
‘কোথায়?’
‘আমি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, মোড়ক উন্মোচন মঞ্চের সামনেই।’
‘ওখানেই দাঁড়া, আমি আসছি।’
মুঠোফোনে কথোপকথন শেষে সিদ্ধেশ্বরী থেকে আসা আশিক ও গেন্ডারিয়া থেকে আসা হাসান—এই দুই বন্ধুর দেখা হয়ে গেল বইমেলার মাঠে। কিছুদিন আগে কানাডা থেকে ফিরেছেন আশিক। পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা করবেন বলে গতকাল বিকেলে এসেছিলেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। এভাবেই দু-তিনজন করে বা ছোট ছোট দলে গ্রন্থানুরাগীরা এসেছেন মেলায়। তাঁদের পদচারণে ছুটির দিনে জমে যায় বইমেলা। যে ভিড়টা বৃহস্পতিবার অনুপস্থিত ছিল, গতকাল শুক্রবার তা যেন দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে ফিরে এল। পাল্টে গেল মেলার ছবি। তুমুল জনস্রোত হারিয়ে দিল সব অনিশ্চয়তা, রাজনৈতিক অস্থিরতা। ছন্দ ফিরে পেল একুশে বইমেলা।

কী ছিল গতকালের বইমেলায়! প্রতিদিন যেমন থাকে, থরে থরে সাজানো বই। পাঠকেরা যদি মেলার প্রাণ হয়, তবে লেখকেরা যেন প্রাণের অক্সিজেন। লেখক এলেই মুহূর্তেই মেলার চেহারা বদলে যায়। যেমন কাল এসেছিলেন ইমদাদুল হক মিলন, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, আনিসুল হকের মতো জনপ্রিয় লেখকেরা। ছিল তরুণ লেখকদের থোকা থোকা আড্ডা।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এসেছিলেন বিকেলে। উৎস প্রকাশন থেকে এসেছে তাঁর দশ খণ্ডে রচনাসমগ্র। সময় প্রকাশন থেকে এসেছে নতুন বই সংকট ও সুযোগ। প্রথমা প্রকাশন থেকে এসেছে স্মৃতি অম্লান ১৯৭১। মেলায় বিভিন্ন স্টল ঘুরে বই কিনলেন অর্থমন্ত্রী।
এদিনও নজরকাড়া ভিড় ছিল প্রথমা প্রকাশনের প্যাভিলিয়নের চারপাশে। অত্যুৎসাহী এক কিশোরী ধৈর্য ধরে লাইনে দাঁড়িয়েছে, কিনেছে আনিসুল হকের ইটি, তুমি কেমন আছ। অপেক্ষা করছে লেখকের অটোগ্রাফের জন্য। নতুন বইয়ে অটোগ্রাফ দিতে দিতে আনিসুল হক বললেন, ‘বৃহস্পতিবার মেলায় রাজনৈতিক উত্তাপ ছিল; কিন্তু দুই প্রধান রাজনৈতিক দলকে ধন্যবাদ কোনো প্রকার সহিংস কর্মসূচি না দেওয়ার জন্য। এ কারণে আমাদের প্রাণের এ মেলা দারুণ জমে উঠেছে।’ অনন্যার প্যাভিলিয়নে পাঠকদের সঙ্গে আলাপে মেতেছিলেন কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন। বললেন, ‘সব শঙ্কা দূর করে মানুষ আসছে, বই কিনছে, আড্ডা দিচ্ছে—এর চেয়ে ভালো দৃশ্য আর কী হতে পারে!’ প্রথমা প্রকাশনের প্যাভিলিয়নে সকাল বিকেল দুবার এসেছিলেন সেলিম জাহান। এই প্রতিষ্ঠান থেকে এসেছে তাঁর লেখা নতুন বই বেলা-অবেলার কথা।

বাংলা একাডেমির তথ্যকেন্দ্রের হিসাবে গতকাল মেলায় এসেছে ৩৪৪টি নতুন বই। ৯ দিনে নতুন বই আসার সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। তবে শুধু যে নিয়মিত লেখকেরা এ মেলায় প্রভাব ফেলছেন তা নয়। যেমন অনন্যা এবার এনেছে নাট্যব্যক্তিত্ব আবুল হায়াতের আত্মজীবনী জীবন খাতার ফুটনোট, সময় প্রকাশন এনেছে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের লেখা সাক্ষাৎকারভিত্তিক বই বেলা অবেলা সারাবেলা। জ্যেষ্ঠ লেখকদের নতুন বই এসেছে বেশ কিছু। বাতিঘরে আলো ছড়াচ্ছে মোহাম্মদ রফিকের কবিতার বই এই স্বপ্ন এই ভোর প্রভাতের আলো। লেখক একে বলছেন ‘আত্মজৈবনিক কাব্যাখ্যান’। অন্যপ্রকাশ এনেছে আহমদ রফিকের প্রবন্ধ জীবনানন্দ কবি, প্রেমিক ও গৃহী, পাঠক সমাবেশ এনেছে হাসনাত আবদুল হাইয়ের গল্পগ্রন্থ একা এবং একসঙ্গে নির্বাচিত আশি। অবসর এনেছে বেগম আকতার কামালের গবেষণাগ্রন্থ নজরুল দৃষ্টি ও সৃষ্টি। প্রথমা এনেছে আল মাসুদ হাসানউজ্জামান সম্পাদিত বাংলাদেশে নির্বাচন।

তরুণ লেখকদের বই দেখা গেল বেশ কিছু। অন্বেষা প্রকাশন এনেছে ইসমাইল সাদীর গবেষণাধর্মী বই সৈয়দ শামসুল হকের কবিতায় প্রেম ও নিসর্গ। উৎস প্রকাশন এনেছে শান্তনু চৌধুরীর সাংবাদিকতাবিষয়ক টেলিভিশন সাংবাদিকতা: সংবাদ ও সম্পাদনা, তাম্রলিপি এনেছে রণজিৎ সরকারের ভাষাশহিদ ও বীরশ্রেষ্ঠদের গল্প, মেঘ এনেছে ফিরোজ এহতেশামের সাধুকথা: ১৩ বাউল-ফকিরের সাথে কথাবার্তা। অ্যাডর্ন পাবলিকেশন এনেছে জহিরুল ইসলামের বাংলাদেশের লোকপ্রিয় খেলাধুলা।
প্রতিদিনই ভিড় জমছে মোড়ক উন্মোচন মঞ্চের সামনে। ভিড় দেখা গেল তাম্রলিপির প্যাভিলিয়নের সামনেও। লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল সেখানে ভক্তদের অটোগ্রাফ দিচ্ছিলেন। এখানে আরেক লেখক গুলতেকিন খানকেও দেখা গেল। একসঙ্গে ১১৩ জন লেখকের ভিড় দেখা গেল মোড়ক উন্মোচন মঞ্চের সামনে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকের গ্রুপ ‘এসএসসি ৯৬ এইচএসসি ৯৮ ’-এর মাধ্যমে ১১৩ জনের গল্প ও কবিতা নিয়ে গতকাল তাম্রলিপি থেকে প্রকাশিত হয়েছে স্বপ্নচূড়া ৯৬৯৮ নামের একটি বই।
আজ শনিবার মেলার দ্বার খুলবে বেলা ১১টায়, চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত।