
ভারত থেকে চোরাচালানে আসা গরু সীমান্ত পার হওয়ার পরই হয়ে যায় ‘কুড়িয়ে পাওয়া গরু’। সরকারিভাবে দেশের বিভিন্ন সীমান্তে অনেকগুলো করিডর করে দেওয়া হয়েছে। এসব করিডর দিয়ে চোরাচালানের গরু এনে জড়ো করা হয় ‘খাটালে’।
আট-দশ হাজার গরু রাখার জন্য সরকারিভাবে তৈরি একটি বিশেষ জায়গাকে স্থানীয়ভাবে খাটাল বলে। খাটালের চারপাশে ঘেরা নেই। তবে ওপরে টিনের ছাউনি দেওয়া।
ব্যাপারিরা তাঁদের গরু খাটালে এনে ‘সীমান্তে কুড়িয়ে পাওয়া হিসেবে’ উল্লেখ করে ১৯৫৪ সালের কাস্টম ও ট্যাক্স আইন অনুযায়ী নিলামে কেনার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তারপর সাজানো নিলামে প্রতি গরুর জন্য ৫০০ টাকা করে পরিশোধ করে বৈধ মালিকানা লাভ করেন।
তবে এর আড়ালে চলে করিডরগুলোর দখলদারদের চাঁদাবাজি। স্থানীয়ভাবে এসব করিডরকে ঘাট বলা হয়। যশোরের শার্শা উপজেলার সীমান্তবর্তী ইছামতী নদীতীরের পুটখালী ও এর আশপাশের ঘাটগুলোতে সরেজমিন অনুসন্ধান করে জানা গেছে, ঘাটগুলো দিয়ে প্রকাশ্যে গরু আনা হলেও গোপনে আনা হয় ফেনসিডিল, ইয়াবা, হেরোইনের মতো মাদক থেকে শুরু করে শাড়ি, থ্রিপিস, চকলেট, চোরাই মোটরসাইকেল, মোটর পার্টস, সোনা, আগ্নেয়াস্ত্র, বিস্ফোরক দ্রব্যসহ ভারতীয় অনেক পণ্য। পাচার হয়ে ভারতে যায় নারী-শিশু, সোনা, ডলারসহ বৈদেশিক মুদ্রা, এসির গ্যাস, তামা, পিতল-কাঁসা, ইলিশ মাছ, মাছের পোনা, ডিজেল-পেট্রলের বড় বড় চালান।
২৩ বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ব্যাটালিয়ন গত জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত যশোর জেলার শার্শা উপজেলার কায়বা থেকে দৌলতপুর বিওপি পর্যন্ত ৩১ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকা থেকে ২০৮ কোটি ৯৩ লাখ ২৬৯ টাকা মূল্যের অবৈধ মালামাল আটক করেছে, যার মধ্যে ১৫ হাজার ১৪২ বোতল ফেনসিডিল, চার হাজার ৪৪৭ বোতল বিভিন্ন প্রকার মদ, ৫৩ হাজার ৩০০টি যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট, ৬০০ গ্রাম গাঁজা, তিন কেজি ৮০০ গ্রাম হেরোইন রয়েছে।
যশোর সীমান্তের অন্য একটি অংশের দায়িত্বে নিয়োজিত ২৬ বিজিবি ব্যাটালিয়ন জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ১১৪ কোটি ২২ লাখ ৮২ হাজার ৭৮৭ টাকার অবৈধ পণ্য আটক করেছে, যার মধ্যে ৩৮ হাজার ৭৫৮ বোতল ফেনসিডিল, ৯৯ কেজি ৭৫০ গ্রাম গাঁজা, ছয় কেজি ৯১৯ গ্রাম হেরোইন রয়েছে।
ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রণ: যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, সে দলের লোকজন ঘাটগুলো পরিচালনা করেন। তাঁদের নিয়ন্ত্রণে ডাকা হয় নিলাম। অঘোষিত এ নিলামের রীতিনীতি তাঁরাই ঠিক করে নেন। অবৈধ ও গোপন নিলাম জিতে ঘাটের ইজারা আদায়ের অধিকার পান যাঁরা, স্থানীয়ভাবে তাঁদের ঘাটমালিক বলে ডাকা হয়। চোরাই ঘাটের মালিকানা ও কমিশন ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে খুনোখুনির ঘটনাও ঘটছে।
স্থানীয় সরকারদলীয় সাংসদ শেখ আফিল উদ্দিনের তত্ত্বাবধানে শার্শা উপজেলার চোরাচালানের এ ঘাটগুলো নিলাম হয় বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তাঁর ঘনিষ্ঠ একটি সূত্রে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, সর্বশেষ গত জুন মাসে এ নিলাম হয়। অবশ্য ঘাট নিলাম সম্পর্কে জানতে চাইলে যশোর-১ (শার্শা) আসনের ওই সাংসদ বলেন, নিলাম হবে কেন? ঘাটগুলোতে যেন অপ্রীতিকর কিছু না ঘটে, সে জন্য কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা কেউ কোথাও চাঁদাবাজি করছে, এমন অভিযোগের প্রমাণ মেলেনি।
