চোখ খোলা রাখছে বাংলাদেশ

বাংলাদেশকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে সব পক্ষকে আস্থায় রেখে দেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে কৌশল ঠিক করার তাগিদ।

মিয়ানমারের সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ চারটি দেশের সঙ্গে মিয়ানমারের পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশের আলোচনা হয়েছে। বিভিন্ন পর্যায়ের এসব আলোচনায় মিয়ানমার প্রশ্নে দেশগুলোর অবস্থান জানা–বোঝার চেষ্টা করেছে বাংলাদেশ। এসব আলোচনায় আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে মিয়ানমারের শান্তি ও নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে।

ঢাকার কূটনৈতিক সূত্রগুলো গত সোমবার ও গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে জানিয়েছে, গত দুই দিনে রাজধানীতে জ্যেষ্ঠ কূটনৈতিক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, নেদারল্যান্ডস ও সুইডেনের সঙ্গে বাংলাদেশের আলাদা বৈঠক হয়েছে। মিয়ানমারের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সতর্কতার সঙ্গে এগুতে চায়।

মিয়ানমারের সেনা অভুত্থান নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তাঁর বিবৃতিতে দেশটির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন। আবার চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সেনা অভুত্থান নিয়ে নমনীয় প্রতিক্রিয়া দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন মিয়ানমারে যাই ঘটুক না কেন, বরাবরের মতোই দেশটির পাশে থাকবে বেইজিং।

জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান ইনষ্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গর্ভানেন্সের (এসআইপিজি) জ্যেষ্ঠ ফেলো মো. শহীদুল হক গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, মিয়ানমারের ক্ষমতার পালাবদলের পর বড় শক্তিগুলোর অবস্থান মূল্যায়ন করলে দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র আর চীনের অবস্থান অনেকটাই ষ্পষ্ট। বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধান করাটা জরুরি। আবার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সমুন্নত রাখার বিষয়েও বাংলাদেশকে সচেষ্ট থাকতে হবে। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে সব পক্ষকে আস্থায় নিয়ে নিজেদের স্বার্থে কৌশল ঠিক করতে হবে।

কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মতে, মিয়ানমারে ক্ষমতার পালাবদলের দুই দিনের মাথায় বড় শক্তিগুলোর মেরুকরণের বিষয়টি কিছুটা ষ্পষ্ট হয়ে আসছে। এই পরিস্থিতিতে, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের প্রেক্ষাপটে মিয়ানমারের বিষয়ে বাংলাদেশকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। তাদের মতে, বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গা সমস্যার দ্রুত সমাধান জরুরি। আবার গণতন্ত্র, আইনের শাসনের প্রতিও বাংলাদেশ শ্রদ্ধাশীল। তাই রোহিঙ্গা সংকটের সমস্যার সমাধান করার সময় যাতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি বাংলাদেশের অবস্থান অটুট থাকে সে ব্যাপারেও সচেষ্ট থাকতে হবে।

মিয়ানমারের নতুন সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে তাঁর দপ্তরে সাংবাদিকদের বলেন, এই মুহূর্তে তারা (মিয়ানমার) যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ঘোষণা দিয়েছে, সেখানে ১১ জন মন্ত্রীর কথা শোনা গেছে। নতুন মন্ত্রীরা কাজ শুরু করলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা দেখছে না ঢাকা। মিয়ানমারে বেশিরভাগ সময়ে এ ধরনের সরকার ছিল। তার জন্য সম্পর্ক বন্ধ রাখার কোনো কারণ নেই। তবে এখন পর্যন্ত নতুন সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ হয়নি বলে তিনি জানান।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে চীনের মধ্যস্থতায় বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের ভার্চুয়াল আলোচনার কথা রয়েছে। এই বৈঠক পিছিয়ে গেছে কি না জানতে চাইলে পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘আমরা আগামীকাল (বুধবার) পর্যন্ত অপেক্ষা করি। আমরা গতকালকেই বলেছি তৈরি আছি এবং যে-ই ক্ষমতায় আসুক তাদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে চাই।’

বাংলাদেশকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে সব পক্ষকে আস্থায় নিয়ে নিজেদের স্বার্থে কৌশল ঠিক করতে হবে।
মো. শহীদুল হক, সাবেক পররাষ্ট্রসচিব

পরিবর্তনের বার্তা এসেছিল ইয়াঙ্গুন থেকে

মিয়ানমারে গত সোমবারের সেনা অভুত্থান সম্পর্কে ইয়াংগুনের কূটনৈতিক মিশনগুলো মাসখানেক আগে থেকেই টের পাচ্ছিল। সেখানকার একাধিক মিশনের সূত্রে জানা গেছে, ফেব্রুয়ারির ১ তারিখ পার্লামেন্ট সদস্যদের শপথ গ্রহণের আগে সেনা অভুত্থান, অসাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা দখলের বিষয়ে ধারণা পাওয়া যাচ্ছিল। হঠাৎ করে সেনাবাহিনী তাদের কার্যকলাপে সবাইকে বিভ্রান্ত করে এমন ধারণা দিতে থাকে যে শেষ পর্যন্ত এমন কিছু ঘটছে না। ফলে সেনাবাহিনীর ওই বিভ্রান্তির ফাঁদে পড়ে বিভিন্ন মিশনও। যদিও পার্লামেন্ট সদস্যদের শপথ গ্রহণের দিনই সেখানে সেনা অভ্যুত্থান হয়েছে।

কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের নভেম্বরের নির্বাচনের পর থেকে সেনা সমর্থিত এবং মিয়ানমারের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও সেনা প্রধান জেনারেল থেইন সেইনের দল ইউনিয়ন সলিডারিটি এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি) ভোটার তালিকায় অনিয়ম, কারচুপি নিয়ে অভিযোগ করে আসছিল। সেনাবাহিনীর চাপে ইউএসডিপি এক পর্যায়ে থেমে যায়। সেনা প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লায়েং ২০২১ সালের জুনে দায়িত্বের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তা বাড়ানোর জন্য সু চির সঙ্গে দরকষাকষি করছিলেন। এমনকি সেনা অভুত্থানের কয়েক ঘন্টা আগেও দুই পক্ষ একটা আপোষ রফার চেষ্টা করেছিল বলে জানা যায়। শেষ পর্যন্ত দুই পক্ষের মধ্যে মতবিরোধ দূর না হওয়ায় সেনাবাহিনী এনএলডিকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়।

শরণার্থী বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি এন্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইনষ্টিটিউটের (আরএমএমআরইউ) প্রধান নির্বাহী অধ্যাপক সি আর আবরার গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে অং সান সু চির সঙ্গে সেনাবাহিনীর অবস্থান একেবারে অভিন্ন। দুই পক্ষই রোহিঙ্গাদের প্রতি অমানবিক আচরণকে সমর্থন করে। অতীতের ধারাবাহিকতায় চীন এখনো মিয়ানমারের পাশে আছে। এই পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চীনকে জোরালো অনুরোধ জানানো উচিত বাংলাদেশের। কারণ বাংলাদেশে বিপুল বিনিয়োগ আর ব্যবসার মধ্য দিয়ে চীন যে উপকৃত হচ্ছে, প্রতিদানে তো দেশটির এ সমস্যা সমাধানে বিশেষ ভূমিকা রাখা উচিত।