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণে রক্ষা পান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ঘ্যাংরাইল ও ভদ্রা নদীর জোয়ারে ভেসে যায় অসংখ্য লাশ। ঘটনার দিন থেকে পরের ছয়-সাত দিন স্থানীয় কয়েকজন পড়ে থাকা লাশ জোয়ারের সময় পানিতে নামিয়ে রাখতেন। ভাটার সময় নদীতে লাশগুলো একসঙ্গে গেঁথে দূরে গাছে বেঁধে রাখতেন, যাতে জোয়ারে আবার ফিরে না আসে। অনেক লাশ নদীর আরও দূরে ঠেলে দিতেন।
কতজন নিহত হয়েছিলেন এই হত্যাকাণ্ডে? ফজলুর রহমান মোড়লের অনুমান, ১০-১২ হাজারের কম হবে না।
সেদিনের এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের আরেক প্রত্যক্ষদর্শী শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘১০ হাজারের বেশি মানুষকে একসঙ্গে এক দিনে হত্যা করা হয়েছিল। রায়বাড়ির একটি পুকুরেই তিন-চার শ মানুষের লাশ দেখেছি। এখানকার গণহত্যা বাংলাদেশের বৃহৎ এবং জঘন্যতম। বিশ্বের কোথাও এমন নিষ্ঠুরতার নজির মেলে না। অথচ মুক্তিযুদ্ধের দলিলে চুকনগর গণহত্যার কথা উল্লেখই নেই।’
শফিকুল ইসলাম চুকনগর গণহত্যা ’৭১ স্মৃতি রক্ষা পরিষদের সভাপতি ও চুকনগর কলেজের অধ্যক্ষ।
ওই ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে একটি স্মৃতিস্তম্ভ। তবে সেটা অনেকটাই অবহেলিত। বধ্যভূমিতে একটি পূর্ণাঙ্গ স্মৃতিসৌধ কমপ্লেক্স নির্মাণ করা আজও সম্ভব হয়নি।
স্থানীয় লোকজন এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্মৃতিসৌধ কমপ্লেক্স নির্মাণে ২০০৪ সালে মালতিয়া গ্রামে ৭৮ শতাংশ জমি কেনে সরকার। এই জমির মধ্যে প্রায় ৯৩০ বর্গমিটার জায়গার ওপর ২০০৫ সালে মাত্র সাত লাখ টাকা ব্যয়ে একটি সৌধ নির্মাণ করা হয়। তবে এটা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আজ পর্যন্ত স্থায়ীভাবে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। সীমানাপ্রাচীরের বড় একটা অংশ ভেঙে পড়েছে।