২৩ বিজিবি ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল তায়েফ উল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিলাম হয় কি না, জানি না। আমরা বিভিন্ন সময় ঘাটের দখলদার বদলে যাওয়ার খবর পেয়ে থাকি। তবে এ ব্যাপারে করণীয় কিছু থাকে না।’ তিনি চোরাচালানের সঙ্গে বিজিবির জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তার পরও কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, এ ঘাটগুলো দিয়ে গত জুনে এক লাখ সাড়ে পাঁচ হাজার গরু এসেছে এবং এ থেকে সরকারের প্রায় পৌনে ছয় কোটি টাকা আয় হয়েছে। এটা এখন স্বীকৃত। তবে গোপনে আনা অন্য সব চোরাচালান পণ্য আটকে জওয়ানেরা যাতে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন, সে জন্য নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
ঘাটমালিকের কথা: বর্তমানে পুটখালী ঘাটের কথিত মালিক ফকির আহম্মেদ ও রেজাউল ইসলাম ওরফে রেজার নেতৃত্বাধীন ২০ জনের একটি সিন্ডিকেট। এই দুজনের মধ্যে ফকির যুবলীগের নেতা নজরুল ইসলাম ওরফে বাবু হত্যা এবং রেজা যুবদলের নেতা আবদুল খালেক হত্যা মামলার আসামি। তাঁদের অংশীদার বাকি ১৮ জনেরও প্রত্যেকের নামে একাধিক মামলা রয়েছে। এর আগে দুই দফা এই ঘাট চালিয়েছেন রাজ্জাক ও খালেক হত্যা মামলায় অভিযুক্ত সিরাজুল ইসলাম ওরফে কিলার সিরাজ ও তাঁর বাহিনীর ক্যাডাররা। কিলার সিরাজের সঙ্গে তখন রেজাও যুক্ত ছিলেন। মাঝে কিছুদিন ঘাট নিয়ন্ত্রণ করেছেন নজরুল ইসলাম ওরফে বাবু হত্যা মামলায় অভিযুক্ত সলেমান বিশ্বাস, মুজিবর ও জাকির বিশ্বাস। তখন তাঁদের সঙ্গে ছিলেন ফকির আহম্মেদ। ঘাট নিয়ন্ত্রকদের মধ্যে নিহত ইউপি চেয়ারম্যান রাজ্জাকও ছিলেন। তাঁদের নিয়ে স্থানীয় সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে। খুনোখুনিতে জড়িত অভিযোগে মামলাও হয়েছে।
কুড়িয়ে পাওয়া গরু: সম্প্রতি পুটখালী ঘাটে সরেজমিনে দেখা গেছে, ঘাটের খাটালে বাঁধা রয়েছে কয়েক হাজার ভারতীয় গরু। দুটি কক্ষের সামনে লম্বা লাইন। এক লাইনে গরুর বেপারিরা, অন্য লাইনে ট্রাকের চালকেরা। ট্রাকপ্রতি বেপারিদের কাছ থেকে তিন হাজার দুই টাকা আর চালকদের কাছ থেকে দুই হাজার ৫০ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে বলে বেপারিরা জানালেন। তাঁদের অভিযোগ, লাইনে দাঁড়ানোর আগেই তাঁদের গরুপ্রতি এক হাজার টাকা পরিশোধ করে আসতে হয়।
খুনের বদলে খুন: নিলামে জিতলেই চলে না। মালিকানা ধরে রাখার জন্য রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয় কথিত ঘাটমালিকদের। খুনোখুনির ঘটনাও ঘটে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের ১৫ জুন রাতে ঘাটের দখল নিয়ে দ্বন্দ্বে প্রথম আলোচিত খুনের ঘটনাটি ঘটে। ওই রাতে প্রতিপক্ষের গুলি ও বোমা হামলায় নিহত হন পুটখালী গ্রামের যুবলীগের নেতা চোরাচালান ঘাটমালিক নজরুল ইসলাম ওরফে বাবু। জানা যায়, পুটখালী ঘাটের মালিক নজরুল ইসলাম ওরফে বাবুকে সিন্ডিকেট থেকে উচ্ছেদের চেষ্টায় খুন করা হয়। এরই মধ্যে গত ২৯ জুলাই পুটখালী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবদুর রাজ্জাক খুন হয়েছেন। পুটখালী চোরাচালান ঘাটের হিস্যা আদায় নিয়ে সিরাজ ও গাফ্ফার গংয়ের সঙ্গে ঘাটের মালিকানার বিরোধের কারণে খুন হন তিনি। চেয়ারম্যান রাজ্জাক নিজেও সন্ত্রাসী লালন-পালন করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। রাজ্জাকের বদিয়ার বাহিনী, কামরুল বাহিনী, কালু বাহিনী, মিজান বাহিনী এলাকায় পরিচিত। বিগত বিএনপি সরকারের আমলে এই আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে অবৈধ অস্ত্রসহ আটক হয়েছিলেন তিনি। যুবলীগের নেতা নজরুল হত্যার পর এবং ইউপি চেয়ারম্যান রাজ্জাক খুন হওয়ার আগে চোরাচালান নিয়ে বিরোধের ফলে পুটখালী যুবদলের নেতা আবদুল খালেক, বাহাদুরপুর ইউনিয়নের যুবলীগের নেতা শত্তকত আলী, বাগআঁচড়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম ওরফে বাবু, নিজামপুর গ্রামের আওয়ামী লীগের নেতা বদিয়ার রহমানের কলেজ পড়ুয়া ছেলে মেহেদী হাসান ওরফে শিমুল, লক্ষ্মণপুর ইউনিয়ন যুবদলের সাবেক সভাপতি সলেমান আলী, যুবলীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক কামরুজ্জামান রতন, বাগআঁচড়া এলাকার যুবলীগের নেতা মজলুর হক, লক্ষ্মণপুর ইউনিয়ন যুবদলের নেতা আবদুল হামিদ, ধান্যখোলা গ্রামের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম, বলিদাহ গ্রামের বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক কোরবান আলী খুন হয়েছেন। এর মধ্যে লক্ষ্মণপুর ইউনিয়ন যুবদলের নেতা আবদুল হামিদ নিহত হওয়ার ঘটনাটি নিয়ে তোলপাড় হয়েছে সবচেয়ে বেশি।
হামিদ খুন হওয়ার জের ধরে যশোর-১ (শার্শা) আসনের আওয়ামী লীগের দলীয় সাংসদ শেখ আফিল উদ্দিনের বিরুদ্ধে শার্শা থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এনামুল হক ও এসআই আসাদসহ ছয় পুলিশকে ডেকে এনে মারধর করার অভিযোগ উঠেছিল। ২০১০ সালের ১৫ আগস্টের ঘটনা এটি। এ ঘটনায় ওসি এনামুল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করেছিলেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে আফিল উদ্দিন অবশ্য ঘটনাটিকে সাংবাদমাধ্যমের অপপ্রচার বলে উড়িয়ে দেন। পুরোনো ঘটনা টানা হচ্ছে কেন, জানতে চেয়ে তিনি বলেন, ‘তখনো আমি বলেছিলাম, বিএনপির এক সন্ত্রাসী খুন হওয়ার পর ওসি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নিরীহ নেতা-কর্মীদের নামে মামলা রেকর্ড করেছিলেন। ওই এলাকার আওয়ামী লীগের নেতারা এসে বিষয়টি জানানোর পর আমি ওসিকে ডেকে এর কারণ জানতে চেয়েছিলাম মাত্র।’ কিন্তু ওই ঘটনার পর ওসি একটি জিডিতে তাঁর বিরুদ্ধে মারধর করার অভিযোগ এনেছিলেন—এ কথা স্মরণ করিয়ে দিলে আফিল বলেন, ‘ওসি কিন্তু ওই ভুলের জন্য আমার কাছে ক্ষমাও চেয়েছিলেন, যা স্থানীয় পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।’
সীমান্তের এসব হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জানতে চাইলে যশোরের পুলিশ সুপার জয়দেব ভদ্র বলেন, নজরুল ইসলাম বাবু হত্যাসহ আরও কিছু ঘটনা তিনি দায়িত্ব নেওয়ার আগেই ঘটেছে বলে এগুলো সম্পর্কে তাঁর ভালো জানা নেই। তিনি জানান, খালেক হত্যা মামলার প্রধান আসামি আওয়ামী লীগের নেতা সিরাজুল ইসলাম ঘটনার সময় দেশে ছিলেন না বলে দাবি করেছেন এবং দুই দেশের ইমিগ্রেশনের সিল-স্বাক্ষরযুক্ত পাসপোর্টও দেখিয়েছেন, সে জন্য চূড়ান্ত অভিযোগপত্র থেকে তাঁর নাম বাদ দিতে হয়েছে। চেয়ারম্যান রাজ্জাক হত্যা মামলার মূল আসামিরা ভারতে পলাতক রয়েছে। তবে মামলাটির যাতে সুষ্ঠু তদন্ত হয়, সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে।
আগামীকাল পড়ুন: মাদক বাণিজ্য